গবাদি পশুর খাদ্য চাহিদা মিটাচ্ছে হেলেঞ্চা
নেত্রকোনা, কলমাকান্দা থেকে অর্পণা ঘাগ্রা
বর্ষা শুরুর সাথে সাথে পাহাড়ি ঢলে হাওরের ফসলী জমি, গোচারণের মাঠ জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। শুরু হয়ে গেছে গবাদি পশুর খাদ্য সংকট। এই সংকট মোকাবেলায় হাওরাঞ্চলের গবাদি পশুর মালিকেরা গো খাদ্যের জন্য ঘাসের বিকল্প হিসেবে হেলেঞ্চা (এসডু) ব্যবহার করছেন।
হেলেঞ্চা একটি সহজলভ্য অচাষকৃত উদ্ভিদ। গ্রামীণ জনপদের সর্বত্রই (পুকুর, ডোবা, খাল, বিল, নদী, বসতভিটের চারপাশ, রাস্তার ধার প্রভৃতি) এটি পাওয়া যায় এবং ছোট বড় সবার কাছেই এটি পরিচিত। জল ও স্থল উভয় স্থানেই এটি জন্মে। তবে জলে এটি দ্রুত বাড়ে। এর আগা কেটে ব্যবহার করার পর চারপাশ দিয়ে আরো ডালপালা গজায়। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কাছে অচাষকৃত শাক হিসেবে এটি বেশ জনপ্রিয়। তবে গো খাদ্য হিসেবে হাওরাঞ্চলের জনগোষ্ঠীকেই বেশি ব্যবহার করতে দেখা যায়। কারণ হাওরে বছরের ছয়-সাত মাস পর্যন্ত ফসলী জমি, নদীর কিনার, রাস্তার ধারে, বসতভিটের চারপাশ জলে নিমজ্জিত থাকে। এই সময় গরু চরানোর মত কোন জায়গা থাকে না। প্রায় প্রতিটি কৃষকই উঠোনে বা গোয়াল ঘরেই সারাদিন ধরে গরুগুলোকে বেঁেধ রাখে। যাদের সামর্থ্য আছে তারা বোরো ফসলের খড় মজুদ করে রাখে এবং ছয় থেকে সাত মাস যাবৎ শুকনো খড় খাওয়ায়। কিন্তু যাদের সামর্থ্য নেই, যারা ধান উৎপাদন করতে পারেন না তাদের গো খাদ্যের অন্যতম উৎস হচ্ছে হেলেঞ্চা।
গাভী গরুর জন্য হেলেঞ্চা খাওয়ালে গাভী বেশি পরিমাণে দুধ দেয়। এতে পানির পরিমাণ বেশি আছে বলে গরমে এটি গরুর শরীর ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করে। এর পুষ্টিগুণও অনেক বলে জানান কলমাকান্দার কৃষক রহিম মিয়া। তিনি শুধুমাত্র গরুর জন্যই সংগ্রহ করেন না বরং বাড়িতে হেলেঞ্চা নিয়ে গেলে তার স্ত্রী এই উদ্ভিদের কচি ডোগা ও পাতা রান্না করে সবাইকে খাওয়ান বলে তিনি জানান।
কলমাকান্দা ইউনিয়নের কুয়ারপুর গ্রামের কৃষাণী অজুফা বেগমের একটি ষাড় আছে। গরুর জন্য ঘাস সংকট থাকা স্বত্ত্বেও তারা প্রতিবছর গরু পালন করেন। একটি বিক্রি হয়ে গেলেও আরেকটি ক্রয় করেন। এত কষ্ট করে গরু পালন করার উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি বলেন “গরু পাইলা আমরা সংসারের উন্নতি করি, গরু বিক্রি করে ঘর বানাইছি, এখন যে একটি ষাড় গরু আছে তা বিক্রি কইরা একটি অটো রিক্সা কিনবো। রিক্সা কিনতে পারলে আমার স্বামীকে ঠেলাগাড়ী টানার কাজ করতে হইবোনা।” তিনি আরও বলেন, “এই কাজটি অনেক কষ্টের কাজ। অটো রিক্সা চালাইলে কষ্ট একটু কম হইব। কোরবানি ঈদের সময় একটি গরু আমরা ৩০-৪০ হাজার টাকায় বিক্রি করি। এই টাকা ও নিজের কিছু জমানো টাকা দিয়া নিজের উন্নতি করি।” অজুফা বেগম নিজেও ষাড়কে হেলেঞ্চা খাওয়ান বলে জানান।
তিনি জানান, দিনমজুর স্বামী প্রতিদিন সকালে কাজে যাওয়ার পূর্বে এক-দুই খাঁচা পরিমাণ হেলেঞ্চা সংগ্রহ করেন। তা খেয়েই গরুর সারাদিন কেটে যায়। আবার দিন শেষে কাজ থেকে ফিরে আসার পর সারা রাতের জন্য সেই পরিমাণ হেলেঞ্চা সংগ্রহ করেন। তবে মাঝে মাঝে কিছু কিছু পরিমাণ খড় ক্রয় করেন বলে জানান। মণপ্রতি খড়ের মূল্য ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। খড় সব সময় কিনতেও পাওয়া যায় না। তাই হেলেঞ্চাই একমাত্র ভরসা তাঁর। সারাবছর প্রাকৃতিক উৎসের উপর নির্ভর করেই তাদেরকে গরু পালন করতে হয়।
শুধু গরু খাবার হিসেবেই নয় বরং প্রকৃতির একটি অন্যতম উপাদান হেলেঞ্চা উদ্ভিদের যতœ, পরিচর্যা করা আমাদের সবার কর্তব্য। হেলেঞ্চা একধারে গবাদি পশু ও মানুষের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অজুফা বেগম হেলেঞ্চা সংরক্ষণ করে রাখেন শুধুমাত্র গরুর খাদ্য মজুত হিসেবে নয় বরং প্রকৃতিতে ভারসাম্য রাখার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখার জন্য।