আমাদের ভারত সফরের অভিজ্ঞতা

শ্যামনগর, সাতক্ষীরার থেকে গাজী আল ইমরান

বারসিক পরিবারের আমরা ৬ জন সদস্য অর্থাৎ ঢাকা অফিসের এরশাদ আলী, রাজশাহী অফিসের শহিদুল ইসলাম, নেত্রকোনা অফিসের হ্যাপি রায়, মানিকগঞ্জ অফিসের নজরুল ইসলাম শ্যামনগর অফিসের রামকৃষ্ণ জোয়ারদার ও আমি আল ইমরান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগোণা জেলার বারুইপুরে অবস্থিত “পল্লী উন্নয়ন সমিতি বারুইপুর” সংস্থার কমিউনিটি বেজড সোলার এনার্জি প্রকল্পের কাজ দেখা ও অভিজ্ঞতা বিনিময় সফরে অংশগ্রহণ করি। পূর্বে ১৯ বার ভারতে সফর করলেও এবারের অভিজ্ঞতা ছিলো সম্পূর্ণ ভিন্ন। মঙ্গলবার আমরা সকলেই ভারতে প্রবেশ করে সন্ধ্যায় পৌছায় গোসভায়। একই দিন সন্ধ্যায় স্থানীয় হোটেল “লোনা পানিতে” পল্লী উন্নয়ন সমিতি বারুইপুরের পঞ্চায়েত ভিত্তিক ক্ষুদ্র গ্রোথ সেন্টারের টেকনেশিয়ান রাজেশ সরকারসহ আমরা বারসিক পরিবার একটি খসড়া পরিকল্পনা তৈরি করি। একই হোটেলে রাত্রী যাপনের পর পরদিন বুধবার সকাল ১০ টায় নাস্তা সেরে গোসভায় অবস্থিত পল্লী উন্নয়ন সমিতি বারুইপুরের পঞ্চায়েত ভিত্তিক ক্ষুদ্র গ্রোথ সেন্টারে এক আলোচনা ও অভিজ্ঞতা বিনিময় সভায় অংশগ্রহণ করি। আলোচনা সভায় বারসিক পরিবারের ৬ জনসহ পল্লী উন্নয়ন সমিতি বারুইপুরের পঞ্চায়েত ভিত্তিক ক্ষুদ্র গ্রোথ সেন্টারের ইনচার্জ রাজেশ পাউল, টেকনেশিয়াণ রাজেশ সরকারসহ আরো দু’জন টেকনেশিয়ান অংশগ্রহণ করেন। আলোচনা সভায় গ্রোথ সেন্টারে ইনচার্জ রাজেশ পাউল “পল্লী উন্নয়ন সমিতি বারুইপুর”র বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। বিশেষ করে তাদের নিজেদের তৈরি সোলার চালিত হোমলাইট, লন্ঠন ও নিজেদের বিভিন্ন সার্ভিস বিষয়ে আলোচনা করেন। আলোচনা সভায় রাজেশ পাউল বলেন, “আমাদের প্রকল্পের নাম ‘অন্ধকার থেকে আলো’।”

DSC00015

প্রকল্পটি তিনবছর যাবত চলমান। নিয়ম অনুযায়ী সংস্থাটির প্রধান একজন খ্রীষ্টিয় ফাদার। একটি গ্রোথ সেন্টারে তিনি এক নাগাড়ে পাঁচ বছর থাকতে পারবেন এরপর তিনি অন্য গ্রোথ সেন্টারে চলে যাবেন। তবে সকল ধর্মের মানুষ এর সেবা পেতে পারে। প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্য টেকনিশিয়ান তৈরি করা (মহিলা এবং পুরুষ), সচেতনতা মূলক কর্মসূচি (আলোচনা সভা, মেলায় স্টল তৈরি ,স্কুল ক্যাম্পেইন করা, স্কুলে নবায়নযোগ্য জ¦ালানি বিষয়ে বিশেষ ক্লাসের ব্যবস্থা করা, বাড়ি থেকে বাড়ি গিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা)। নারীরা প্রথমে রাজি না হলেও পরে তারা লন্ঠন তৈরি প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করে এবং লন্ঠন তৈরি করে লাভবান হয়েছে। এমনকি অনেকেই লন্ঠনের দোকান দিয়েছে।

আলোচনা সভা শেষে আমরা কিছুক্ষণ লন্ঠন তৈরি প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করি এবং লন্ঠন তৈরি বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা অর্জনের চেষ্টা করি। পরদিন সকাল ৮টায় নছিমন চেপে জটিরামপুর গোসভার উদ্দেশ্যে রওনা হই্ জটিরামপুর পৌছানের পর খেয়াঘাট পর হয়ে সাতজেলিয়া পঞ্চায়েতের সুকমারি গ্রামের কমিউনিটি বেজড সোলার এনার্জি প্রকল্পের কাজ পরিদর্শন করি। বলে রাখা দরকার সাতজেলিয়া একটি দ্বীপের মধ্যে অবস্থিত। সেখানে সোলার পাওয়ার গ্রীড স্থাপন পরিদর্শন করি যেটি সোলারের মাধ্যমে ৩ কেবি ওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। বর্ষার সময় সৌর আলো কম পাওয়ায় একই সাথে স্থাপন করা হয়েছে ওয়াইন্ড টারবাইন। মূলত এটি এমন একটি ঘূর্ণমান যন্ত্র, যা বাতাস থেকে শক্তির রূপান্তর ঘটায়। বাতাসের গতি কাজে লাগিয়ে যান্ত্রিক শক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে বায়ূকল দিয়ে সরাসরি পানি তোলা যায়, কাঠ কাটা যায়, পাথর কাটা যায়। বায়ুকল এভাবে সরাসরি কোনো কাজে ব্যবহার করা হলে তাকে বায়ুকারখানা বলা হয়ে থাকে। আর এটি যেহেতু বায়ু দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে থাকে সুতরাং এটিকে বলা হয় বায়ু জেনারেটর। এই সিস্টেমে উৎপাদিত সৌরবিদ্যুৎ গ্রিডে সরবরাহ করা হয়। ব্যবহারকারী সব সময় গ্রিড থেকেই বিদ্যুৎ পাবেন। গ্রিড থেকে ব্যবহারকারীর প্রাপ্ত বিদ্যুৎ ও গ্রিডে সরবরাহকৃত সোলার বিদ্যুতের ব্যবধান ব্যবহারকারীকে টাকা দিয়ে মেটাতে হবে। যেমন প্রতি বৈদ্যুতিক লাইট ব্যবহারে কমিটির কাছে ৩০ টাকা জমা দিতে হয়। অবশ্যই সেটি রক্ষণের জন্য ব্যাংক হিসাবে সঞ্চয় করা হয়। এসময় সুকমারি গ্রামের নির্বান মন্ডলের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, “আমরা তিন বছর যাবত এই সোলারের বাতি ব্যবহার করে চলেছি। যার মাধ্যমে আমাদের বাচ্চারা লেখাপড়াসহ সকল সান্ধ্যকালীন সকল কাজ করতে পারি। তিন মাস হলো আমাদের গ্রামে বিদ্যুৎ এলেও আমরা বৈদ্যুতিক বাতির চেয়েও সোলারের আলো বেশি ব্যবহার করি। এটাই যেন বেশি বিদ্যুৎ ও পরিবেশবান্ধব।”

20171108_092336

আলোচনা সভার প্রথম দিনে “পল্লী উন্নয়ন সমিতি বারুইপুর” আলোচনার মধ্যে একটি বিষয় খুবই চমকপ্রদ লেগেছে সেটি হলো নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিষয়ে ভারতে আলাদা মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রী রয়েছে। অথচ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে বাংলাদেশ শীর্ষে হলেও এ বিষয়ে আলাদা কোনো মন্ত্রণালয় নেই। অবশ্যই বিষয়টি নিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে আমাদের আলোচনা করা অতি জরুরি বলে মনে করছি। যাই হোক এ অঞ্চলের শুধুমাত্র নবায়নযোগ্য জ্বালানি নয় এখানকার পরিবেশ, নতুন নতুন উদ্ভাবনী, “পল্লী উন্নয়ন সমিতি বারুইপুর”র বিভিন্ন জন সচেতনতা মূলক কর্মসূচি, নারীর জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে তাদের বিভিন্ন কর্মসূচি রয়েছে। তাছাড়া এখানকার বিভিন্ন অভিজ্ঞতা আমাদের কর্ম এলাকার বিভিন্ন স্থানে প্রয়োগের মাধ্যমে এলাকার উন্নয়ন করা সম্ভব হবে বলে মনে করি।

মাঠ পর্যাবেক্ষনের শেষ দিনে গ্রামের বিভিন্ন মানুষের সাথে আলোচনা শেষে একই দিন বিকালে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হই। সন্ধ্যা ৭টায় কলকাতার হাইল্যান্ড পার্ক নামক স্থানে পৌছে আমরা ৫ জনের জন্য একটা রুম নিতে খরচ হল ৭০০ রুপি। পরদিন কিছু কেনা কাটার উদ্দ্যেশ্য রওনা হয় গড়িয়া হাট, বড় বাজার কলকাতার নিউ মার্কেট, কলেজ স্ট্রিট, মারকাস স্ট্রিট, ফ্রী স্কুল স্ট্রিট, সদর স্ট্রিট, মির্জা ঘালিব স্ট্রিট ও তার আশেপাশের বিভিন্ন স্থানে। কলকাতা বাংলাদেশের মতই একটু সস্তা, একটু কম যানজট, মানুষগুলো একটু বেশি পুরনো নয়ত একটু বেশি আধুনিক এই আরকি। প্রথম দেখায় কলকাতাকে আমাদের ঢাকার চেয়ে অনেক বেশি পুরনো আর মলিন লাগতে পারে, কিন্তু একটু খেয়াল করে এর লাইফস্টাইল আর ইতিহাস লক্ষ্য করলে বোঝা যায় যে “শহরটা দারুন”। আমাদের ঢাকার মতো এখানে বড় বড় শপিং মল নেই ঠিকই, কিন্তু ইতিহাসের যে সাক্ষী এই শহরটা যতœ করে আগলে রেখেছে, তা রীতিমত বিস্ময়কর।

ওদের ট্রাফিক সিস্টেম আমাকে অব্যই খুবই মুগ্ধ করেছে। শর্ট ডিস্টেন্স ওরা হেঁটেই পার হয়। টানা রিকশা চলে মার্কেট এরিয়ায় আর সাইকেল রিকশা চলে আবাসিকে। রিকশার বড় রাস্তায় ওঠার অনুমতি নেই তাই ঢাকার মত রিকশায় “শ্যামলী থেকে রিফেলস স্কয়ার” যাওয়া সম্ভব না। এর জন্য ব্যবহার করতে হবে অটো (সিএনজি) অথবা ট্যাক্সি। পৃথিবীর অন্য সব জায়গার মত এখানেও ট্যাক্সি মিটারে যেতে চায় না। এছাড়া আছে প্রশস্ত রাস্তা, এসি বাস, লোকাল বাস, লোকাল ট্রেন, ট্রাম আর মেট্রো (পাতাল ট্রেন)। ট্রাফিক সিগনালও সবাই সুন্দর মেনে চলে। এত কাছের একটা শহর, ভাষাও একই ওদেরকে যদি ট্রাফিক রুলস শেখানো যায়, আমাদেরকে কেন যায় না। আমার মতে, একটা দেশের উন্নতির জন্য অন্যতম ফেক্টর হচ্ছে ট্রাফিক সিস্টেম।

কলকাতায় মোটামোটি সবকিছুর দাম কম হলেও চায়ের দাম তুলনামুলক বেশি মনে হয়েছে আমার কাছে। তবে মাটির খোপে চা খেতে পেরে সেটা খুব বেশি মনে হয় না। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে তাৎক্ষণিকভাবে মাল্টা (মসাম্বি), আনারস, কমলা, আম ইত্যাদির জুস বিক্রি হচ্ছে। তবে বড় বাজারের টক দধি ফাটানোর সাদটা জীবনে ভূলে যাওয়ার নয়, যেটি একগ্লাস খাওয়ার পরেও পুনরায় আবার খেয়েছিলাম। সব কিছু কেনাকাটা পরে লজে রাত্র যাপনের পরে পরদিন সকালে রওনা হই প্রিয় মাতৃভূমির উদ্দেশ্যে।

happy wheels 2

Comments