ধানের বিকল্প শস্য ফসলের সন্ধানে হাওরের কৃষকরা
শংকর ম্রং
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এদেশে অসংখ্য নদী-নালার পাশাপাশি প্রায় ৪২৩টি হাওর রয়েছে। হাওর মূলত: নিচু ভাটি এলাকা, যেখানে বছরের প্রায় ৭/৮ মাস পানি জমে থাকে। কোন কোন হাওরের বেশকিছু অংশ সারাবছরই পানিতে নিমজ্জিত থাকে। নেত্রকোনা জেলার পাঁচটি উপজেলায় হাওর রয়েছে। হাওরের জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই কৃষক ও কৃষির উপর নির্ভরশীল। যাদের নিজস্ব চাষের জমি নেই তারা অন্যের জমি লিজ, বন্ধক বা বর্গা চাষ করে। হাওরের কৃষকরা মূলত একক ফসল বোরো ধানের উপর নির্ভরশীল। বোরো মৌসুমে ধান চাষ করে তারা যে পরিমাণ ফলন পান তা দিয়েই অধিকাংশ কৃষকের সারাবছরের খোরাক ও পরিবারের ভরণ-পোষণ নির্ভর করে। কিন্তু তারা প্রতি বোরো মৌসুমের ধান বিভিন্ন কারণে সুষ্ঠুভাবে ঘরে তুলতে পারেনা। এর অন্যতম কারণ হলো প্রাকৃতিক দুর্যোগ।
এক মৌসুমে ভাল ফলন পেলে পরবর্তী মৌসুমে আগাম বন্যা, কোল্ড ইঞ্জুরি, রোগ-বালাইয়ের আক্রমণ ইত্যাদি কারণে তারা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষতির পরিমাণ এতটাই ভয়াবহ হয় যে, অনেক কৃষককে ঋণের দায়ে গবাদি পশু-পাখি, জমি ও অন্যান্য স্থায়ী সম্পদ বিক্রি করে কৃষি কাজ ছেড়ে অন্যত্র গিয়ে ভিন্ন পেশায় যুক্ত হতে হয়। কিন্তু যেসব কৃষক বয়সের ভারে অন্য পেশায় যুক্ত হতে পারছেন না; তারা বাধ্য হয়েই অনিচ্ছা স্বত্তে¡ও কৃষি পেশাকে আকড়ে ধরে আছেন। বোরো ধানের ফলন ঘরে তোলা অনিশ্চিত জেনেও তারা ধান চাষ করছেন। এক্ষেত্রে আগাম জাতের ধানের জন্য সরকারি কৃষি বিভাগে ধর্ণা দিয়েও অপেক্ষাকৃত আগাম ব্রি-২৮ জাত ছাড়া অন্য কোন জাত তারা পাচ্ছেন না। কিন্তু ব্রি-২৮ জাতটিও কোল্ড ইঞ্জুরি এবং ব্লাস্ট রোগে বেশি আক্রান্ত হওয়ায় এক্ষেত্রে কৃষকরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
হাওরের কৃষকদের ভাষ্য মতে, ২০১৭ বোরো মৌসুমে হাওরাঞ্চলের কোন কৃষক আগাম বন্যার জন্য কোন ধান ঘরে তুলতে পারেননি। আবার বোরো ২০১৮ মৌসুমে হাওরে ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। কিন্তু ২০১৯ মৌসুমে কোল্ড ইঞ্জুরিতে (ব্রি এর কীটতত্ত¡ বিভাগের মতে) এবং ব্লাস্ট রোগে ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্টিটিউট (BRRI ) ব্রি-২৮ ধানের এই ধরণের সমস্যার কথা চিন্তা করে বিকল্প হিসেবে ব্রি-৮১, ব্রি-৮৬, ব্রি-৮৯ ইত্যাদি জাত আবিষ্কার করেছে, যেগুলো ব্রি-২৮ এর অনুরূপ সময়ে ফলন দিতে সক্ষম এবং ব্লাস্ট রোগ সহনশীল। কিন্তু প্রায়োজনীয় প্রদর্শনী ও প্রচারণার অভাবে এজাতগুলো এখনও হাওরের কৃষকদের দোরগোড়ায় পৌছায়নি। তাই বলে হাওরের কৃষকরা বসে নেই। হাওরের বেশকিছু কৃষক প্রতিনিয়ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ধানের বিকল্প ফসল চাষ করে জলবায়ু জনিত দুর্যোগ মোকাবেলার, চেষ্টা করছেন দুর্যোগের সাথে খাপ খাইয়ে বৈচিত্র্যময় শস্য ফসল চাষ করতে। তাদের অনেকেই এক্ষেত্রে সফলও হচ্ছেন। আবার হাওরের বেশকিছু এলাকা রয়েছে, যেখানকার কৃষকরা নিজ উদ্যোগে এবং বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহের সহায়তায় এলাকা উপযোগি ধানের বিকল্প শস্য ফসলের জাত নির্বাচনে নিজেদের মত করে প্রায়োগিক গবেষণা পরিচালনা করছেন।
নেত্রকোনা জেলার মদন উপজেলার গোবিন্দশ্রী ইউনিয়নের খালাশীপাড়া গ্রামের কৃষকরা সংগঠিত হয়ে একটি গ্রামভিত্তিক কৃষক সংগঠন গড়ে তোলেছেন। তারা সংগঠনটির নামকরণ করেছেন ‘তলার হাওর কৃষক সংগঠন’।
সংগঠনটির মোট সদস্য সংখ্যা ২৫ জন। সংগঠনটি তৈরির অন্যতম উদ্দেশ্য কৃষি সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ গ্রহণ করা। হাওর এলাকা উপযোগি শস্য ফসলের জাত নির্বাচনের মাধ্যমে হাওরের কৃষকদেরকে একমাত্র বোরো ধানের উপর নির্ভরশীল না থেকে বৈচিত্র্যময় শস্য ফসল চাষ করতে উদ্বুদ্ধ করা। বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও পারস্পারিক বীজ বিনিময়ের মাধ্যমে এলাকার কৃষকদের মানসম্মত শস্য ফসলের বীজের সমস্যা লাঘব করে বাজারের বীজের উপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করা। এলাকার কৃষকসহ সকল জাতি, ধর্ম, বর্ণ, পেশা ও বয়সের জনগোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পারিক ও আন্তঃনির্ভরশীল সম্পর্ক জোরদারের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন সুনিশ্চিত করা। সংগঠনটি ধানসহ গবেষণাধীন শস্য ফসলের বীজ সংরক্ষণ ও কৃষক-কৃষক বীজ বিনিময়ের জন্য গ্রামে একটি হাওর বীজঘর গড়ে তুলেছেন। এ বীজঘর থেকে কৃষকরা তাদের পছন্দের জাতগুলো সংগ্রহ করে নিয়ে নিজ বসতভিটায় বা জমিতে চাষ করছেন এবং বীজ সংগ্রহ করে নিজেরা যেমন সংরক্ষণ করছেন, তেমনি হাওর বীজঘরেও বীজ ফেরত দিচ্ছেন।
হাওরাঞ্চলে ধানের বিকল্প শস্য ফসলের জাত নির্বাচনের জন্য তলার হাওর কৃষক সংগঠনের উদ্যোগে ২০১৮-২০১৯ রবি মৌসুমে প্রথমবার শস্য ফসলের প্রায়োগিক গবেষণা পরিচালনা করা হয়। এছাড়াও বোরো ২০১৮-‘১৯ মৌসুমে সংগঠনটি ২০টি স্থানীয় ধানের জাত নিয়ে প্রায়োগিক গবেষণা করে। জাত গবেষণা থেকে কৃষকরা বেশ ক’টি তৈল জাতীয় ফসলের জাত নির্বাচন করতে সক্ষম হয়। নির্বাচিত জাতগুলো হল- কালিজিরা, গোয়ামুড়ি ও তিসি। তারই ধারাবাহিকতায় রবি ২০১৯-২০২০ মৌসুমে সংগঠনটি বৈচিত্র্যময় ১৮টি শস্য ফসলের জাত নিয়ে ৫৫ শতাংশ জমিতে পুনরায় প্রায়োগিক গবেষণা স্থাপন করেছে। গবেষণাধীন শস্য ফসলের জাতগুলোর মধ্যে- ৬টি মসলা জাতীয় ফসল (ধনিয়া, কালোজিরা, শলুক, কিরসী, গোয়ামুড়ি, মেথি), তৈল জাতীয় ফসল ২টি (সরিষা ও তিসি), ২টি ডাল জাতীয় ফসল (ছোলা, খেসারী, মসুর), ৪টি সবজি ফসল (গোলআলু, ফরাশ, শালগম ও লালশাক) এবং অন্য ফসল ৩টি (ভূট্টা, যব, কাউন)। ফসলগুলো গবেষণা প্লটে গবেষণাধীন রয়েছে। চলতি রবি মৌসুমের প্রায়োগিক গবেষণা থেকে কৃষকরা হাওর এলাকা উপযোগি বেশকিছু শস্য ফসলের জাত নির্বাচন করতে সক্ষম হবে বলে আশা করছেন। জাতগুলো বর্তমানে গবেষণাধীন।
এবিষয়ে সংগঠনের সভাপতি কৃষক আব্দুল হান্নান বলেন, ‘আমরা বোরো ধান চাষ করতাম গিয়া বারবার মাইর খাইতাসি। কৃষি কইরা লাভ করতাম পারতাসিনা। তাই বারসিক আইসা ধানের বদলে অন্য ফসল করলে আগাম বন্যার আগেই ফসল ঘরে তুলন যাইব বলায় এবং বিষয়টি আমরারে বুঝাইয়া বলায় আমরা বিষয়টা বুঝতাম পারি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ১৬ জন কৃষক এক হইয়া গেল বছর বারসিক এর নিকট থাইকা বীজ সহায়তা নিয়া ১৭ জাতের (মসলা, ডাল ও অন্যান্য খাদ্য) গবেষণা করি। কিন্তু দেরি হয়ে যাওয়ায় এবং সেচের সমস্যার জন্য আমরা গবেষণায় তেমন ভাল করতে পারি নাই। তবে তিনটি ফসল ভালো ফলসে (কালিজিরা, গোয়ামুড়ি ও তিসি) এবং আমরা সে জাতগুলা নির্বাচন করে কয়েকজন কৃষকরারে বীজ দিছি। তারা এবছর সে জাতগুলো চাষ করছে। আমরা এ বছর গবেষণা থেকে ভাল ফলন পাব বলে আশা করতাসি।’
………