প্রাণ ও প্রকৃতির প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে রাজশাহী ও সাতক্ষীরায় প্রকৃতি বন্ধন
রাজশাহী থেকে মো. শহিদুল ইসলাম এবং সাতক্ষীরা থেকে মননজয় মন্ডল
সপ্তাহ ব্যাপী প্রাণ প্রকৃতির প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সপ্তাহের অংশ গিসেবে আজ (২২ মে) ‘আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য দিবসে’ ‘জাগাও বৈচিত্র্য, থামাও উষ্ণতা, বাঁচাও প্রাণ’ স্লোগানে প্রাণ ও প্রকৃতির প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে র্যালি ও প্রকৃতি বন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বারসিক, বরেন্দ্র শিক্ষা সংস্কৃতি ও বৈচিত্র্য রক্ষা কেন্দ্র-(বিইসিডিপিসি) এবং বরেন্দ্র অঞ্চলের জনসংগঠনগুলো যৌথভাবে রাজশাহী মহানগরীর বড়কুঠী পদ্মা পাড় থেকে প্রাণ ও প্রকৃতির র্যালিটি রাজশাহী জিরো পয়েন্টে এসে প্রকৃতি বন্ধনসহ প্রাণ প্রকৃতির প্রতি সহিংসতা বন্ধের দাবি জানায়।
প্রতিজন অংশগ্রহণকারী কেউ মাছ, কেউ বাঘ, কেউ পেঁচাসহ নানা পশু পাখি, বন্য প্রাণীর মুখোস পড়ে প্রাণ প্রকৃতির হয়ে সহিংসতা বন্ধের দাবি জানান। অংশগ্রহণকারীগণ বলেন, “সমগ্র বাংলাদেশের বুকে বিশাল এবং নানা বৈচিত্র্যসমৃদ্ধ আলাদা বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন বরেন্দ্র অঞ্চল। দেশের ৪৫ জাতিসত্তার মধ্যে দুই তৃতীয়াংশেরও বেশি বসবাস এই অঞ্চলে। কতোইনা বৈচিত্র্যে ভরপুর। কিন্তু দিনে দিনে নানামূখী কারণেই এর বৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। প্রাণের সাথে প্রাণের সহিংসতা, মাটির সাথে, বিলের সাথে, নদীর সাথে, সাংস্কৃতির সাথে সাংস্কৃতির সহিংসতা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে।”
অংশগ্রহণকারীগণ আরও বলেন- পাখি শকুন, বাবুই পাখি, লক্ষী পেঁচা, শামুক ভাঙ্গা/ শামুখ খোল এবং বণ্যপ্রাণী বনবিড়াল, বনপুকুর, বনশুকুর, বেজী, বনখরগোশ ইত্যাদি প্রাণবৈচিত্র্য প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তৃণগুল্ম চিরু, কাঁশ, সর্পগন্ধা, অশ্বগন্ধা, শতমূলী, তাল, খেজুর গাছ দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। বিভিন্ন দেশী প্রজাতির বৃক্ষবৈচিত্র্যও কমে গেছে।” তারা বলেন, “মানুষের নানা মূখী উন্নয়ন কার্যক্রমে প্রাকৃতিক বন কমে যাবার কারণে বিভিন্ন বন্যপ্রাণী ও পাখির আহার এবং বাসস্থান সংকটের মূখে পড়ে গেছে। দিনে দিনে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে আমাদের উদ্ভিদসহ নানা প্রাণবৈচিত্র্য।
প্রকৃতি বন্ধনে প্রাণ ও প্রকৃতির প্রতি সহিংসতা বন্ধে বক্তব্য পাভেল পার্থ বলেন, “সারা বাংলাদেশে দিনে দিনে প্রাণের বৈচিত্র্য কমে যাচ্ছে। বরেন্দ্র অঞ্চলে পদ্মা নদীতে একসময় ঘড়িয়াল থাকলেও বর্তমান তা আর দেখা যায় না। একই সাথে বনবিড়াল, বনকুকুরসহ শকুন সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। প্রকৃতি বিনাসী কার্যক্রমে এই বৈচিত্র্য দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। এর ফলে মানুষই বেশি সংকটের মধ্যে পড়বে।” তিনি আরও বলেন, “বিশ্বের মধ্যে এই প্রথম বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রকৃতি বন্ধন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এখানে প্রতিটি প্রাণ দাঁড়িয়ে তাকে রক্ষার জন্যে মানুষের প্রতি আহবান করছে। তাই আসুন আমরা মানুষ, সকলে মিলে প্রাণ প্রকৃতির প্রতি সহিংসতা বন্ধ করি।”
এ সময় উপস্থিত ছিলেন বারসিক বরেন্দ্র অঞ্চল সমন্বয়কারী শহিদুল ইসলাম, কর্মসূচী কর্মকর্তা জাহিদ আলী, কৃষিবিদ অমৃত কুমার সরকার, গবেষক ইসমত জেরিন এবং বিইসিডিপির সভাপতি জাওয়াদ আহমেদ রাফি, প্রচার সম্পাদক শামীউল শাওনসহ প্রমূখ ব্যক্তিবর্গ। প্রকৃতি বন্ধন ও র্যালিতে বরেন্দ্র অঞ্চলের নানা প্রান্ত থেকে আগত কৃষক, ছাত্র শিক্ষক, উন্নয়ন কর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার ১০০ জন মানুষ অংশগ্রহণ করেন।
অন্যদিকে একইভাবে সাতক্ষীরার শ্যামনগরেও প্রকৃতির প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রকৃতি বন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। অংশগ্রহণকারীরা কেউ কেউ প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানের মুখোশ পড়ে প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। কেউ গাছ, আমি মাটি ও পানির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। কেননা এখান থেকে তারা খাবার সংগ্রহ করে বেঁচে থাকেন। তারা কেউ কেউ বলেন, “আমি পৃথিবীর ক্ষতিকর কার্বন খাই, এবং নির্মল বাতাস প্রবাহিত করে প্রাণ ও প্রকৃতিকে রক্ষা করি।” কেউ বলেন, “আমি পাখি-আমি গাছের প্রতি কৃতজ্ঞ, কারণ গাছ আমার খাবার দেয় ও থাকার জন্য আশ্রয় দেয়।” কেউবা বলেন, “আমি ফসলের ক্ষতিকর পোকা খেয়ে সকলের উপকার করি।” কেউ বলেন, “আমি গরু- আমি ধানের খড়ের প্রতি কৃতজ্ঞ।” এভাবেই গাছ, ধান, মোমাছি, মানুষ, বাঘ, ব্যাঙ, বাঘ, হরিন প্রভৃতির মুখোস পরে প্রতিটি প্রাণ, প্রকৃতির প্রতি আন্ত:সম্পর্ক তুলে ধরে এক ব্যতিক্রমধর্মী প্রকৃতি বন্ধন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক।
আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য দিবস ২০১৭ উপলক্ষে বারসিক ঘোষিত প্রাণ ও প্রকৃতির প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সপ্তাহ উদযাপনে আজ ২২ মে সোমবার সকাল ১০ টায় শ্যামনগর উপজেলা প্রেসক্লাবের সামনে এই কর্মসূচি আয়োজন করা হয়। প্রাণ ও প্রকৃতির প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রকৃতি বন্ধন কর্মসূচির শুভ উদ্বোধন করেন শ্যামনগর উপজেলা সহকারী কমিশনার ভুমি শেখ আবদুল্লাহ সাদীদ। বারসিক কর্মকর্তা মারুফ হোসেন মিলনের সঞ্চালনায় প্রাণ ও প্রকৃতির প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রকৃতি বন্ধন অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন,“ সকল প্রাণের বৈচিত্র্য এবং সাংস্কৃতিক বন্ধনের মাধ্যমে আমরা বেঁচে থাকি। বর্তমান সরকার ও এই পারস্পারিক আন্তঃসম্পর্ক সুরক্ষায় বদ্ধপরিকর। পারস্পারিক আন্তনির্ভরশীলতায় টিকে থাকবে মানুষ, পাখি, মাছ, বাঘ, মাটি, পানি ও গাছ।”
প্রাণ ও প্রকৃতির প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রকৃতি বন্ধন শেষে শ্যামনগর উপজেলা সহকারী কমিশনার ভুমি শেখ আবদুল্লাহ সাদীদ(ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী অফিসার) এর নিকট দুর্যোগ আশ্রয়কেন্দ্র গুলো নারী বান্ধব করা এবং সোতা খালের লবন পানি অপসারণের দাবীতে স্মারকলিপি প্রদান করেন স্থানীয় জনগোষ্ঠী।