ঝুড়ি বেঁচে জীবন চলে না রহমানের

ঢাকা থেকে ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল

নাম আব্দুর রহমান (৭০)। ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার মাদ্রাস গ্রামে তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। চরম দুর্যোগ প্রবণ অঞ্চলে তারা বসবাস করতেন। দুর্যোগই তাঁর জীবনকে করেছে স্বর্বশান্ত। তার বয়স যখন ২০ বছর সে বছর অনেক বড় জলোচ্ছ্বাস হয়। কথাগুলো বলতে বলতে তার চোখদুটো চিকচিক করে উঠে পানিতে। ’৭০ এর জলোচ্ছ্বাসের কথা বলা শুরু করেন তিনি। জলোচ্ছাসে তাঁর মাকে তিনি হারিয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘আচমকা একটা পানির তোড়ে আমার মাকে ভাসাইয়া নিয়া যায়। আমি আর কোনদিন আমার মাকে দেখতে পাই নাই। এই কষ্ট বইলা বুঝানো যাইবে না। বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন রহমান।

3
দুর্যোগের পরেই আসে জীবনে আরেক দুর্যোগ ৭১’র মুক্তিযুদ্ধ। সে সময় যুবক ছেলেদের ধরে ধরে মেরে ফেলতো পাক বাহিনী। নিজের জীবন বাঁচানোই তখন কষ্টকর ছিলো। পালিয়ে পালিয়ে থাকতেন আর যথাসম্ভব মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে যান নাই কেন প্রশ্ন করলে সে অবলীলায় বলেন, ‘বাবা সাহসে কুলায় নাই, তাই যাইতে পারি নাই। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষেই সকল কাজ করছি।’

মুক্তিযুদ্ধের জ্বলজ্বলে স্মৃতিগুলো তার সামনে ভেসে উঠে। তিনি একে একে নানান ঘটনার বর্ণনা করতে থাকেন। বলতে থাকেন নানা অজানা কথা। কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে তার বর্তমান দুর্দশার কথাই বড় হয়ে উঠে। বর্তমানে তাঁর জীবন যে কোনভাবেই আর চলতে পারছে না তাই তিনি বলতে থাকেন। এখন তার পেশা হলো ঝুড়ি বিক্রি করা। যা করে তার দিনে ১০০ টাকা আয় হয়। কিন্তু প্রতিদিন তার বাজারের খরচ প্রায় ২০০/২৫০ টাকা। ঢাকা শহরে বস্তির জীবনে এ আয়ে তার বেঁচে থাকাটাই যেনো আজ বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

Slum pcs 4
কথা প্রসঙ্গেই রহমান জানান, তারা মূলত কৃষক পরিবার। তার বাবা ও দাদারা ছিলেন জাত কৃষক। ফসল চাষ করেই তাদের সংসার চলতো। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ তাদের সব কেঁড়ে নিয়েছে। তাদের প্রায় সব জমিই নদী গর্ভে চলে গেছে। যা ছিল তা অভাবের তাড়নায় বিক্রি করেছে। প্রায় সর্বশান্ত হয়েই তিনি ঢাকা শহরে এসেছেন।

রহমানের ৩ ছেলে ৩ মেয়ে ও স্ত্রী নিয়ে সংসার। ছেলে মেয়েরা যার যার মতো করে নতুন সংসার পেতেছে। এক ছেলে তার সাথে বসবাস করেন। তার স্ত্রী মানুষের বাসায় গৃহপরিচালিকার কাজ করেন। ছোট ছেলে ইট ভাঙ্গার কাজ করে। এদিয়েই তাদের সংসার কোন রকম চলে, আবার অনেক সময় চলতেও চায় না।

বস্তিতে ঘরভাড়া, পানির বিল, ইলেকট্রিক বিল, খাওয়া খরচ দিয়ে জীবন কাটানোই কঠিন। আর এখন তার বয়স হয়েছে। যখন যৌবন ছিলো তিনি কৃষিকাজ করেছেন। ঢাকায় এসে চটপটির দোকান করেছেন, করেছেন অন্যান্য ছোটখাট ব্যবসায়। কিন্তু এখন তার বয়স হয়েছে। তাই চাইলেও সে ভারি কোন কাজ করতে পারেন না। শরীরে নানান রোগের প্রভাব রয়েছে। শ্বাসের টান থাকে প্রায় সবসময়ই।

আব্দুর রহমান চাঁদ উদ্যানের পাইওনিয়র হাউজিং এ বসবাস করেন অনেক বছর ধরে। জীবনের এই শেষ সময়ে তিনি একটু শান্তি ও স্বস্থি নিয়ে বাঁচতে চান। চান সরকার যেনো তার দায়িত্বটা গ্রহণ করে। তিনি বলেন, ‘আমি তো এই দেশের জন্যও কম কাজ করি নাই। এদেশের নাগরিক হিসেবে আমারও তো কিছু দাবি আছে। একটা বয়স্কভাতার জন্য তিনি বারসিক’র মাধ্যমে সমাজসেবা অফিসে কাগজপত্র জমা দিয়েছেন। তিনি আশা করেন এই ভাতা পেলে আরেকটু স্বস্তি নিয়ে বাঁচতে পারবেন। জীবনটা আরেকটু সহজ হবে তার।

happy wheels 2

Comments