হাওরাঞ্চলের জনগোষ্ঠির উন্নয়নে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে
নেত্রকোনা থেকে শংকর ম্রং
গতকাল ২৩ জানুয়ারি বারসিক মদন রির্সোস সেন্টার এর আয়োজনে মদন উপজেলা নির্বাহী অফিসার এর সম্মেলন কক্ষে মদন উপজেলায় কর্মরত ২৮টি সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণে ‘হাওরাঞ্চলের জনগোষ্ঠির সরকারি-বেসরকারি সেবা-পরিসেবায় প্রবেশাধিকার’ শীর্ষক এক সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে। সংলাপে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়ালীউল হাসান। সংলাপে অংশগ্রহণকারী সরকারি-বেসরকারি সেবা-পরিসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিগণ স্ব স্ব প্রতিষ্ঠান প্রদত্ত্ব সেবা-পরিসেবাসমূহ এবং এগুলো সাধারণ জনগোষ্ঠীর নিকট সহজলভ্যকরণের কৌশলগুলো সহভাগিতা করেন।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা গোলাম রসুল বারসিক পরিচালিত ধানসহ বিভিন্ন ফসলের জাত গবেষণার ফলাফলের তথ্য কৃষি বিভাগকে প্রদান করতে বলেন, ‘কৃষি বিভাগ বারসিক’র গবেষণা কাজে কৃষকদেরকে বিভিন্ন সেবা ও সহযোগিতা প্রদান করতে পারবে। খালিয়াজুরি উপজেলা হলো মূল হাওর, আর বারসিক যেহেতু হাওরাঞ্চলের কৃষি, পরিবেশ ও দূর্যোগ নিয়ে কাজ করছে তাই খালিয়াজুরি উপজেলায় বারসিক এর কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা হলে হাওরের সঠিক আমেজে কাজ করা যাবে। প্রকৃতির কাছাকাছি থেকে কৃষকরা কৃষি কাজ আয়ত্ত্ব করেছে তাই তারা খুবই অভিজ্ঞ।’ তিনি পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষার মাধ্যমে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে জমিতে পার্চিং দিতে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে কৃষি বিভাগের পাশাপাশি সকল এনজিওদের এগিয়ে আসার আহবান জানান।
উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা আব্দুল সালেক বলেন, ‘কোন কার্যক্রম শুরু করার পূর্বে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে এধরণের সংলাপ আয়োজন করা হলে পরস্পরের মধ্যে সম্পর্কের যেমন উন্নত হবে তেমনি উভয়ের মধ্যে যোগাযোগ শক্তিশালী হবে। ফলে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের মধ্যে সহজেই সমন্বয় করা যাবে।’ তিনি সকল এনজিওদেরকে যুব ও নারীদের দক্ষতামূলক প্রশিক্ষণের জন্য উপজেলা যুব উন্নয়ন অফিসের সাথে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন।
মৎস্য কর্মকর্তা আশরাফ উদ্দিন ফকির সকল এনজিওদেরকে স্থানীয় জাতের মাছের জাত রক্ষায় রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার বন্ধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং সাধারণ জনগোষ্ঠীর অভ্যাসগত চর্চা যেমন- বিষ দিয়ে, বেড় জাল দিয়ে ছোট ছোট মাছ ধরা এবং জলাশয় সেচে মাছ ধরাকে দায়ি করে এসব বন্ধে প্রচারণা বৃদ্ধির পরামর্শ দেন। তার মতে,‘শুধু আইন করেই এসব বন্ধ করা যাবেনা, এজন্য প্রয়োজন জনগণকে সচেতন করা। আর এটি GO এবং NGOদের যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমেই শুধু সম্ভব। মাছের অভয়াশ্রম বৃদ্ধি পেলে বিলুপ্ত মাছের জাতগুলোও ফিরে আসবে আবার।’
একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের সমন্বয়কারী সারোয়ার জাহান লিটন বলেন,‘মদন উপজেলায় প্রকল্পের অধীনে ১৪০টি সমিতিতে মোট সদস্য সংখ্যা ৬০০০ জন। এসব সমিতিগুলোকে ৬টি ট্রেডে ঋণ প্রদান করা হয়। কিন্তু ট্রেডগুলোর বিষয়ে অধিকাংশ সদস্যদের প্রশিক্ষণ না থাকায় তারা অনেক ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়ে।’ তিনি এনজিওদেরকে এসব সমিতির সদস্যদেরকে প্রশিক্ষণ প্রদানের আহবান জানান। তিনি ১৪০টি সংগঠনের তথ্য তার অফিস থেকে সংগ্রহ করার জন্য এনজিও কর্মকর্তাদের অনুরোধ করেন।
সংলাপে অংশগ্রহণকারী অন্যান্য কর্মকর্তাগণ পরস্পরের সাথে আলোচনা করে যেসব ক্ষেত্রে সহযোগিতা প্রয়োজন সেব ক্ষেত্রে পরস্পরকে সহযোগিতা দেয়ার ও নেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। তবে এক্ষেত্রে কারো দোষ-ত্রুটি না খুঁজে সহযোগিতার মানসিকতা পোষণ করতে সকল এনজিও কর্মকর্তাগণ পরস্পরের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। মদন ডেমিয়েন ফাউন্ডেশন এর কর্মকর্তা পুলক দত্ত সকল এনজিও কর্মকর্তাদেরকে যক্ষা ও কুষ্ঠ্য রোগী পেলে তার বিভাগে পাঠানোর অনুরোধ জানান। গ্রাম পর্যায়ে যক্ষা ও কুষ্ঠ্য রোগ বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রচারণার আয়োজন করা হলে তাতে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাস দেন।
নারী প্রগতি সংঘের উপজেলা ব্যবস্থাপক জাফর ইকবাল বলেন, “ডর্প প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রামের কিশোরীদের ঋতু¯্রাব ও কিশোরী স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে গ্রাম পর্যায়ে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রম ছাড়াও দরিদ্র পরিবারের কিশোরীদের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ সহযোগিতা প্রদান করে আসছে। কোন এনজিও মদন এলাকায় কিশোরীদের ঋতু বিষয়ে সচেতনতামূলক আলোচনা আয়োজন করতে চাইলে ডর্প প্রকল্পের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করা যাবে।
এর আগে অনুষ্ঠানের শুরুতে বারসিক এর সহযোগি সমন্বয়কারী শংকর ম্রং স্বাগত বক্তব্যে বলেন, ‘২০০১ সাল থেকে বারসিক নেত্রকোনা জেলায় কার্যক্রম শুরু করলেও মদন উপজেলায় কার্যক্রম শুরু করেছে এপ্রিল ২০১৮ থেকে। বিগত দশ মাসে বারসিক মূলতঃ মদন উপজেলার মদন ও গোবিন্দশ্রী ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে কৃষক, যুব ও বিভিন্ন পেশার জনগোষ্ঠী এবং ইউনিয়ন স্ট্যান্ডিং কমিটির সাথে গ্রাম সভা, মতবিনিময় সভা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জলবায়ু জনিত দূর্যোগগুলো সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেছে। দূর্যোগ প্রবণ হাওরাঞ্চলের জনগোষ্ঠীর সমস্যা জানা, সমস্যাগুলো মোকাবেলায় জনগোষ্ঠীর স্থানীয় চর্চাগুলো নথিভূক্ত করা, স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে এলাকার কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ ইত্যাদি ক্ষেত্রে উদ্যোগ গ্রহণে সহযোগিতা প্রদানের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে সহযোগিতা দেয়া হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, মদন উপজেলায় কর্মরত সরকারি-বেসরকারি সেবা পরিসেবা প্রদানকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সেবাসমূহ সাধারণ জনগোষ্ঠীর নিকট সহজলভ্যকরণ এবং তাদের প্রবেশাধীকার নিশ্চিতকরণে সকল প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়ন ও সমন্বয় রেখে পরস্পরের সহযোগি হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনা করা যায় সে কৌশল নির্ধারণ করা এ সংলাপের উদ্দেশ্য।
অনুষ্ঠানে মদন কর্মএলাকায় বারসিক পরিচালিত কার্যক্রম মাল্টিমিডিয়ায় উপস্থাপন করেন বারসিক’র এলাকা সমন্বয়কারী অহিদুর রহমান। তিনি বারসিক এর লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, কর্মএলাকা, লক্ষ্যিত জনগোষ্ঠী, কর্ম প্রক্রিয়া ইত্যাদি বিষয় ছাড়াও মদন উপজেলার মদন ও গোবিন্দশ্রী ইউনিয়নে বিগত ১০ মাসে পরিচালিত কার্যক্রমগুলো সকলের নিকট তুলে ধরেন।