প্রান্তজনের মাতৃভাষা উদ্যাপন
নেত্রকানা থেকে মো. আলমগীর ও রিকু রানী পাল
মাতৃভাষা একজন মানুষের আত্মপরিচয় ও প্রকাশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। তাই মানুষের কাছে যেসব বিষয় তার প্রাণের মতই প্রিয় মাতৃভাষা তার অন্যতম। মাতৃভাষা শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির আত্মপরিচয় প্রকাশের মাধ্যমই নয় এটি যে কোন জাতিসত্তার একটি শ্রেষ্ঠ স্মারক। পৃথিবীর বুকে একমাত্র দেশ আমাদের প্রিয় এই বাংলাদেশ যার জন্ম ভাষাকে ভিত্তি করে। তাই এই দেশের মানুষের মাতৃভাষার প্রতি রয়েছে এক গভীর ভালোবাসার অনুভুতি ও সংবেদনশীলতা। প্রতিবছর ২১শে ফেব্রুয়ারি যার বর্ণাঢ্য প্রকাশ আমরা দেখতে পাই। প্রচলিতভাবে ২১শে ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। গ্রামে গঞ্জে যেখানে শহীদ মিনার নেই সেখানে কলাগাছ বা বাঁশ দিয়ে অস্থায়ী শহীদ মিনার বানিয়ে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। কিন্তু নেত্রকোনা জেলার আটপাড়া উপজেলার কৃষক, জেলে, কুমার জনগোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষা দিবস উৎযাপনের প্রক্রিয়াটি ছিল মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। তারা তাদের পেশা, চারপাশের সম্পদের গুরুত্ব আর শিশুদের মধ্যে লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ তৈরির মাধ্যমে হিসেবে মাতৃভাষা দিবসকে বেছে নিয়েছেন। তাই গ্রামের এই অবহেলিত শিশুদের মাতৃভাষা উদ্যাপন এলাকার মানুষের মধ্যে এক ধরনের আগ্রহ ও উৎসাহ তৈরি করেছে।
দিয়ারা গ্রামের কিশোর-কিশোরীদের উদ্যোগে গ্রামের মাতৃছায়া একাডেমিতে গ্রামের ৫০জন শিশুদের নিয়ে চিত্রাঙ্গন প্রতিযোগিতা আয়োজন করে। মাতৃভাষা দিবসকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের অনেক জায়গাতেই চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। কিন্তু এখানকার চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতাটি অন্য প্রতিযোগিতা থেকে এই কারণে ভিন্ন যে এখানে ছবি আকার জন্য শিশুরা বাজারের রঙ ব্যবহার করেনি। এলাকার সহজলভ্য গােেছর পাতা, ফল, ফসল, ফুলের রঙকে রঙ হিসেবে ব্যবহার করে ছবি এঁকেছে। কেউবা কোন রঙ ব্যবহার না করে এসব উপকরণ দিয়েই বাংলা অক্ষর লেখাসহ সুদৃশ্য বিভিন্ন জিনিস তৈরি করে। যেন সকলকে জানাতে চেয়েছেন আমাদের যা দরকার তা তাদের চারপাশেই আছে। প্রয়োজন মমতা আর ভালোবাসা দিয়ে সেগুলোকে ব্যবহার করা।
বাখরপুর গ্রামে বারসিক ও কুমার সম্প্রদায়ের সহযোতিায় পরিচালিত শিশু বিকাশ কেন্দ্রর উদ্যোগে কুমার জনগোষ্ঠীর শিশুরা মাটি দিয়ে তৈরি করেছেন বাংলা বিভিন্ন ভাষার অক্ষর। লিখেছেন বাঙালির আত্মপরিচয়ের ভাষা ও শ্লোগান একুশ আমার অহঙ্কার। নাচ, গান ও কবিতা পাঠর ভেতর দিয়ে কুমার শিশুরা মাতৃভষা দিবসকে উদ্যান করে। এই উদ্যাপন প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়েই শিশুরা যেন জানাতে চেয়েছে মাটি দিয়ে তৈরিকৃত তৈজসপত্র একটি শিল্প, কত মমতা আর ভালোবাসা দিয়ে সেটি তৈরি হয়।
আটপাড়া রবিদাস সম্প্রদায়ের শিশুরা তাদের শিশু বিকাশ কেন্দ্রে নাচ, গান, শহীদ মিনারের অঙ্কনের ভেতর দিয়ে মাতৃভাষা দিবসকে উদ্যাপন করে। রবিদাস সম্প্রদায়ের শিশুদের নিটল সাদা চোখ আর দৃপ্ত কন্ঠের উপস্থাপনাগুলো প্রিয় দেশ আর মাতৃভাষার এক প্রতি গভীর ভালোবাসার প্রকাশ। শুধু বুঝতে পারেনা এই দেশটা তাকে তার মত করে ভালোবাসেনা কেন!
শুদ্ধভাবে মায়ের ভাষাকে জানি, এই শ্লোগানকে সামনে রেখে মাতৃভাষা দিবস উদযাপন করে রামেশ্বরপুর গ্রামের ‘আমরা করবো জয়’ নামের কিশোরী সংগঠন। মাতৃভাষা দিবসকে সামনে রেখে তারা স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে ‘শুদ্ধভাবে বাংলা ভাষা লেখা’ প্রতিযোগিতা ও আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এতে আলোচক ও বিচারক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় কলেজের বাংলার শিক্ষক মহোদয়।
এছাড়া এই এলাকায় আটাপাড়া উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে যথাযথ মর্যাদায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা উদযাপন করা হয়। দিবসটি উপলক্ষে উপজেলা চত্ত্বরে আল্পনা অঙ্কন, র্যালি, শিশুদের হস্ত লেখা প্রতিযোগিতা, আলোচনাসহ ২৩টি স্কুলের শিক্ষার্থীদের নিয়ে কবিতা আবৃতি প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়।