একজন যুব সংগঠক মোজাম্মেল হক

:: নেত্রকোনা থেকে পার্বতী রাণী সিংহ

Untitasdledনেত্রকোনা জেলার শ্রীরামপুর গ্রাম। এই গ্রামেই কৃষি পরিবারে মোজ্জাম্মেল’র জন্ম। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। তবে আর্থিক সমস্যা কারণে পড়ালেখা আর বেশি দুর চালিয়ে যেতে পারেননি। তবে বসে নেই তিনি। বাবাকে কৃষি কাজে তো সহায়তা করেনই। পাশাপাশি নিজের জানার পরিধিকে প্রসারিত করেছেন নিয়ত। এলাকার বিভিন্ন সমস্যা কীভাবে নিজেরাই সমাধান করতে পারেন তা নিয়ে তার ভাবনার শেষ নেই! এলাকার যুবশক্তিকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে এসব সমস্যা সমাধান করা যায় তা নিয়ে ভাবেন তিনি। মূলত এ ভাবনা থেকেই তিনি এলাকার সক্রিয় যুবকদের নিয়ে গঠন করে দিয়ারা যুব সংগঠন।

মোজাম্মেলসহ দিয়ারা সংগঠনের যুকবরা লক্ষ্য করেছেন যে, পানির অভাবে তাদের গ্রামসহ অন্যান্য গ্রামে অনেকগুলো জমি অনাবাদী থেকেছে। অনেক মানুষ চাষাবাস করতে না পারায় গ্রাম ছেড়ে কাজের সন্ধানে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। জমিতে ফসল ফলাতে না পারায় গ্রামগুলোতে অভাব-অনটন, দ্বন্দ্ব লেগেই থাকতো। বিষয়টি তাদেরকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। মোজাম্মেলরা ভাবেন কীভাবে এসব সমস্যা দূর করা যায়! মোজাম্মেল বিভিন্ন সভা ও কর্মশালায় জানতে পারেন যে, মুগ ডাল ও গমসহ বিভিন্ন খাদ্যশস্য আছে যা চাষবাসে পানি কম লাগে। তিনি এবং দিয়ারা সংগঠনের সদস্যরা জমির সদ্ব্যবহারের জন্য কৃষকদের গম ও মুগ ডাল আবাদের পরামর্শ দেন এবং বিভিন্নভাবে তাদের উদ্বুদ্ধ করেন। ভূ-উপরিষ্ঠ পানির উৎস নিশ্চিতকরণের জন্য তার নেতৃত্বে যুবকরা স্বেচ্ছাশ্রমে খাল পুনঃখনন করেন।

এভাবে মেজাম্মেলদের পরামর্শে শ্রীরামপুর গ্রামের ২০ জন কৃষক ধানের পরিবর্তে গম চাষ করেন। গম চাষ করে কৃষকরা তাদের জমির সদ্ব্যবহার যেমন নিশ্চিত করেছেন তেমনি আর্থিকভাবেও লাভবান হয়েছেন। তাদের দেখে অন্য কৃষকরাও আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। এছাড়াও গ্রামের ৩ জন যুব কৃষক মুগ ডাল চাষ করেও লাভবান হয়েছেন। অন্যদিকে এলাকার যেসব জায়গায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে সেগুলো সমাধানের জন্য মোজাম্মেল এর নেতৃত্বে এলাকার মানুষকে একত্রিত করে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে খাল খনন করে জলাবদ্ধতা দূর করেছেন। এতে করে এলাকার প্রায় ৫ একর জমি চাষাবাদ করার উপযুক্ত হয়।

মোজ্জামেলরা শুধু কৃষিতে নয় সামাজিকসহ বিভিন্ন পরিবেশ ইস্যুতে সচেতনতা তৈরির কাজ করেন। এভাবে মোজ্জামেল এর নেতৃত্বে যুবকরা এলাকায় দেশীয় ও ফলদ গাছ রোপণ ও সংরক্ষণ করেছেন, ডিমওয়ালা মাছ না ধরার জন্য সচেতনতা তৈরি করছেন এবং বাল্য বিবাহ, ঝরে পড়া, যৌতুকসহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সমাধানের জন্য সচেতনতা তৈরি ও প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।

মোজাম্মেল নিজেও কৃষিকাজ করেন। স্থায়িত্বশীল কৃষিই চর্চা করেন তিনি যেটা তাঁর পূর্ব পুরুষেরা করেছেন। স্থায়িত্বশীল কৃষি চর্চার কারণে তিনি কোন রাসায়নিক সার বা কীটনাশক ব্যবহার করেন না। কম্পোস্ট সার ও জৈব বালাইনাশক তৈরির কায়দা তিনি অভিজ্ঞ কৃষকদের কাছ থেকে রপ্ত করেছেন এবং অন্যান্য যুব কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। বারসিক’র কাছ থেকে তিনি নানাভাবে স্থায়িত্বশীল কৃষি উপকারিতা ও চর্চার কৌশল সম্পর্কে জানতে পারেন বলে উল্লেখ করেন। মোজাম্মেল এর কাছে অনেকগুলো সবজির বীজ রয়েছে। কারণ তিনি প্রতিটি সবজির বীজ সংরক্ষণ করেন এবং অন্য কৃষকদের সাথে বিনিময় করেন। মোজাম্মেল তার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা শুধু নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখেননি। ইতিমধ্যে তিনি তার গ্রামের কৃষকদেরকে স্থায়িত্বশীল কৃষি চর্চায় উদ্বুদ্ধ করছেন। এজন্য তিনি তাদের সাথে সার, বীজ বিনিময় করেছেন। তার এই উদ্বুদ্ধকরণের কারণে দিয়ারা গ্রামের ৪ জন কৃষক পতিত জমিতে জৈব পদ্ধতিতে সবজি চাষ শুরু করেছেন। এর মধ্যে ৮ জন কৃষক এ বছর জমিতে সরিষা চাষও শুরু করেছেন। এভাবে যে গ্রামের কৃষক চাষবাস করা যায় না বলে গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন কাজের সন্ধানে তাঁরাই এখন মোজাম্মেল এর পরামর্শে ফসল ও শস্যবৈচিত্র্য এনে জমিগুলোকে উৎপাদনশীল করে তুলেছেন, আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে এবং সর্বোপরি গ্রামেই থেকে যাচ্ছেন।

মোজাম্মেল তাঁর গ্রামকে প্রাণবৈচিত্র্যে ভরপুর গ্রাম হিসেবে গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেছেন। এজন্য গ্রামের সব কৃষকের সহযোগিতা চান। গ্রামের সব মানুষের প্রচেষ্টা ও যুক্ততার মাধ্যমেই তিনি প্রাণবৈচিত্র্যে ভরপুর একটি গ্রাম গড়ে তুলতে পারবেন বলে বিশ্বাস করেন। এজন্য তিনি চেষ্টা করছেন সবার সাথে স্থায়িত্বশীল কৃষির উপকারিতা, প্রাণবৈচিত্র্যের গুরুত্ব সহভাগিতা করেন, যা তিনি জেনেছেন বারসিক ও অন্যান্য অভিজ্ঞ কৃষকদের কাছ থেকে। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি নেত্রকোণা অর্গানিক ক্লাব নামক কমিটির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এভাবেই মোজাম্মেল হক একট একটু করে এগিয়ে যাচ্ছেন তার স্বপ্নের পথে। তিনি বলেন, “নিজে বাঁচবো, পরিবেশ বাঁচাব এবং অন্যকে উৎসাহিত করব”। মোজাম্মেল হকের এ স্বপ্ন পূরণ হোক সেই প্রত্যাশা করি।

happy wheels 2

Comments