সকল প্রাণে মিলুক প্রাণ
ঢাকা থেকে ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল
খাদ্য আমাদের জীবনের সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য প্রয়োজন। তাই পৃথিবীর জন্মের পর থেকে মানুষ খাদ্যের জন্য সংগ্রাম করেছে-সংগ্রাম করেছে বেঁচে থাকার জন্য। আদিম সমাজে খাদ্যের জন্য তাকে জীবন বাজি ধরে বন্যপ্রাণীর সাথে লড়াই করতে হয়েছে। মানুষ খাদ্যের নিশ্চয়তার জন্য জন্ম দিয়েছে কৃষি ব্যবস্থার। প্রকৃতির ফুল, ফল, শস্য, মৎস, পশু সকল কিছুকেই তার খাদ্য তালিকায় জায়গা করে দিয়েছে। কিন্তু সেই খাদ্য প্রাণগুলোকে আজ মানুষই গলা টিপে হত্যা করছে। প্রাণকে আর প্রকৃতিকে আজ শ্রদ্ধা না করে তাকে প্রতি মূহুর্তে নির্যাতন করা হচ্ছে। খাদ্য আর মানুষের খাদ্যাভ্যাসের এক ব্যাপক বৈচিত্র্য আমরা সর্বত্র লক্ষ্য করে থাকি। এই বৈচিত্র্যকে আমরা যেভাবে দেখি কিন্তু মানুষ ও প্রাণ প্রকৃতির আন্তঃনির্ভশীলতাকে তেমনভাবে দেখার চেষ্টা করি না। আমরা গাছ থেকে ফল চাই আবার ফলটা বিষমুক্ত চাই কিন্তু গাছের খাদ্যের নিশ্চয়তা আমরা দিতে পারছি কি? আমরা নদী থেকে মাছ চাই বিষমুক্ত মাছ কিন্তু নদীর খাবার বা মাছের খাবারের কোন নিশ্চয়তা বা নিরাপত্তা কি আমরা দিতে পারছি? এক কথায় পারছি না।
পৃথিবীতে প্রাণ ও প্রকৃতির বৈচিত্র্যময় সম্পর্ক বিদ্যমান এবং একে অপরের উপর পুরোপুরিই নিভরশীল। প্রকৃতির ভেতর মানুষই খাদ্যের উপর শতভাগ অন্যের (প্রাণীসম্পদ, বৃক্ষ-লতা, শস্য, মৃত্তিকা) উপর নির্ভরশীল। সুতরাং মানুষের প্রয়োজনেই পৃথিবীর সকল প্রাণের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। খাদ্য শুধু মানুষের জন্য নয়। যে বৃক্ষ মানুষকে অক্সিজেন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখে সেই বৃক্ষের খাদ্যের নিশ্চয়তাও সম গুরুত্বপূর্ণ। তাই “সকল প্রাণের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা” একটি মৌলিক দায়িত্ব হিসেবে আমাদের সামনে প্রতীয়মান হয়।
প্রখ্যাত নিসর্গী ও লেখক অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা গত ১১ জুন, ২০১৬, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)’র কার্যালয়ে সকল প্রাণের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের দীর্ঘমেয়াদী কর্মসূচির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করে তার আলোচনায় বলেন, “আমরা সভ্যতার এক সংকটময় মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছি। সকল ধর্মেই সকল প্রাণের নিরাপত্তা ও ভালোবাসার কথা আছে। কিন্তু আমরা মানুষ হিসেবে প্রকৃতির অন্য প্রাণসত্তাকে গণ্য করছি না। প্রকৃতির জীব ও জড় সকল সত্তার প্রতিই আজ আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হবে।” তিনি বলেন, “মানব প্রজাতি ও সভ্যতা টিকে থাকার স্বার্থেই আজ সকলের খাদ্য নিরাপত্তার দাবি তুলতে হবে। এমন একটি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে যেখানে সকলেই সকলকে নিয়ে সমানভাবে টিকে থাকতে পারে।”
এ বিষয়ে বিশিষ্ট চিকিৎসক ও পরিবেশ আন্দোলন নেতা ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, “আমরা প্রাচীন যুগ থেকেই মনুষ্য খাদ্য নিয়েই চিন্তিত। আমরা যখনি খাদ্যের কথা বলি, তখন কেবলমাত্র মানুষের খাদ্য ও পানীয় নিয়েই কথা বলি। বাদ থেকে যায় পাখি, মাছ, গাছ, কেঁচোসহ প্রকৃতির অন্যান্য প্রাণসত্তার কথা। এমনকি নিরাপদ খাদ্য ও খাদ্য নিরাপত্তার প্রসঙ্গেও বাদ থেকে যায় মাটি, জল, অরণ্য, পাহাড়ের খাদ্য নিরাপত্তার কথা।” ষাটের দশকে প্রবর্তিত রাসায়নিক সার, বিষ, যন্ত্রচালিত সেচ ও উচ্চফলনশীল বীজের মাধ্যমে প্রবর্তিত ‘সবুজ বিপ্লবের’ মূল চিন্তাই ছিল কেবলমাত্র মানুষের জন্য অধিক হারে খাদ্য উৎপাদন। সেই খাদ্য উৎপাদন করতে গিয়ে মাটি, পানি ও গাছের শরীরে ঢালতে হয়েছে বিপদজনক রাসায়নিক বিষ। খাদ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে মজুত প্রক্রিয়াজতকরণ সকল স্তরে প্রচলন ঘটেছে হরমোন, কার্বাইড কি ফরমালিনের মত স্বাস্থ্যবিনাশী রাসায়নিকের। প্রকৃতি থেকে কেঁচো, শামুক, ব্যাঙ, কুঁচে, মাকড়সা, মৌমাছি, মাছ ও পাখিদের তাড়িয়ে আজ দাঁড়িয়েছে প্রকান্ড এক ‘খাদ্য কারখানা’ ও একতরফা বহুজাতিক বাণিজ্য। কেবলমাত্র মানুষের জন্য খাদ্য উৎপাদন করতে গিয়ে প্রকৃতির অপরাপর প্রাণসত্তার খাদ্যকে বিষাক্ত ও নির্মূল করা হচ্ছে।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও অধ্যাপক দেবী শর্মা বলেন, “আমরা অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়ে আজ মরতে বসেছি। আগামী প্রজন্ম এর থেকে আরো বড় বিপর্যয়ের মধ্যে পড়তে যাচ্ছে। এর প্রধান কারণ হলো প্রকৃতির খাদ্যজালে তৈরি হয়েছে চরম বিশৃংখলা ও খাদ্য সংকট। মাটি ও পানির স্বাস্থ্য ঠিক না থাকলে, তাদের পর্যাপ্ত খাদ্যের যোগান না থাকলে কীভাবে মানুষসহ প্রকৃতির অপরাপর সদস্যদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে? আজ তাই প্রকৃতিতে সর্বত্র, সকল সদস্যই খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় পড়তে বাধ্য হয়েছে।”
প্রতিবেশগত, প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট বিপর্যয়ের পাশাপাশি সাম্প্রতিক জলবায়ু সংকটের এই সময়ে এই খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা আরো চরম ও জটিল আকার ধারণ করছে। এটি আজ স্পষ্ট হয়েছে, শুধুমাত্র মানুষের একার জন্য কোনো খাদ্য কোনোভাবেই নিরাপদ হতে পারে না এবং প্রকতির অপরাপর সদস্যদের বাদ রেখে কোনোভাবেই মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হতে পারে না। তাই আজ আমাদের সকলকেই মানুষসহ প্রকৃতির সকল প্রাণের জন্যই খাদ্য নিরাপত্তার দাবি তোলা জরুরি। আর সকলের কাংখিত ও নিরাপদ খাদ্যের যোগফলই খাদ্য নিরাপত্তার পরিস্থিতি তৈরি করবে।
খাদ্য নিরাপত্তা এখনও পর্যন্ত একটি সকলের বোঝার মতো ধারণা নয়। একটি দেশের খাদ্য উৎপাদন ক্ষমতাকে খাদ্য নিরাপত্তা বোঝায় না। বিশ্ব খাদ্য উৎপাদন, বাণিজ্য নীতি, বাণিজ্য সম্পর্কিত চুক্তি, কৃষি সম্পর্কিত আইন ও নীতি, আয় সংক্রান্ত ধারা এবং সামাজিক নিরাপত্তাসমূহ সবই খাদ্য নিরাপত্তার সাথে সম্পর্কিত। এদেশে সমানে খাদ্য উৎপাদনের প্রাকৃতিক ভূমি কৃষি, জুমের জমিন, চারণভূমি ও জলাশয় দিনদিন দখল হয়ে যাচ্ছে। খাদ্য চাহিদা মেটাতে তৈরি হচ্ছে বহুজাতিক খাদ্য বাজার এবং চুক্তিভিত্তিক কৃষি খামার। ‘আধুনিক পদ্ধতিতে’ অতিরিক্ত ফসল উৎপাদনের ফলে মাটির পুষ্টি উপাদান দিন দিন কমে যাচ্ছে। এ কারণে মাটির পুষ্টি চাহিদাও বেড়ে যাচ্ছে আনুপাতিক হারে। তৈরি হচ্ছে নানাবিধ স্বাস্থ্যগত ও প্রতিবেশগত সমস্যা। তারপরও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের একমাত্র রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি ও দর্শন কেবলমাত্র মানুষের জন্য অধিক খাদ্য উৎপাদন।
খাদ্য নিরাপত্তা বা নিরাপদ খাদ্য যেটাই বলি না কেন আজকে সবচে’ বড় শিক্ষাই হলো প্রকৃতিকে প্রকৃত রাখতে হবে আর আমাদের প্রাণ ও প্রকৃতির উপর নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। তাই আসুন প্রাণ-প্রকৃতির বৈচিত্র্য ও আন্তঃনির্ভশীলতাকে সম্মান ও রক্ষা করি আর এই পৃথিবীকে বাসযোগ্য করি।
(লেখাটি ১১ জুন, ২০১৬ তারিখে অনুষ্ঠিত পবা ও বারসিকের গোলটেবিল সংলাগের পাভেল পার্থ পঠিত ধারণাপত্রের সহযোগিতায় এবং সিলভানুস লামিনের সম্পাদনায় তৈরি হয়েছে)