আমারও খেলতে মন চায়…

নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
আমন মৌসুমের ধান কাটা শেষ। বাড়ির সামনে পড়ে আছে খড়ের অবশিষ্ট অংশ নিয়ে ধান ক্ষেত। প্রতিদিন বিকেল হলেই ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে খেলার জন্য ছুটে যায়। উঠোনের এক কোণে দাঁড়িয়ে কিশোরীরা সেই দৃশ্য দেখে, আর মনে পড়ে যায় তাঁদের ছেলেবেলা। দীর্ঘ নিঃশ্বাসে বেরিয়ে যায় মনের চাপা কষ্ট। ‘আমাদেরওতো এমন দিন ছিল? আমরাও খেলতাম? প্রতিদিন বিকেলের অপেক্ষায় থাকতাম? তবে এখন কেন পারিনা? ইস্ আবার যদি খেলতে পারতাম?’


শুধু কি ছোটরাই খেলবে, মেয়েরা বড় হয়ে গেলে কি আর মাঠে গিয়ে খেলতে পারেনা ? আমরা খেলবো, মাঠে গিয়েই খেলবো। পুরুষরা অবশ্য প্রথমে আপত্তি জানিয়ে ছিল। কিন্তু শেষে সকলের ইচ্ছা শক্তির কাছে হার মানতে হলো। সুলতানগাতী গ্রামের কিশোরী আর নারীদের এমনি এক ব্যতিক্রমী আয়োজনে সহযোগিতা করেছে পুরুষরাও।
নবীন আর প্রবীণদের মাঝে বৈষম্য দূরীকরণে উক্ত গ্রামের নকশী কাঁথা যুব সংগঠন খেলাধূলার আয়োজন করেছিল। যেখানে অংশগ্রহণ করেন গ্রামের প্রবীণ নারী ও কিশোরী। তারাও একদিনের জন্য ফিরে গিয়েছিলেন নিজেদের শৈশবে।
যুব সংগঠনের মাসিক সভায় গ্রামের কিশোরীরা প্রস্তাব করেছিল তারা একটি অনুষ্ঠান করতে চায়। সেই সুবাদেই সিদ্ধান্ত হয় খেলা আয়োজনের। তাদের এই আয়োজনে নারীরাও অংশগ্রহণের আবদার জানায়। কারণ তারা যে এখন বড় হয়ে গেছে, আর ছোটটি নেই।


নির্দিষ্ট দিনে ও সময়ে নারীরা তাঁদের প্রতিদিনের কাজ একটু সময়ের আগেই শেষ করে খেলার জন্য প্রস্তুতি নেয়। তারপর খোলা মাঠে, ধান ক্ষেতে জড়ো হয় সকলে। শুরু হয় খেলা। একে একে বেলুন ফাটানো, দৌড়, মাছ উড়ে না পাখি উড়ে, বল নিক্ষেপ ইত্যাদি খেলায় অংশ নেয় তাঁরা।


বেলুন ফাটানো খেলার নিয়ম হচ্ছে প্রত্যেকের হাতে একটি করে ফোলানো বেলুন থাকবে। প্রত্যেকেই নিজেদের বেলুন রক্ষা করে অন্যদেরটা ফাটানোর চেষ্টা করবে। যার বেলুন ফেটে যাবে সে খেলা থেকে সরে যাবে। এভাবেই খেলা এগিয়ে চলে। একজন আরেক জনের বেলুন ফাটানোর নেশায় খেলতে থাকে। যার বেলুন সবার শেষে ফাটানো হবে সে হবে এই খেলার বিজয়ী।


পরে শুরু হয় দৌড় খেলা। নবীন ও প্রবীণ উভয়েই এক সাথে দৌঁড়ে গিয়ে নির্দিষ্ট একটি সীমানা অতিক্রম করে। ততক্ষণে মাঠে অনেকেই এসে গেছে। যে কৃষকরা জমি থেকে খড় সংগ্রহ করে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছিল তারাও খড়ের বোঝা ফেলে রেখে বসে যায় খেলা দেখতে। চলে আসে পার্শ্ববর্তী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছোট শিক্ষার্থীরাও। তারা হাতে তালি দিয়ে খেলোয়াড়দের উৎসাহিত করে।


পরবর্তী খেলা ছিল মাছ উড়ে না পাখি উড়ে। এখানে বিভিন্ন প্রাণির নাম বলা হয়। আর অংশগ্রহণকারীগণ উড়ার ভঙ্গিতে হাত তোলে। যে প্রাণিরা উড়তে পারেনা, তাদের বেলায় যদি কেউ হাত তোলে তবে সে খেলা থেকে বাদ পড়ে যায়। এটা নিয়ম মানার চাইতে মজা বেশি।


বল নিক্ষেপ খেলায় একটি পাত্রে নির্দিষ্ট দুরত্বে বল ফেলা হয়। যার বল সেই পাত্রে গিয়ে পড়বে, সেই বিজয়ী। এভাবেই সকলের অংশগ্রহণে আর আনন্দ, খুশিতে খেলা শেষ হয়।
প্রতিটি খেলার নিয়ম শৃংখলা রক্ষা আর পরিচালনা করেন গ্রামের প্রবীণ নারী ফরিদা আক্তার। খেলা শেষে প্রতিটি খেলার বিজয়ী ও অংশগ্রহণকারীদের মাঝে পুরষ্কার বিতরণ করা হয়।


একদিনের জন্য হলেও কিশোরী ও নারীদের মনের মাঝে শৈশব ফিরে এসেছিল। ফিরে এসেছিল হারানো ছেলেবেলা। মায়ের বকুনি আর বাবার শাসনের ফাঁকে সমবয়সীদের সাথে নিয়ে আনন্দে কাটানো সেই ছেলেবেলা।
কিশোরীরাও চেয়েছিল পরিবারের বড় সদস্যরা যেন বুঝতে পারে তাদের মনের খামতিটা কোথায়। তারা কিসে আনন্দ পায়।


খেলাধূলা আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতির একটা অংশ। তবে বর্তমান সময়ে গ্রামে খেলাধুলার চর্চা করে শুধুমাত্র ছেলেরা। অতীতে গোল্লাছুট, দাঁড়িয়াবান্ধা, বউছি ইত্যাদি ছিল প্রচলিত খেলা, যেখানে মেয়েদের অংশগ্রহণ ছিল বেশি। বাড়ির উঠোনে সকল বয়সের নারীরা এই খেলায় মেতে উঠতো। কিন্তু অতীতের তুলনায় এই চর্চা কমে যাওয়ার কারণে বয়সের শ্রেণিভেদে তৈরি হয়েছে বৈষম্য, মতের অমিল।


আগে যখন দল বেঁধে গ্রামের সকল বয়সের নারীরা খেলতো, তখন তাঁদের মাঝে গড়ে উঠতো এক ধরণের বন্ধুতা। যেখানে বয়স কোনো সীমারেখা টানতে পারেনি। এই বন্ধুতায় ছিল সরলতা, বিশ্বাস আর সম্মান। কিন্তু এখন আর সেটি নেই। সকলের মাঝে একটা অদৃশ্য ব্যবধান তৈরি হয়েছে। এই ব্যবধান দূর করার লক্ষ্যেই কাজ করতে হবে আমাদের।

happy wheels 2

Comments