একজন সুখলালের জীবন সংগ্রাম

একজন সুখলালের জীবন সংগ্রাম

নেত্রকোনা থেকে খাদিজা আক্তার লিটা

রোদে বৃষ্টিতে ভিজে শরীরের রঙ কয়লার মত কালো হয়ে গেছে সুকলাল রবিদাসের (৬৫)। তিনি পেশায় একজন মুছি। ছেলে বেলা গায়ের রঙ কেমন ছিলো এখন আর মনে করতে পারে না। শরীরের রঙ দেখার মতো সময় যেমন নেই! কত বছর ধরে রোদে বসে সুতা সেলাই করছেন তার সঠিক দিনক্ষণ মনে করতে পারেন না এখন। মাঝে মাঝে ভাঙ্গা পুরানো ছাতা নিয়ে বের হন, তবে নিজের জন্য কখনো নতুন ছাতা কেনার কথা ভাবতে পারেননি। সুতা সেলাই করে যা পান তা দিয়ে আগে পরিবারের সবার চাহিদা পূরণ করেন।

IMG_20190807_111455
যাদের ত্যাগে আমরা সভ্য সমাজে মর্যাদা নিয়ে পথ চলতে পারি মুচি সম্প্রদায় তাদের মধ্যে অন্যতম। আমাদের মর্যাদা বাড়াতে যাঁরা রাস্তায় বসে জীবন কাটিয়ে দেন সেই সব শ্রমজীবী দলিত পরিবারগুলোকে নিচু চোখে দেখে আলাদা করে রাখি আমরা। সুখলাল রবিদাস তাদেরই একজন। মুচি সম্প্রদায় যারা মূলত চামড়ার কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকে তাদেরকেই মুচি নামে অভিহিত করা হয়। কিন্তু আমাদের সমাজ এ মুচি শব্দটিকে খুবই অসম্মনজনক মনে করা হয়।
সুখলাল রবিদাস নেত্রকোনা রেল কলনীর বাসিন্দা। এক সময় কসাইয়ের কাজ করতেন। বর্তমানে মুচির কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। গ্রামে গ্রামে ঘুরে জুতা সেলাই ও জুতায় কালি লাগানোর কাজটি করেন বহু বছর ধরে। সেই কাক ডাকা ভোরে গ্রামে গ্রামে ঘুরে যে কয়টা কাজ পান করেন, বিকাল বেলা থেকে বসেন নেত্রকোনা রেল ষ্টেশনে। ৩ মেয়ে ২ ছেলে, স্ত্রীকে নিয়ে ৬ জনের সংসার তাঁর। নিজের কোন জায়গা জমি না থাকায় জীবনের প্রয়োজনেই সারাজীবন রেল কলনীর খাস জমিতে কয়েক হাত জায়গায় টিনের চালা ঘর তুলে বসবাস করেন। ঘরে একটি ছোট চকি আর হাড়ি পাতিল ছাড়া তেমন কোন আসবাবপত্র নেই।

জুতা সেলাই করে এক সময় যা রোজগার করতেন তা দিয়ে কোন রকম সংসার চালাতেন স্ত্রী রেশমি রবিদাস। সুখলাল ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। কিন্তু আর্থিক অসামর্থ্যরে পড়াশুনা বেশিদূর করতে পারেননি। তাই খুব কম বয়সে জীবিকার সন্ধানে কাজে নামতে হয়। নিজের পড়াশুনা না করতে পারার ফলে যে জীবন কাটাতে হচ্ছে, তিনি সবসময় চেয়েছেন তার সন্তানরা যেন সেই জীবন কাটাতে না হয়!

তাঁর স্ত্রী রেশমি রবিদাসের সেই স্বপ্ন থাকায় তিনিও কিছু আয় করার উদ্দেশ্যে অন্যের বাড়িতে রান্নার কাজ শুরু করেন। এভাবে দুইজনে মিলে সংসার চালিয়ে পাঁচ সন্তানকে পড়ানোর ইচ্ছে থাকলেও বড় দুই ছেলেকে ৫ম শ্রেণীর বেশি পড়াশুনা করাতে পারেননি। কারণ স্বামী ও স্ত্রী জীবিকার প্রয়োজনে বাড়ির বাইরে থাকায় মেয়েরা ঘরে থাকলেও কলনী অসৎ সঙ্গের হাত থেকে ছেলেদের বাঁচাতে পারেননি। ছেলেরা স্কুলে যেতে চাইত না। কলনী অধিকাংশ পরিবারের ছেলেরা শিশু বয়সে বিভিন্ন রকম কাজে যুক্ত হয়। তবে এত বাধার মুখে পড়ার পরও বড় মেয়েকে এইচএসসি পাশ করিয়ে বিয়ে দিয়েছেন সুখ লাল রবিদাস। মেঝ মেয়ে এসএসসি পরিক্ষা দিবে, ছোট মেয়ে ৪র্থ শ্রেণীতে পড়ছে।

বর্তমানে তাঁর বড় ছেলে বিয়ে করে নিজে সংসার করছেন। ছোট ছেলে আলাদা থাকে। সব কষ্টের মধ্যে মেয়েদের পড়াশুনা করাতে পেরে সুখ লাল রবিদাস খুব খুশি। রেল কলনীর মতো জায়গায় থেকে মেয়েদের পড়াশুনা করানো বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের সব ক্ষেত্রে বাধা। যখন কেউ শুনে আমরা রবিদাস তখন আমাদের দিকে অন্য চোখে তাকায়, সেই সাথে ঠিকানা যখন লিখি কলনী তখন তো আমাদের দিকে এমনভাবে তাকায় যেন আমাদের ছেলে মেয়েরা স্কুলে ভর্তি না হলেই যেন ভালা হইতো।’ হাজার বাধার মুখে মেয়েদের পড়ানো বিষয়ে তিনি বলে, ‘পড়াশুনা তো মেয়েদেরেই করানো দরকার। এখন কিছু না করলেও জীবনে কোন সময় ঠেকলে কাজে লাগব।’

IMG_20190807_111516
বয়স হয়েছে সুখলাল রবিদাস। আগের মতো জুতা সেলাই উপকরণগুলো নিয়ে এখন আর বেশিদূর নিয়ে যেতে পারেনা। যেটুকু যান তা খুব কষ্ট হয়। সেই সাথে আগের মতো এখন আর মানুষ জুতা সেলাই করে পড়তে চায় না। পূর্বের তুলনায় মানুষের জীবনযাত্রার মান পরিবর্তন হয়েছে। মাথাপিছু ঋণের পরিমান বাড়লেও দরিদ্র পরিবারের লোকেদের পোশাকাশে পরিবর্তন এসেছে। জুতা সেলাই করে বছরে পর বছর পায়ে দেওয়ার দিন এখন আর নেই। তাই সুখলাল রবিদাস এখন শুধু জুতার কালি লাগানো কাজটি করেই কিছু টাকা রোজগার করে থাকেন। সকালে বের হলে বাড়ি ফিরেন সন্ধ্যায়। এতে কোন দিন ১০০ টাকা কোন দিন ১৫০ টাকা রোজগার করেন। সুখলাল রবিদাস যা পান তাই নিয়ে সুখী তিনি। জীবনে শেষদিন পর্যন্ত কাজ করে খেতে চান তিনি। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘কে কি বলল সেটা বড় নয়; আমি সারাজীবন পরিশ্রম করে খাইয়া আইছি, জীবনে শেষ দিন পর্যন্ত পরিশ্রম করেই খাইতে চায়।’

সৎ ও পরিশ্রমী মানুষ হিসেবে এলাকার ছোট বড় সবাই সুখলাল রবিদাসকে শ্রদ্ধা করে। পরিশ্রমী এ সংগ্রামী প্রবীণ ব্যক্তির জীবন মান উন্নয়নে ধলাই পাড়ের কিশোরী সংগঠনের উদ্যোগে বারসিক’র সহায়তায় বিভিন্ন উপকরণ প্রদান করা হয়েছে সম্প্রতি। এসব উপকরণ নিয়েই তিনি জীবন সংগ্রামে সন্মুখপানে এগিয়ে যান প্রতিদিন।

happy wheels 2

Comments