জাফরগঞ্জ যমুনা চরের বৈচিত্র্যময় ফসলে জাতীয় অর্থনীতি টেকসই হচ্ছে

মো. নজরুল ইসলাম: মানিকগঞ্জ
সুজলা সুফলা শষ্য শ্যামলা আমাদের এই রুপসী বাংলার মধ্য সমতলের জেলা মানিকগঞ্জ। নদী ও প্রাকৃতিক বৈচিত্রময় জেলার অন্যতম উপজেলা শিবালয়। ১৯৯.১৮ বর্গ কি.মি আয়তন বিশিষ্ট শিবালয় উপজেলা মানিকগঞ্জ জেলার আয়তনের দিক থেকে দ্বিতীয় বৃহত্তম উপজেলা। এটি ১৮৭৫ সালে থানা হিসেবে জন্ম লাভ করে। তখন এটি জ্ফারগঞ্জ নামক স্থানে অবস্থিত ছিল। জ্ফারগঞ্জ যমুনার পাড়ে অবস্থিত হওয়ায় যমুনার ভাঙ্গনে জ্ফারগঞ্জ বিলুপ্ত হয় এবং ১৯০০ সালে থানা হেডকোয়ার্টার শিবালয়ে স্থানান্তর হয় এবং ১৯৮৪ সালে এটি উপজেলা হিসেবে উন্নিত হয়।

কৃষিখাতে নিরব বিপ্লবের পথে যমুনার চর
বৈশি^ক জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে একদিকে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বিলীন হচ্ছে। অন্যদিকে কৃষকদেরকে অসময়ে বন্যার মতো নানা দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। আমরা বৈশি^ক ভূরাজনীতির প্রতিযোগিতায় প্রতিবেশী দেশের কাছ থেকে পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। নদীতে যত্রতত্র বাঁধ,ব্রীজ ও কালভার্টসহ অপরিকল্পিত উন্নয়নেও নদীর স্বাধীন চরিত্র বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এসকল নানা সংকটের মাঝেও নদীর বুকে জেগে ওঠা চরে স্বপ্ন দেখাচ্ছে বাংলার কৃষক, খেটে খাওয়া ক্ষেতমজুর।
মানিকগঞ্জের হরিরামপুর,শিবালয়,দৌলতপুরসহ দুর্গম চরাঞ্চলে কৃষিতে বিপ্লব ঘটেছে। আগে যেখানে শুধুমাত্র হাতেগোনা কয়েকটি ফসল চাষাবাদ হতো, সেখানে এখন প্রায় সকল প্রকার সবজিসহ সব ধরণের ফসল চাষ হচ্ছে। অনেক অনাবাদি জমি এসেছে চাষের আওতায়। কৃষিতে নির্ভর করেই সুদিনের স্বপ্ন বুনছেন নদী ভাঙনসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করা চরাঞ্চলের মানুষ।


জাফরগঞ্জ যমুনা নদীর সবচেয়ে বড় চর আলোকদিয়া। তারপর জোতকাশি,রাহাতপুর,কিশোরীর চর ইত্যাদি। যাহোক গত ৪ জানুয়ারি ২০২৪ “সবুজে বাঁচি,প্রকৃতি সুরক্ষা করি“ এই স্লোগানকে সামনে রেখে মানিকগঞ্জ শহর থেকে বিশ^ সাহিত্যের কতেক প্রকৃতিপ্রেমী হাঁটা দিবসের পথিক দল নামে দিনব্যপী হাটর মধ্যে সবুজের মাঝে প্রকৃতিকে ফিরে দেখতে চায়। হাঁটা দিবসের পথিকদলের সমন্বয়কারী পালের গোদা শাহাদত হোসেন সাইজির সভাপতিত্বে ও গুরু আল্লামা অনিশ আজাহার এর দিকনির্দেশনায় এবং উন্নয়ন কর্মী মো. নজরুল ইসলামের ব্যাবস্থাপনায় পথিকদলে সারাক্ষণ মহানান্দসূধা নিয়ে যুক্ত ছিলেন ভাষা শহীদ রফিকের উত্তরাধিকার দেশপ্রেমিক সাদিকুর রহমান সুহাস, বাচিকশিল্পী প্রভাষক সাইফুল ইসলাম বক্স দিপু, খেলাঘর প্রশিক্ষক ওস্তাদ আতিকুর রহমান মিঠু, প্রকৃতিপ্রেমী অঞ্জন, সাহিত্যপ্রেমী শিক্ষক মো. নুরুল ইসলাম প্রমুখ।


সেই লক্ষ্যে জাফরগঞ্জ ঘাট থেকে খেয়া পারি দিয়ে হাটতে হাটতে আবার নৌকা পারি দিতে হলো। মূলত চরে যাতায়াতে একমাত্র ভরসা নৌকা। দুর্গম এই চরে নৌকা থেকে নামতেই চোখে পড়লো কৃষক-কৃষাণীর ফসলের মাঠে নানা কাজে ব্যস্ততার দৃশ্য। কেউ পাকা ফসল ঘরে তুলছেন, কেউবা আবার নতুন ফসল ফলাতে জমি প্রস্তুত করছেন। অনেককেই দেখা গেলো গো চারণ, গো খাদ্য ও জ¦ালানি সংগ্রহে ব্যস্ত আছেন।


চরের মাঝখানে মাসকালাই ক্ষেতে ঘাস কাটছেন কৃষক মো.কাসেম আলী। তিনি বলেন, ‘এবার জমিতে মাসকালই,সরিষা,মরিচ ও টমেটো অনেক ভালো হয়েছে। এবার মাসকালইয়ের ফলনও অনেক ভালো হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘চরের জমি আগের চেয়ে অনেক বেশি উর্বর।’ একই চরে কৃষ মো. সেলিম মিয়া, মো. হাতেম মোল্লা, মো. আলাউদিœসহ অনেকের সাথে কথা হয়। তারা জানান, প্রতিবছর চর জাগে তবে নদী ভাঙনে উপযোগী কৃষি জমি হ্রাসও পাচ্ছে। কিন্তু আগের চেয়ে চাষাবাদ বেড়েছে। চরের চাষযোগ্য কোনো জমিই এখন আর খালি নেই। এখন সাধরণ কৃষকের সাথে শিক্ষিত তরুণরাও কৃষিকাজে এগিয়ে আসছে। তারা আধুনিক কৃষিকাজে সফল হচ্ছে। আগের মতো চরের মানুষকে আর না খেয়ে কাটাতে হয় না। তাদের ঘরে সবসময় কোনো না কোনো ফসল থাকে। কৃষক আলাউদ্দিন বলেন, ‘আগে আমরা জমিতে সার বিষ দিতাম না কিন্তু এখন আমাদের বেশি ফসলের লোভে মাটি সার বিষের মজা পেয়েছে। তাই বিষমুক্ত ফসল ঘরে আনা একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’


স্থানীয় ইউপি সদস্য মঞ্জু মিয়া জানান, চরে আগে শুধুমাত্র চীনাবাদাম, তিল ও কাউনসহ হাতেগোনা কয়েকটি ফসলের চাষ হতো। কিন্তু বর্তমানে ধান, সরিষা, ভুট্টা, ধনেপাতা, পেঁয়াজ, রসুন, লাউ, সিম, বেগুন ও টমেটোসহ বিভিন্ন ফসল উৎপাদন হচ্ছে। আলোকদিয়া চরে এবারই প্রথম তরমুজের চাষ করে সফল হয়েছেন কৃষকরা। তিনি আরও জানান, কৃষিতে বিপ্লব ঘটলেও, চরের মানুষের সবচেয়ে বড় আতঙ্ক নদী ভাঙন নিয়ে। কারণ প্রতিবছর পদ্মা-যমুনায় বিলীন হচ্ছে তাদের বসতবাড়িসহ ফসলি জমি। নদী ভাঙন রোধ করা গেলে চরের মানুষেরা আরো শান্তিতে বববাস করতে পারতো।
মানিকগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আবু মো. এনায়েত উল্লাহ জানান, চরে আগে বালু মাটি ছিল বেশি। কিন্তু ধীরে ধীরে বালুর পরিমাণ কমে পলির পরিমাণ বাড়ছে। এর ফলে চাষাবাদের আওতায় আসছে জমি। চরে দুই ফসলি জমির পরিমাণ প্রায় ৮ হাজার হেক্টর। তিন ফসলি জমির পরিমাণ প্রায় ৪ হাজার হেক্টর এবং এক ফসলি জমির পরিমাণ ৭০০ হেক্টর। বিভিন্ন খাদ্য শস্য, তেল ও ডাল জাতীয় ফসল এবং সবজিসহ প্রায় ১৫ থেকে ২০ প্রকারের ফসল আবাদ হচ্ছে চরে। দিন দিন চাষাবাদের পরিমাণ আরও বাড়ছে। মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় যাতায়াত একটা বড় সমস্যা। তবে কৃষি বিভাগ থেকে চরের কৃষকদের আধুনিক চাষাবাদে পরামর্শ এবং বিভিন্ন সরকারি প্রণোদনা প্রদান করা হচ্ছে। যাতে কৃষকরা অধিক লাভবান হন।


জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে আরো জানা গেছে, চরে মোট জমির পরিমাণ প্রায় ২৬ হাজার হেক্টর। এর প্রায় ৬০ ভাগই এসেছে আবাদের আওতায়। মাটি উর্বর হওয়ায় ফলনও হচ্ছে ভালো। মানিকগঞ্জের হরিরামপুর, শিবালয় ও দৌলতপুর উপজেলায় পদ্মা-যমুনার মোট চর রয়েছে ৩১টি। এর মধ্যে ২৮টি চর মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন। বাকি ৩টি চর ভূখন্ডের সাথে সম্পৃক্ত। চরে জমির মোট আয়তন ২৫ হাজার ৮৫০ হেক্টর। এর মধ্যে প্রায় ৬০ ভাগ জমি কৃষি চাষের আওতায় এসেছে।


পরিশেষে আমরা বলতে চাই আমরা নদী ও চরের স্বাধীনতা চাই, চর নিয়ে দখলদারি,জোতদারি, পেশীশক্তির খেলা বন্ধ করে প্রকৃত মালিকদের প্রতিনিধিরাই ভোগ দখলে থাকুক। অধিক ফসলের লোভে বিষের চক্রে প্রবেশ না করে প্রাকৃতিক দাওয়াই জৈব কৃষি দিয়েই বৈচিত্রময় ফসল চাষ ও দেশীয় স্বাদ গ্রহণ করতে পারি। উৎপাদ বাড়লে সংসার ও দেশের উন্নতি হয় এবং জাতীয় অর্থনীতি শক্তিশালী হয়। সরকার ঘোষিত টেকসই স্থায়িত্বশীল কৃষি ব্যবস্থা বিনির্মাণে জৈব কৃষি চর্চায় সরকারি বেসরকারি সংগঠনগুলোকে আরো সো”্চার ভূমিকা পালনের আহবান জানাই।

happy wheels 2