একটি কৃষক সংগঠনের সফলতা

সিংগাইর মানিকগঞ্জ থেকে শাহীনুর রহামান
সিংগাইর উপজেলার বলধারা ইউনিয়নের ছোট একটি গ্রাম কাস্তা। গ্রামটিতে খুব অল্প সংখ্যক মানুষের বাস। ইউনিয়ন পরিষদের তথ্য মতে, গ্রামটিতে ১১৭ টি পরিবারের ৫৪৬ জন ভুমিহীন, প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র মানুষ বসবাস করেন। গ্রামটিতে হিন্দু মসুলমান দুটি ধর্মের মানুষের সামাজিক সম্প্রীতির মধ্য দিয়ে বৈচিত্র্যময় পেশাজীবী মানুষের সহবস্থান রয়েছে। তবে গ্রামের অধিকাংশ মানুষের প্রধান পেশা কৃষি। কৃষি কাজকে উপজীব্য করেই তারা জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। কৃষি কাজ করার জন্য গ্রামের পশ্চিম পাশে একটি ফসলের মাঠ রয়েছে যা প্রসিদ্ধ ধারার চক নামে পরিচিত। গ্রামের দক্ষিণপাশ দিয়ে কালিগঙ্গা নদী রয়েছে। এই নদীর পানিই কৃষি জমিতে ব্যবহার হয়ে থাকে। গ্রামটিতে বেসরকারি উন্নয়ন গবেষণা সংস্থা বারসিক ২০০৯ সালে কৃষি অধিকার কর্মসূচি প্রকল্পের আওতায় প্রাথমিকভাবে ব্যক্তিগত সম্পর্ক উন্নয়ন ও উঠান বৈঠকের মাধ্যমে গ্রামীণ মানুষের জীবনাচরণ, লোকায়াত চর্চা অনুসন্ধান, জীবন জীবিকায় প্রাকৃতিক সম্পদের প্রভাব ও কৃষিভিত্তিক জীবন জীবিকার তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে কাজ শুরু করে।

বিভিন্ন তথ্য আদান প্রদানের মধ্য দিয়ে গ্রামের মানুষের সাথে বারসিক কর্মকর্তাদের ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়। বারসিক নিয়মিত যোগাযোগের মাধ্যমে গ্রামের জনগোষ্ঠীর জীবন জীবিকাকে প্রভাবিত করে এমন কিছু সমস্যা নিবিড়ভাবে জানা বোঝার চেষ্টা করে। বারসিক কর্মকর্তার সহায়তার মাধ্যমে গ্রামের মানুষ নিজেদের কিছু সমস্যা চিহ্নিত করতে করেন। তারা মনে করেন, সমস্যাগুলো এককভাবে সমাধান করা সম্ভব নয়। তাই তারা সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য নিজেদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তারই ধারাবাহিকতায় ২০০৯ সালের ৩০ মে কৃষাণি ভানু রায়কে সভাপতি ও কৃৃষাণি মর্জিনা বেগমকে সাধারণ সম্পাদক করে ৫৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি কৃষক সংগঠন তৈরি করেন। যে সংগঠনটি কাস্তা বারোওয়ারি কৃষক কৃষাণি সংগঠন নামে পরিচিত। সংগঠনের কাঠামো তৈরি হওয়ার পর নেতৃত্ব উন্নয়ন, সংগঠন ব্যবস্থাপনা, নারী নেতৃত্ব উন্নয়ন প্রশিক্ষণ দিয়ে সাংগঠনিক দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করার চেষ্টা করে বারসিক।

সংগঠিত জনগোষ্টীর জীবন মান উন্নয়নে বারসিক যৌথভাবে স্থানীয় জাতের বীজ মেলা, নিরাপদ খাদ্যর উৎস চিহ্নিতকরণে অচাষকৃত উদ্ভিদের পাড়া মেলা, পিঠা উৎসব, বিশ^ গ্রামীণ নারী দিবস, আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস, ধানজাত গবেষণা কার্যক্রম, বোরো ও আমন মৌসুমের মাঠ দিবস উদযাপন, কেঁচো সার তৈরি, জৈব বালাইনাশক তৈরি, কবিরাজ কর্মশালা ও সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন তথ্য বিনিময়ের মাধ্যমে গ্রামের মানুষকে সহায়তা করে। তাছাড়া সরকারি ও বেসরকারি সেবাদানকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে সংলাপ আয়োজনের মাধ্যমে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, উপজেলা কৃষি অফিস, বিএডিসি, প্রাণি সম্পদ অধিদপ্তর, কমিউনিটি ক্লিনিক, কর্মকর্তাদের সাথে সংগঠনের নেতৃত্ব পর্যায়ের মানুষের সাথে সম্পর্ক তৈরি হয়। বিভিন্ন সেবাদানকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পর্ক তৈরি হওয়ার কারণে সংগঠন তৈরির পর থেকেই সংগঠনের সদস্যদের মধ্যে ধীরে ধীরে নেতৃত্বের বিকাশ ঘটতে থাকে। বর্তমানে সংগঠনে ৬০টি পরিবারের ৫১ জন নারী ও ৪৩ জন পুরুষ সদস্য নিয়ে মোট সদস্য সংখ্যা ৯৪ জন সদস্য নিয়ে একটি শক্তিশালী কৃষক সংগঠনে পরিণত হয়েছে। এই ঐক্যবদ্ধ শক্তি কাজে লাগিয়ে যৗথ উদ্যোগ বাস্তবায়নের মাধ্যমে কিছু সফলতা অর্জন করেন।

যৌথ উদ্যোগ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তারা নিয়মিত সংগঠনের মাসিক সভা আয়োজনের মাধ্যমে সমস্যা চিহ্নিত করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও পরিকল্পনা তৈরি করেন। সিদ্ধান্ত গ্রহন প্রক্রিয়ায় নারী পুরুষের সমান মতামতের গুরুত্ব দিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার জন্য উদ্যেগ গ্রহণ করেন। নিজেদের অর্থনেতিক সমৃদ্ধি উন্নয়নের জন্য পরিববারভিত্তিক বসতবাড়ি বাগানে সবজি চাষ, গরু ছাগল, হাঁস-মুরগি পালন করছেন। এর মধ্য দিয়ে নারীর পারিবারিক মর্যাদা অনেকাংশে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাছাড়া জলবায়ূ সংকট নিরসনে নারী পুরুষ উভয় পারষ্পারিক বীজ বিনিময় ও বীজ সংরক্ষণের জন্য বীজবাড়ি তৈরি ও এলাকা উপযোগী ধান জাত গবেষণা কার্যক্রম, মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা ও নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে কেঁচো সার তৈরি করে বাজারনির্ভরতা কমাতে সক্ষম হচ্ছেন। নিয়মিত আলোচনার মাধ্যমে নারীর প্রতি সহিংসতা, বাল্য বিবাহ রোধ অনেকটা ভূমিক রাখছে। অন্যদিকে যৌথ উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য সংগঠনের নিজস্ব অর্থ তহবিল তৈরিতে মাসিক সঞ্চয়ের কার্যক্রম গ্রহণ করে ব্যাংক একাউন্ট করে সঞ্চয় বৃদ্ধি করছেন। প্রাণ প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সদস্যদের পারিবারিকভাবে বৈচিত্র্যয়ময় বৃক্ষ রোপণ ও রাস্তার ধারে তাল খেজুর বীজ বপন গ্রামের মানুষদের উৎসাহ বাড়াচ্ছে। বিশেষ করে সংগঠনের সদস্যদের মধ্যে বৈশি^ক মহামারি করোনার সময় সংগঠনের সদস্যদের মধ্যে সাংগঠনিকভাবে যৌথ উদ্যোগ অধিকাংশ মানুষকে প্রভাবিত করেছে। মহামারি করোনায় সংগঠনের উদ্যোগে জনগোষ্ঠীর মধ্যে মাস্ক বিতরণ, ইউনিয়ন পরিষদ থেকে আর্থিক সহযোগিতা , বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতা প্রাপ্তিতে সহায়তা করার মাধ্যমে গ্রামের মধ্যে একটি উপকারি সংগঠন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।


গ্রামীণ মানুেেষর যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও কৃষিপণ্য পরিবহন সহজকরণের লক্ষ্যে ২০১৫ সালে ইউনিয়ন পরিষদ ও (বিএডিসি) সেচ বিভাগে স্মারকলিপি প্রদান করার মাধ্যমে কাস্তা স্বল্পনন্দপুর হাটিপাড়া, মানিকগঞ্জ সদরের একটি সেতু তৈরি হয়েছে। এই সেতু নির্মাণ হওয়ার মধ্য দিয়ে গ্রামের মানুষ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হয়েছে এবং সহজেই কৃষিপণ্য বাজারে নিতে পারেন এবং তাদের পরিবহন ব্যয় কমেছে।
এছাড়াও প্রাকৃতিক জলাশয় সংরক্ষণ ও কৃষিপ্রতিবেশ রক্ষায় খাল খননের জন্য ২০২১ সালে সাংগঠনিকভাবে সরকারের (বিএডিসি) সেচ বিভাগে আবেদনপত্র প্রাদনের মাধ্যমে ১০০০ মিটার মজা খাল খননের মাধ্যমে কৃষিজমিতে পানি প্রবেশ এর ব্যাবস্থা হয়েছে।

সংগঠনের অর্জন সম্পর্কে সংগঠনের সভাপতি ভানু রায় জানান, গ্রামীণ মানুষের সমস্যা সমাধানে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে আমাদের কৃষক সংগঠন। আমরা সংগঠনের মাধ্যমে একতাবদ্ধ আছি বলে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও আমাদের মূল্যায়ন করে। সংগঠনের সফলতা তুলে ধরে সংগঠনের নির্বাহী সদস্য আব্দুল আলীম জানান, আমাদের সফলতার পেছনে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বারসিক’র অবদান রয়েছে। আমরা বারসিক’র নিকট থেকে বিভিন্ন তথ্য প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আমদের দক্ষতা তৈরি হয়। বারসিক’র সহযোগিতায় আমরা সংগঠনকে আরো গতিশীল রাখতে রাখতে চাই এবং সমাজ পরিবর্তনে ভূমিকার রাখতে চাই।

happy wheels 2

Comments