সাম্প্রতিক পোস্ট

আর্ত মানবতার সেবায় নিবেদিতপ্রাণ আব্দুল হামিদ কবিরাজ

নেত্রকোনা থেকে শংকর ম্রং

রক্তে শর্করার পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় (ডায়াবেটিস) তা’ নিয়ন্ত্রণে রাখতে আমি প্রতিদিনের মত নেত্রকোনা শহরের মেইন রাস্তা দিয়ে হেটে কাটলির দিকে যাচ্ছিলাম। জয়নগর হাসপাতাল রোডের মোড়ে পৌছাতে হঠাৎ সাউন্ড বক্সে ডেঙ্গু রোগের প্রচারণা শুনতে পাই। জেলা সার্কিট হাউজের বাউন্ডারি ঘেষে রাস্তার ধারে একটি সাইকেলের সামনে ও পেছনে ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশা ও পেঁপে গাছের ছবি সম্বলিত একটি ফেস্টুন টানানো। কোন লোক নেই, বেশ কিছু উৎসুক জনতা পাশে দাঁড়িয়ে সাউন্ড বক্সে ডেঙ্গু রোগ থেকে রক্ষা পেতে এবং ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধের ভেষজ উপায় সম্পর্কে রেকর্ডকৃত প্রচারণা শুনছেন। তা দেখে আমি একটু দাঁড়িয়ে তা শোনার চেষ্টা করি এবং আমার বুঝতে বাকি রইল না যে, উদ্যোগটি কার হতে পারে। একটু বাদেই সেখানে উপস্থিত হন সুদর্শন, লম্বাটে মেহেদী রং করা দাড়িওয়ালা আমাদের অতিপরিচিত আর্ত মানবতার সেবক আব্দুল হামিদ কবিরাজ। যিনি নেত্রকোনার সর্বমহলে বৃক্ষ প্রেমী নামে পরিচিত। বয়স অনুমানিক ৬২ বছর এবং পেশায় তিনি একজন কবিরাজ ও ভেষজ উদ্ভিদ চাষি। নেত্রকোনার জয়নগর হাসপাতাল রোডে ঢুকতে তিনটি দোকানের পরই তার ভেষজ ঔষধের দোকান। তিনি দোকানে শতাধিক ভেষজ ঔষধের উপকরণ বিক্রির পাশাপাশি কয়েক ধরণের ভেষজ শরবত বিক্রি করেন। আব্দুল হামিদ একজন কবিরাজ হলেও প্রয়োজনে তিনি এ্যালোপেথিক ঔষধও রোগীর চিকিৎসায় ব্যবহার করে থাকেন।

20190806_071106-W600
ডেঙ্গু রোগ বর্তমানে শহরাঞ্চলের সকল শ্রেণী ও পেশার জনগোষ্ঠীর নিকট একটি আতঙ্ক। কিন্তু আমরা শহরবাসীদের অসচেতনতার জন্যই এ রোগটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সকল সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধে এর বাহক এডিস মশার উৎপত্তিস্থলগুলো ধ্বংসে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচারণা চালাচ্ছেন। এক্ষেত্রে আব্দুল হামিদ কবিরাজও বসে থাকতে পারেননি। তিনি ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধে ও ডেঙ্গু রোগের ভেষজ চিকিৎসায় পেঁপে পাতার উপকারিতা ও ব্যবহারের নিয়মাবলী লিখিত ফেস্টুন ও রেকর্ডকৃত বক্তব্য সাইকেলে নিয়ে শহরে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রচারণায় নেমে পড়েন। শহরের বিভিন্ন জনবহুল স্থানগুলোতে তিনি এ বিষয়ে প্রচার করেন এবং এ সম্পর্কিত লিফলেট বিলি করেন। ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধে তিনি ভেষজ চিকিৎসা হিসেবে পেঁপে পাতার উপকারিতার কথা প্রচার করেন। তার মতে, ডেঙ্গু জ্বর হলে পরিমাণমত পেঁপে পাতার রস খাওয়ালে উপকার পাওয়া যায়। পেঁপে গাছের পাতা রক্তে সাথে মিশে যাওয়া ভাইরাস ধ্বংস করতে ভূমিকা রাখে। পেঁপে পাতার রস শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং ডেঙ্গু জ্বর সারিয়ে তোলে। একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষকে দিনে ২ বার ৮ ঘণ্টা বিরতি দিয়ে ১০ মি.লি. পেঁপে পাতার রস খাওয়ানো, ৫ থেকে ১২ বছর বয়সী শিশুদের দিনে ২ বার ৫ মি.লি. পেঁপে পাতার রস খাওয়ানো এবং ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের ২.৫ মি.লি. পেঁপে পাতার রস দিনে ২ বার খাওয়াতে বলেন। তিনি ডেঙ্গু জ্বর হলেই পেঁপে পাতার রস খাওয়ানো আরম্ভ করতে বলেন এবং রক্তের প্লাটিলেট লেভেল ১ লক্ষ ৫০ হাজারের নিচে নামতে শুরু হলেই ২ বেলা পেঁপে পাতার রস খাওয়াতে বলেন। রোগীর মাথায় পানি দেয়া ও ভেজা কাপড় দিয়ে রোগীর শরীর মুছে দেয়ার পাশাপাশি রোগীকে প্রচুর পরিমাণে তরল (শরবত, পানি) ও স্বাভাবিক খাবার খাওয়ানোর পরামর্শ দেন। ডেঙ্গু জ্বর পেঁেপে পাতার রসের পাশাপাশি রোগীকে শুধুমাত্র প্যারাসিটামল ঔষধ খাওয়ানো এবং নিকটস্থ স্বাস্থ্য কর্মী বা ডাক্তারের পরামর্শ নিতে বলেন।

20190805_195014-W600
বিনামূল্যে পেঁপে পাতার রস পেতে তিনি সকলকে তার সাথে সেল ফোনে যোগাযোগ করার আহবান জানান। তিনি সকলকে বাড়ি আনাচে কানাচে পড়ে থাকা যেসব পাত্রে বৃষ্টির পানি জমে থাকতে পারে সেগুলো সংগ্রহ করে ধ্বংস করে বা পুড়িয়ে ফেলে এডিস মশার বংশ বৃদ্ধি রোধে সকলকে আহবান জানান।

আর্ত মানবতার সেবক আব্দুল হামিদ কবিরাজ
আব্দুল হামিদ কবিরাজ একজন আর্ত মানবতার সেবকও। তিনি দরিদ্র বা অসহায় অসুস্থ রোগী বা শীতার্থ লোকের সেবায় সদা প্রস্তুত। কোন অসহায় রোগীর সংবাদ পেলেই তিনি সেখানে ছুটে যান এবং তার সামর্থ ও দক্ষতা অনুসারে ভেষজ উপকরণ দিয়ে তার চিকিৎসা করে সুস্থ করে তোলেন। কোন অবুঝ প্রাণীকেও তিনি সেবা থেকে বঞ্চিত করেন না। সড়কে কোন শেয়াল বা কুকুর দূর্ঘটনায় অসুস্থ হলে নিজ বাড়িতে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে ছেড়ে দেন। সড়ক দূর্ঘটনায় নেত্রকোনা শহরের এক ভবঘুরে মস্তিষ্ক বিকৃত নারীর (পাগলি) পায়ের গোড়ালীর অনেক জায়গার গভীরে পর্যন্ত কেটে গিয়ে ঘাঁ হয়ে তাতে পোকা হলে নাওয়া খাওয়া ছেড়ে যন্ত্রণায় কাতরাত এবং চিৎকার চেচামেচি করত। ঐ মস্তিষ্ক বিকৃত নারীর যন্ত্রণা দেখে তিনি তাকে সদর উপজেলার পরিত্যক্ত খোলা বারান্দায় নিয়ে ব্যাথানাশক ইঞ্জেকশন দিয়ে ক্ষত স্থান থেকে ভেষজ ঔষধ দিয়ে সমস্ত কিড়া (পোকা) বের করে ব্যান্ডেজ করে দেন। মস্তিষ্ক বিকৃত হওয়ায় ঐ নারীকে এক জায়গায় ধরে রাখা সম্ভব না হওয়ায় চিকিৎসায় অনেকটা ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। শহরের বিভিন্ন এলাকায় খুঁজে খুঁজে তার চিকিৎসা করতে হচ্ছিল। মাঝে মাঝে শহরের বাইরে চলে গেলে তার আর কোন খবর পাওয়া যেত না। তাই তিনি বাধ্য হয়ে চিকিৎসার সুবিধার্থে উপজেলা পরিষদের পরিত্যাক্ত বারান্দায় শিকলে তালা দিয়ে বেঁধে রেখে চিকিৎসা করতে থাকেন। এভাবে চিকিৎসার ফলে প্রায় মাস খানেক চিকিৎসার পর ক্ষত স্থানে মাংস ভরাট হতে থাকে এবং রোগীটিও অনেকটা আরাম বোধ করে। বর্তমানে রোগীটি ৮০% সুস্থ বলে আব্দুল হামিদ জানান। বিভিন্ন গণমাধ্যমে একদিন এক অসহায় নারী রোগীর সংবাদ পেয়ে তার চিকিৎসার জন্য তিনি ছুটে যান ফরিদপুর জেলার মধুখালী উপজেলার কামারখালী গ্রামে। যে রোগীর পা ডাক্তারগণ কেটে ফেলার পরামর্শ দিয়েছিলেন সে রোগীকে সুস্থ করে তোলার জন্য তিনি আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিমাসে একবার তিনি নিজ খরচে ফরিদপুর গিয়ে রোগীটি দেখে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসেন এবং নিয়মিত রোগীর অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ খবর নেন। তার সেবায় রোগীটি অনেকটা সুস্থতার পথে বলে কবিরাজ আব্দুল হামিদ জানান। আরও কিছুদিন গেলে রোগীটি হাটতে সক্ষম হবে বলে জানান কবিরাজ আব্দুল হামিদ ও রোগীর আত্মীয়রা। এসব অসহায় রোগীদের তিনি বিনমূল্যে চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকেন।

20190806_071202-W600

বৃক্ষ প্রেমিক কবিরাজ আব্দুল হামিদ
তিনি একজন বৃক্ষ প্রেমিক। বৃক্ষ প্রেমিক হাব্দুল হামিদ কবিরাজের সংগ্রহে রয়েছে শতাধিক বৈচিত্র্যময় ঔষধি উদ্ভিদ। তিনি এসব উদ্ভিদের চারা নার্সারিতে উৎপাদন ও সংরক্ষণ করেন। এসব চারা তিনি আগ্রহীদের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করেন। ২০১৯ সালে তিনি ৫০ হাজার ঔষধি ও অন্যান্য গাছের চারা আগ্রহী ব্যক্তি ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করেছেন। বিতরণকৃত ঔষধি উদ্ভিদগুলো বিভিন্ন রোগে ব্যবহারের পদ্ধতি সম্পর্কেও তিনি সকলকে জানান। বজ্রপাত প্রতিরোধে তাল বীজ রোপণে জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও উদ্বুদ্ধকরণে শহরে মাইকিং করে জনগণকে তিনি তাল খাওয়ার পর বীজগুলো একটি র্নিদিষ্ট স্থানে ফেলার আহবান জানান। এভাবে তিনি ২০১৮ সালে প্রায় ২ হাজার তালের বীজ সংগ্রহ করেন। সংগৃহীত তাল বীজ তিনি নেত্রকোনা সদর উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী এবং এলাকার যুব ও কিশোর-কিশোরীদের নিয়ে এলাকার বিভিন্ন রাস্তার পাশে ও স্কুল প্রাঙ্গনে রোপণ করেছেন।

20180627_114756-W600-W600

শীতার্থদের পাশে আব্দুল হামিদ কবিরাজ
শীত মৌসুমে আব্দুল হামিদ কবিরাজ দরিদ্র ও অসহায় শীতার্থদের শীতবস্ত্র দিয়ে সহায়তা করেন। আর্ত মানবতার সেবায় এগিয়ে আসার জন্য অবস্থাশালী/স্বচ্ছল শহরবাসীদের আহবান জানিয়ে তিনি শহরের বিভিন্ন এলাকায় ব্যানার স্থাপন করেন এবং ব্যানারের পাশে বাঁশের রেলিং দিয়ে সেখানে পুরনো অব্যবহৃত কাপড়গুলো রেখে যাওয়ার আহবান জানান। অসহায় ব্যক্তিদেরকে সেখান থেকে তাদের প্রয়োজনমত কাপড় সংগ্রহ করে নেয়ার আহবান জানান। তাঁর আহবানে শহরে বেশ সাড়া পাড়ে। দরিদ্র ও অসহায় ব্যক্তিরা সেখান থেকে প্রয়োজনীয় কাপড় সংগ্রহ করে নিয়ে তাদের প্রয়োজন নিবারণ করতে সক্ষম হয়।

DSC00623-W600

ভেষজ ঔষধ সংগ্রাহক ও বিক্রেতা
কবিরাজ আব্দুল হামিদ এর মূল পেশা হল কবিরাজি ভেষজ চিকিৎসক। পেশার তাগিদেই দোকানে তিনি শতাধিক ভেষজ ঔষধ সংরক্ষণ করেন এবং রোগীদের অবস্থা অনুযায়ী সেগুলো দিয়ে চিকিৎসা করেন। অর্জন, আমলকি, হরিতকি, বহেরা, ইসবগুলের ভূষি, তোকমা, পদ্মগলঞ্চি, ওলটকম্বল, শিমূল গাছের শিকড় ও গুড়া এবং ঘৃতকাঞ্চনসহ হরেক রকমের শরবত তৈরির উপকরণ রয়েছে তাঁর দোকানে। প্রতিদিন সকালে ও সন্ধ্যায় মানুষ ভেষজ ঔষধি শরবত খাওয়ার জন্য ভিড় করেন। শরবত তৈরিতে তিনি গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন উপকরণসহ মধু ব্যবহার করেন। ভেষজ ঔষধ বিক্রির আয় দিয়ে তিনি সন্তানদের লেখাপড়া শেখাচ্ছেন (বড় মেয়েকে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার, দ্বিতীয় ছেলে এইচএসসি পাশ করেছে, ছোট ছেলে এবছর এসএসসি পাশ করেছে। মেজ ছেলে (অটিজম) বাবার সাথে ভেষজ ঔষধের ব্যবসা করে।) আব্দুল হামিদ কবিরাজ নিঃস্বার্থভাবে আর্ত মানবতার সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। তিনি নেত্রকোনা শহর পারি দিয়ে এখন কিশোরগঞ্জ শহরে ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধে প্রচারণার জন্য সাইকেলে বেড়িয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি সেখানে শহরবাসীকে ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধের পাশাপাশি আর্ত মানবতার সেবায় এগিয়ে আসার আহবান জানাবেন বলে জানান।

আর্ত মানবতার সেবায় আব্দুল হামিদ কবিরাজ একজন পথ প্রদর্শক। বিভিন্ন ইস্যুতে জনসচেতনতা বৃদ্ধি, পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় এবং মানুষসহ প্রাণীর বিভিন্ন রোগের ভেষজ চিকিৎসায় আব্দুল হামিদ কবিরাজের অবদান বলা বাহুল্য। তাঁর আহবানে সাড়া দিয়ে সকলে আর্ত মানবতার সেবায় ও পরিবেশ সংরক্ষণে এগিয়ে আসলে ডেঙ্গু রোগ যেমন প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে, তেমনি এলাকার প্রাণবৈচিত্র্যও সংরক্ষিত হবে। পাশাপাশি সংরক্ষিত হবে আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং প্রতিষ্ঠিত হবে পারস্পারিক নির্ভরশীল ও আন্তঃনির্ভরশীল বহুত্ববাদী সমাজ, যে সমাজে সকল শ্রেণী ও পেশার মানুষ সমান অধিকার ভোগ করবে।

happy wheels 2

Comments