এক সাথে কাজ করে লাভবান হবো সবাই
রাজশাহী থেকে সুমন আলী
পটভূমি
আদিকাল থেকে পরিবারের উন্নয়নে নারীরা ভূমিকা রেখে আসছেন। নিজের কাজের মাধ্যমে পরিবারে সমৃদ্ধ এনেছেন। যার ফলে উপকৃত হয়েছে পরিবার, সমাজ ও দেশ। তেমনই একদল প্রান্তিক নারী নিজেরা একত্রিত হয়ে যৌথ কাজের মধ্য দিয়ে নিজেদের পরিবারের উন্নয়ন করে চলেছেন পাশাপাশি ভূমিকা রাখছেন পরিবশে উন্নয়নে। আর এ কাজে তাঁরা পেয়েছেন সফলতাও। রাজশাহীর পবা উপজেলার কারিগর পাড়া গ্রামের নারীরা একত্রিত হয়ে গড়ে তুলেছেন “কারিগর পাড়া নারী উন্নয়ন সংগঠন”। বর্তমানে সংগঠনটির সদস্য ৩৫ জন। যারা সকলেই ভার্মি কম্পোস্ট সার উৎপাদনের সাথে সম্পৃক্ত। পবা উপজেলার বড়গাছি ইউনিয়নটি সবজি জাতীয় ফসল উৎপাদনের জন্য প্রসিদ্ধ। এখানে সারাবছর বৈচিত্র্যময় মৌসুমী শাকসবজি উৎপাদন হয়। আর এখানেই কাজ করছেন সংগঠনটি। তারা নিজেরা নিজেদের চাষকৃত সবজি চাষের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ভার্মি কম্পোস্ট সার ব্যবহার করেন। পাশাপাশি অন্য কৃষক-কৃষাণীদের সচেতন করেন চাষকৃত শাক-সবজিতে ভার্মি কম্পোস্ট সার ব্যাবহার করতে। সংগঠনটি ২০২১ সালে কারিগর পাড়া গ্রামকে ভার্মি কম্পোস্ট গ্রাম হিসেবে ঘোষণা করে।
সবাই মিলে এক সাথে
২০১৫ সালে বারসিক পবা উপজেলার বড়গাছি ইউনিয়নে কাজ শুরু করে। এ যাত্রায় যুক্ত হয় কারগিরপাড়া গ্রাম। শুরুতে মাত্র ১০জন নারী মিলে উদ্যোগ নেন একটি নারী সংগঠন করার যেখানে বারসিক’র সহযোগিতায় “কারগির পাড়া নারী উন্নয়ন” নামে সংগঠনটির আত্মপ্রকাশ হয়। এরপর সংগঠন ও জনগোষ্ঠি পর্যায়ে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ শুরু হয়। জৈব পদ্ধতিতে ফসল চাষাবাদে প্রশিক্ষণ কর্মশালা, গ্রামের সমস্যা চিহ্নিতকরণ সভা, ভার্মি কম্পোস্ট তৈরি ও ব্যবহার বিষয়ে প্রশিক্ষণ কর্মশালা, সংগঠন শক্তিশালী করতে করণীয় নিয়ে সভা করতো এই সংগঠনটি। এই কাজে আগ্রহী হয়ে গ্রামের অনেক নারী কাজের সাথে যুক্ত হতে থাকেন। গ্রামের ২৫জন নারী অংশগ্রহণকারী মিলে ২০১৭ সালে বারসিক থেকে ভার্মি কম্পোস্ট তৈরি ও ব্যবহারের উপর একটি প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়। সেখান থেকেই শুরু হয় সংগঠনটির বর্তমান সভাপতি মোছাঃ বিলকিস বেগমের (৫৬) ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদনের। মাত্র ৫টি চাড়ি দিয়ে ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদনের কাজ শুরু করেন তিনি। এখন বিলকিস বেগম মাসে সব খরচ বাদ দিয়ে ২০-২৫ হাজার টাকা আয় করেন এ সার বিক্রি করে। তাদের সংগঠনটির সদস্য সংখ্যা বেড়েছে সাথে বেড়েছে ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদনকারী নারীর সংখ্যাও। বর্তমানে সংগঠনের ৩১জন নারী নিজ বাড়িতে ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন করেন। নিজেরা ব্যবহার করেন আবার নিজেদের চাহিদা পূরণ করার পর সবাই মিলে বিক্রিও করেন। সবাইকে এ কাজে উৎসাহ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন সংঠনটির সভাপতি মোছাঃ বিলকিস বেগম। এ বিষয়ে তিনি বলেন, “আমরা আমাদের সংগঠনের মাধ্যমেই সকল কাজ সম্পন্ন করি। আমি চাই সকলে মিলে একসাথে নিজেদের উন্নয়ন যেন হয়। তাই সবাইকে বলি বাড়িতে ভার্মি কম্পোস্ট তৈরি করতে, ভার্মি কম্পোস্ট সার বিক্রয় না হলেও যেন আমরা আমাদের নিজের কাজে ব্যাবহার করতে পারি। বাজার থেকে যেন সার কিনতে না হয়।
এক সাথে বিক্রি করি, এক সাথে আয় করি
সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক মোছাঃ রেনুকা বেগম(৫৬) নিজের বাড়িতে ৭০টি চারি দিয়ে একটি সেড তৈরি করেছেন যেখান থেকে মাসে ১০-১৫ মণ সার উৎপাদন হয়। রেনুকা বেগমের নিজের চাষের জমি কম থাকায় প্রতি মাসে নিজের জন্য সারের প্রয়োজন হয় না। তাই উৎপাদিত সার তিনি বিক্রয় করে আয় করেন। তিনি বলেন, “আমাদের সংগঠনের সকল সদস্যদের বাড়িতেই ভার্মি কম্পোস্ট সার উৎপাদন হয়। কারো বাড়িতে ১৫টি, কারো বাড়িতে ২০টি, কেউ আবার ৮টি চারিতে ভার্মি ক¤েপাস্ট সার উৎপাদন করছেন। আমরা যদি ১০ মণ সারেরও অর্ডার পাই তাহলেও সবাই একসাথে বসে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিই কে কতটুকু সার দিতে পারবেন। আমার এবং কিলকিস আপার সার বেশি উৎপাদন হয় বলে আমরাই যে দুজনই ১০ মণ দিয়ে দিবো তা নয়। যাদের অল্প উৎপাদন হয় তাঁদের থেকেই আগে সংগ্রহ করি।’ তিনি আরও বলেন, এখানে কেউ ২০ কেজিও দিতে পারে। সারের বেশির ভাগ অর্ডার আসে সংগঠনটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মাধ্যমে। তারা সেই অর্ডারটি সবার মাধ্যমে ভাগ করে দেন এবং সবার নিকট থেকে মান-সম্পন্ন সার সংগ্রহ করে অর্ডারটি সম্পন্ন করেন। এরপর যার নিকট থেকে যতটুকু সার নেওয়া হয়েছিলো সে পরিমাণ টাকা দিয়ে দেওয়া হয়।’ রেনুকা বেগম জানান, ‘আমরা চাই সংগঠনের মাধ্যমে সবাই এগিয়ে যেতে। সবার সমান উন্নতি করতে। বিগত ৬ মাস আগে সংগঠনের অপর সদস্য মোছাঃ জাহানারা বেগম (৪৮) মাত্র ৫টি চাড়ি দিয়ে নিজের বাড়িতে ভার্মি কম্পোস্ট সার উৎপাদনের কাজ শুরু করেছেন। তিনি এ মাসে ২০ কেজি সার সংগঠনের জমা দিয়ে সার বিক্রয় বাবদ ৬৫০ টাকা আয় করে পুনরায় ৪টি চারি কিনেছেন। তিনি বলেন, “আমি সবার কাজ দেখে উৎসাহ নিয়ে এ কাজ শুরু করেছি আস্তে আস্তে আমি আমার খামার বড় করতে চাই। পাশাপাশি আমরা নতুন করে কাজ শুরু করার জন্য কেঁচো আমাদের সংগঠন থেকেই পাই।’
মিলছে সরকারী সুযোগ সুবিধাও
নারীদের এ কাজে সফলতা ও প্রচেষ্টা দেখে সহায়তা ও স্বীকৃতিস্বরূপ ১০ জন নারীকে সরকারি খরচে ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদনের সেড তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। যেখান থেকেও নিয়মিত ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন হচ্ছে। পাশাপাশি তারা নতুন এলাকায় ভার্মি কম্পোস্ট সম্প্রসারণের কারিগর পাড়া গ্রামের নারীদের থেকে কেঁচো ক্রয় করছেন এবং অভিজ্ঞতা বিনিময়ের জন্য অন্য গ্রামের নারীদেরও কারিগরপাড়া গ্রামে নিয়ে আসেন। এ কাজে যোগাযোগের জন্য সহযোগিতা করছে বারসিক। বর্তমানে সরকারী দপ্তরে যোগাযোগ করা হচ্ছে একটি ভার্মি কম্পোষ্ট সেপারেটর প্রাপ্তির জন্য। তাহলে ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদনের কাজ আরো সহজ হবে।
উপসংহার
কারিগর পাড়া গ্রামের নারীদের সমন্বিতভাবে ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন ব্যবহার ও বিপণনের মাধ্যমে তাঁরা পরিবশে উন্নয়নে ভূমিকা রাখছেন। তারা নিজেরা এ কাজের ফলে স্বীকৃতি পাচ্ছেন। পরিবার, সমাজ ও দেশের উন্নয়নেও ভূমিকা রাখছেন। পাশাপাশি নারীর ক্ষমতায়নের একটি বড় উদাহরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছেন।