দুর্যোগে, দুর্ভোগে আমরা একসাথে
রাজশাহী থেকে সুলতানা খাতুন
“সমস্যা আমাদেরই বেশি হয়, আমরা যারা নারী, একদিকে পরিবারের বাচ্চা-কাচ্চা আরেকদিকে নিজের গৃহপালিত পশু-পাখির যত্ন নিতে হয়। তার ওপর আবার আছে সংসারের সকল কাজ। বর্ষার সময়ও পানির জন্যে আমাদের কষ্ট হয়, আবার খরার সময়ও পানির জন্যে কষ্ট, কষ্ট যেন পিছু ছাড়ে না আমাদের।” কথাগুলো বলছিলেন বিলনেপালপাড়া নারী সংগঠনের সভাপতি বিলকিছ আরা (৪৫)। তিনি আরও বলেন, “বিলে অনেক পুকুর খনন করা হয়েছে। অপরিকল্পিতভাবে খনন করায় পানিগুলো আর যেতে পারে না, ঠাসা খেয়ে জমাট বেধে থাকে, বাড়ি ঘরেও উঠে। সবমিলে আমাদেই দুরাবস্থা বেশি হয়। কিন্তু আমারাও থেমে নেই, কাজ করছি সবাই মিলে সমস্যা সমাধানের জন্যে। বাড়িতে যে জলাবদ্ধতা তৈরি হযেছে, সেটি সমাধানে আমারা সবাই মিলে এবার পাইপ এনে পানি চলাচলের ব্যবস্থা করেছি। বাড়ির আঙিনায় আর পানি উঠবে না।”
রাজশাহীর পবা উপজেলার দর্শনপাড়া ইউনিয়নের বিলনেপাল পাড়া গ্রামটির একপাশে জুয়াখালি নদী আর তিন দিকেই বলা যায় বিল দিয়ে ঘেরা। বিলে একসময় নারীরা তাদের জ্বালানি সংগ্রহ করতো, বিলকে কেন্দ্র করে পুরুষরা নানা কাজের সাথে জড়িয়ে থাকতো। কিন্তু দিনে দিনে বিলের বৈচিত্র্য নষ্ট হয়ে গেছে। বিলে এখন কৃত্রিম পকুর খনন করে সব কিছু নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। ফলশ্রুতিতে জলাবদ্ধতারও সৃষ্টি হচ্ছে বলে এলাকাবাসীরা জানান। তাদের ভাষ্যমতে, কৃত্রিম পুকুর খননের কারণে গ্রামের দেশী গাছের পরিমাণ কমে গেছে; দেশী জাতগুলোও আর নেই। মানুষের অসুখ বিশুখ লেগেই থাকে। অন্যদিকে জমিতে প্রচুর পরিমাণ সার ও কীটনাশক দেওয়ায় স্বাস্থ্যর ক্ষতি হচ্ছে। খরার সময় আবার পানি সমস্যা দেখা দেয়। অনেক দুরদুরান্ত থেকে পানি আনতে হয় নারীদেরই।
গ্রামের এসব সমস্যাগুলো নিয়ে নারীরা বসে নেই। সমস্যা সমাধানে তারা এক হয়ে নিজের সমাজ এবং পরিবারের উন্নয়নে একতাবদ্ধ হয়েছেন। সমস্যা সমাধানের জন্য একতাবদ্ধ থাকা প্রয়োজন। এই একতাবদ্ধভাবে থাকার জন্য তারা একটি সংগঠন গড়ে তুলেছেন। যার নাম দিয়েছেন বিলনে পালপাড়া নারী সংগঠন। এই প্রসঙ্গে বিলকিছ আরা বলেন, “দিনে দিনে আমারা এক হয়ে নিজেদের সমস্যাগুলো সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করছি। দুর্যোগকালীন শাক ও সবজির সমস্যা সমাধানের জন্য আমার অচাষকৃত শাকসবজিগুলো রক্ষার উদ্যোগ নিয়েছি। পরিত্যক্ত জায়গায় অচাষকৃত শাকসবজির প্রদর্শনী প্লট তৈরি করেছি। যাতে নতুনরা এই উদ্ভিদগুলো চিনে এবং এগুলো সংরক্ষণে তাদেরও মায়া জন্মে, আগ্রহ জন্মে।” তিনি জানান, পরিবারের খাদ্য ও পুষ্টির যোগান দিবে এই অচাষকৃত শাকসবজিগুলো।
প্রতিটি বাড়িতে চলতি বর্ষা মৌসুমে একটি করে ফলজ বৃক্ষের চারা রোপণ করেছেন সংগঠনের সদস্যরা। এই গাছগুলো একদিকে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করবে অন্যদিকে আমাদের ফলের চাহিদাও মেটাবে বলে তারা মনে করেন। শুধু শাকসবজি বা গাছ রোপণ নয়; এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য নারীরা ইউনিয়ন পরিষদের যোগাযোগ করেছেন। যোগাযোগ করেই তারা ক্ষান্ত হননি। সমস্যা সমাধানের নিজেরা যা যা করা দরকার তারা সেটাই করেছেন। তাই স্ব-উদ্যোগে তারা পানি চলাচলের জন্যে তিনটি পাইপ কিনে এনে রাস্তার মধ্যে বসিয়েছেন। যাতে বর্ষার সময় বাড়িতে পানি আটকে না থাকে।
অন্যদিকে বিলের মধ্যে যেন কৃত্রিম পুকুর খনন করা না হয় এ বিষয়ে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং মেম্বারদের সাথে মতবিনিময় করেছেন। গ্রামটাকে পরিবেশবান্ধব এবং সুখী গ্রাম করতে তাঁরা একতাবদ্ধভাবে কাজ করে যাচ্ছেন বলে জানান। এছাড়া বিলের জমিতে জলাবদ্ধতার মধ্যেও ফসল উৎপাদন (ধান) করার জন্য নারী ও পুরুষ মিলে পানি সহনশীল ধান জাতের পরীক্ষামূলক চাষ শুরু করেছেন। সংগঠনের ৩৫ জন নারী সদস্যরা একতাবদ্ধ হয়ে বিভিন্ন দুর্যোগ ও দুর্ভোগ মেকাবিলায় পরস্পরের সাথে কাজ করে যাচ্ছেন।