নদীগুলোর স্বাভাবিক প্রবহমানতা নিশ্চিত করতে হবে

মানিকগঞ্জ থেকে বিমল চন্দ্র রায়
‘নদী র্বাচায় প্রাণ ও প্রকৃতি, নদীর জীবন রক্ষা চাই’-এই স্লোগানকে সামনে রেখে মানিকগঞ্জের ১১টি স্থানীয় ও জাতীয় নদীর প্রবাহ অব্যাহত রাখার দাবিতে মানিকগঞ্জ এ প্রথম নদী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৭ সালে। এই নদী সম্মেলনের মাধ্যমে মানিকগঞ্জের নদীগুলোর সামগ্রিক অবস্থান তুলে ধরা হয়। স্থানীয় নদী ক্ষিরাই, মনলোকখালী, কান্তাবতী, মন্দা, ভূবনেশ্বর, কালিগঙ্গা, ধলেশ্বরী, ইচ্ছামতি, গাজীখালী আর জাতীয় নদী পদ্মা ও যমুনা জেলায় ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আসছে।


পদ্মা নদী জেলার শিবালয় ও হরিরামপুর উপজেলার পাশ দিয়ে নানান ধ্বংসলীলা করে প্রবাহিত হয়ে যাচ্ছে। যমুনা নদী দৌলতপুর ও শিবালয় উপজেলার পাশ দিয়ে একইভাবে বাড়িঘর, দোকান, ব্যবসা ও সামজিক প্রতিষ্ঠান কৃষিজমি গ্রাস করে যাচ্ছে। যমুনা নদী শিবালয় উপজেলার আরিচা পয়েন্টে পদ্মা নদীর সাথে মিলিত হয়ে পদ্মা নদী নামে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে আসছে। এই নদীগুলোর তীর ব্যাপক ভাঙনের ফলে নদীর গভীরতা কমে গিয়ে চরাঞ্চলের সৃষ্টি করছে। ফলশ্রæতিতে মানিকগঞ্জের ভূগোলিক ও মানুষের আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন ঘটছে।


স্থানীয় নদীগুলোর অবস্থান ভিন্ন। এ নদীগুলোর প্রধান উৎস যমুনা নদী। যমুনা নদীর বিভিন্ন ধারা জেলার ভিতর দিয়ে ছোট নদী সৃষ্টি করেছে। বৈশিষ্ট্যগত কারণে যমুনা নদীর প্রধান ধারা ধলেশ্বরী ও কালিগঙ্গা নদীর তীরবর্তী জনবসতি ভাঙনের শিকার হচ্ছে। এই নদীগুলোর জলধারার প্রবাহ প্লাবন সক্ষমতা কম। তাই ভাঙনের ফলশ্রæতিতে নদীর গভীরতা কমে চরাঞ্চল সৃষ্টি হয়েছে। দীর্ঘদিন এই অবস্থা চলার ফলে নদীগুলো খালে বা নালায় পরিণত হয়েছে। নদীপাড়সমূহ কৃষি জমিতে ব্যবহৃত হচ্ছে। সবচেয়ে করুণ পরিণতি হয়েছে জেলার পাঁচটি উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন জনপদ দিয়ে প্রবাহিত নদী ধলেশ্বরীর। বিশেষ করে তিল্লিমুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তিনটি উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের শতাধিক গ্রামের কৃষিসহ অন্যান্য কাজের উন্মুক্ত জলধারা দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ হয়ে যায় আছে। ফলশ্রæতিতে ভূ-গর্ভস্থ জল দিয়ে তাদের সকল ধরনের কৃষিজ, প্রাণীজ ও মানুষের দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন। ভূ-গর্ভস্থ জলের ব্যাপক ব্যবহারে নলকূপসমূহে আয়রন দৃশ্যমান হয়েছে। আর্সেনিক আছে কিনা পরীক্ষার অভাবে মানুষ জানতে পারছেন না। তারপরও বছরের পর বছর এই জল ব্যবহার করছেন তারা। ফলশ্রæতিতে নানান স্বাস্থ্য জটিলতায় ভুগতে হয়েছে তাদেরকে।


এসব নদীকে রক্ষা এবং এলাকার মৃত প্রায় স্থানীয় নদীগুলোকে বাঁচানোরা জন্য বারসিক এবং এলাকার স্থানীয় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো যৌথভাবে নদী খননের দাবিতে গ্রামসভা, মতবিনিময় সভা, মানববন্ধন, সমাবেশ, সাংবাদিক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সাথে মতবিনিময় পরিচালনা করে আসছে। এলাকার পরিবেশবিদ ও পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোও এ ব্যাপারে নানান প্রচার করেছে। এলাকার পরিবেশবিদ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি মৃতপ্রায় নদীগুলো পরিদর্শন করে সমস্যাগুলো জাতীয়ভাবে তুলে ধরায় চেষ্টা করেছেন। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা এ বিষয়ে লেখালেখি করেছেন। এছাড়া একাধিকবার জাতীয় নদী কমিশনার চেয়ারম্যানসহ দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ তিল্লীমুখ পরিদর্শন করেছেন এবং সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রæতি দেন। অন্যদিকে এসব নদীকে বাঁচানো এবং ভাঙন প্রতিরোধে জেলা প্রশাসকসহ অন্যান্য কর্মকর্তা এবং স্থানীয় নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সাথে মতবিনিময় আয়োজন করা হয়েছে একাধিকবার। প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সক্রিয় করতে নানান উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ফলশ্রæতিতে সরকার জেলার অভ্যন্তরে ৩টি নদী ও ৩টি খাল খননের উদ্যোগ গ্রহণ করাসহ আরো ছোট ছোট কয়েকটি প্রকল্প গ্রহণ করে।


বারসিকসহ অন্যান্য সামাজিক ও পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর উদ্যোগ এবং স্থানীয় মানুষদের সচেতনতা ও কর্মসূচি আয়োজনের ফলাফলস্বরূপ ইতিমধ্যে গাজীখালী, ইচ্ছামতি, ধলেশ্বরী নদী খনন চলছে। ২০২০ সালে এ খনন কাজ শুরু হয়। তবে খনন কার্যক্রমে কিছু অস্থায়ী ক্ষতি হলেও কৃষিজ, প্রাণীজ এবং প্রাণবৈচিত্র্যের ব্যাপক জীবন সঞ্চার ঘটছে তা হলফ করে বলা যায়। আশা করা হচ্ছে এ খনন কাজ সম্পন্ন হলে মানিকগঞ্জের মৃতপ্রায় নদীগুলো যেমন বাঁচবে ঠিক তেমনি নদীর তীর ভাঙনও কমে যাবে। দীর্ঘমেয়াদের ওই এলাকার মানুষদেরই উপকার হবে। নদীগুলোর প্রাণ ফিরে আসায় বাংলার গ্রামীণ সংস্কৃতির অংশ নৌকা বাইচ, ভেউড়া ভাসানোসহ আরো অনুষ্ঠানাদি পরিবাহিত হচ্ছে ইতিমধ্যে। জেলার বিভিন্ন স্থানে ডজন খানিক নৌকা বাইচ ইতিমধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছে। ধলেশ্বরী নদীতে প্রায় দুই যুগ পর কয়েকটি গ্রামে নৌকা বাইচ অনুষ্ঠিত হয়েছে। মানুষের মধ্যে আনন্দ সঞ্চার হচ্ছে।


নদীকে আপন গতিতে প্রবাহিত করতে দিতে হবে। নদীর গতিতে বাধা দেওয়া যাাবে না। নদীমাতৃক বাংলাদেশকে ভালোবাসার অন্যতম মাধ্যম হোক নদীগুলোকে আগলে রেখে প্রাকৃতিকভাবে তাদের প্রবহমানতা নিশ্চিত করা।

happy wheels 2

Comments