সাতক্ষীরায় উপকূলীয় গ্রামীণ ঐতিহ্যের বিলুপ্তপ্রায় উপকরণ রক্ষায় প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত
সাতক্ষীরা থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল
প্রাচীনকাল তেকে উপকূলীয় অঞ্চলে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার হতো নানান ঐতিহ্যবাহী উপকরণ, যা ছিলো ঐতিহ্যের ধারক। উপকরণগুলো গ্রামবাংলার গৃহস্থের স্বচ্ছলতা ও সুখ সমৃদ্ধির প্রতীক বটে। তবে বর্তমানে উপকূলীয় এলাকার লবণাক্ততা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং আধুনিক পণ্যের ব্যবহার সম্প্রসারণের কারণে এগুলো বিলুপ্তির পথে। লুপ্তপ্রায় আমাদের এসব ঐতিহ্য সংরক্ষণ, টিকিয়ে রাখা বা ব্যবহার বৃদ্ধিতে উপকূলীয় গ্রামীণ ঐতিহ্যেরে লুপ্তপ্রায় সামগ্রী রক্ষায় প্রদর্শনী ও সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে সম্প্রতি।
গত ২৮ অক্টোবর শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের পশ্চিম জেলেখালী গ্রামে স্থানীয় জনগোষ্ঠী, সুন্দরবন স্টুডেন্ট সলিডারিটি টিম, সবুজ সংহতি ও বারসিক’র যৌথ উদ্যোগে উপকূলের হারিয়ে যাওয়া গ্রামীণ ঐতিহ্যের লুপ্তপ্রায় সামগ্রী রক্ষায় অনুষ্ঠিত প্রদর্শনী ও সংলাপে সভাপতিত্ব করেন জেলেখালী কৃষক সংগঠনের সভ্পাতি কৃষক ভুধর চন্দ্র মন্ডল।
প্রদর্শনীতে পশ্চিম জেলেখালী গ্রামের জেলেথালী কৃষক সংগঠন, শাপলা ও জবা কৃষি নারী সংগঠন ৩টি স্টলে বিভক্ত হয়ে উপকূলীয় এলাকার হারিয়ে যাওয়া বিভিন্ন গ্রামীণ নিদর্শন বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করে প্রদর্শন করে। প্রদর্শনীর মধ্যে ছিলো লাঙল, যোয়াল, লাটি, ঠুশি, মই, পাখে, নিড়ানি, দা, কুড়াল, বটি, কাশি, হামান দিস্তা, শিল, নোড়া, পোলো, ঝুড়ি, বাজারা, খারা, হোঙা, সাবল, ডোল, চাঙারি, মাটির মাঠে, কলস, পিতলের বিভিন্ন উপকরন, হারিকেন, টেমি, ঝাতি, বিভিন্ন ধরনের জাল, পুজার সামগ্রী, কাস্তে, ছেমত, হাসো, দোড়া, পাটের বস্তা, চালন, কুলো, হুকো, কলকে,বাটি, মাটে কলস, কাসার জিনিষ, ঢেকি,দাঁড়িপাল্লা, ঘোল টানার ছাচি বারি, সাদাকালো টেলিভিশন, সিডি, টেপরেকডর, ডাঙারি, আলটা, কড়ি, শানুক, টোপর, বাশই, ঢেঁঁকি, লাটিম, দোয়াত, কালি, হুকো, কলকে, খড়ম,নকশী কাঁথা, মাদুর, পাথরের থালা, শাক, ঞ্যাচাক লাইট, ডাঙারি, বিচলি কাটার বটি, ঘণ্টা, তামার পয়সা, বাবুই পাখির বাসা, লাউয়ের খোল, পিড়ি, রেডিও, টর্চ লাইচ, মাটির ব্যাংক, রুটির তাবা, পিড়ি, ধামা, হরিণের শিংসহ প্রায় ৪ শত ধরনের উপকরণ।
এসময় প্রদর্শনকারীরা জানান, আমরা একসময় কৃষির উপর নির্ভরশীল ছিলাম এবং জীবন-জীবিকা, জ্ঞান, সভ্যতা ও সংস্কৃতির সাথে এসব উপকরণ ব্যবহার করতাম। কালের বিবর্তনে সেগুলো আজ রূপকথার গল্প হয়ে গেছে। আমরা এখনও গ্রাম অঞ্চলে এগুলোর ব্যবহার কম করলেও তা সংরক্ষণ করার চেষ্টা করছি। এগুলো সম্পর্কে আমাদের সন্তানদের পরিচিতি করার জন্য আমরা এ কর্মসূচি আয়োজন করেছি।’
প্রদর্শন পরবর্তী সময়ে মারুফ হোসেন মিলনের সঞ্চালনায় সংলাপে হারিয়ে যাওয়া গ্রামীণ নিদর্শন টিকিয়ে রাখতে এগুলো গুরুত্ব তুলে ধরে বক্তব্য রাখেন মুন্সিগঞ্ঝ ইউপি সদস্য দেবাশিষ মন্ডল, উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মাছুম বিল্লাল, নাট্রকর দেবীরঞ্জন মন্ডল, শিক্ষক ভবানী রানী, কৃষাণী লতা রানী মন্ডল, ডাক্তার গৌরপদ মন্ডল, স্বেচ্ছাসেবক গৌতম সরদার, শিক্ষার্থী জবা, বারসিক কর্মকর্তা মারুফ হোসেন মিলন ও বিশ্বজিৎ মন্ডলসহ প্রমুখ।
বক্তরা বলেন, ‘কালের বিবর্তনে উপকূলীয় এলাকা থেকে প্রতিনিয়িত হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। এলাকাতে নানা ধরনের সম্পদ যেমন ছিলো। এগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ছিলো নানা ধরণের উপকরণ এবং সেগুলো ছিলো পরিবেশবান্ধব। কিন্তু আধুনিক কৃষির আগ্রাসন, লবণাক্ততা বৃদ্ধিসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এগুলো বিলুপ্ত হচ্ছে। তাই ঐতিহ্যবাহী এসব উপকরণ সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে। নতুন প্রজন্মকে এগুলোর ব্যবহার সম্পর্কে পরিচিত করতে হবে। গ্রাম বাংলার প্রাচীন এতিহ্য টিকিয়ে রাখতে আমরা কী ঐক্যবদ্ধভাবে সামিল হতে পারিনা।’
নাট্যকর দেবীরঞ্জন মন্ডল বলেন, ‘আমরা গ্রামের সাংস্কৃতিমনা মানুষ। গ্রামীণ ঐতিহ্যের সাথে আমাদের সবকিছু জড়িত। আজকের এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে যেন আমরা আমাদের সাংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে দেখতে পেলাম। এরকম প্রদর্শনীর মাধ্যমে আমাদের নতুন প্রজন্মকে এগুলো টিকিয়ে রাখা বা সংরক্ষণের জন্য এগিয়ে আসার আহবান জানাই।’
শিক্ষার্থী জবা মন্ডল বলেন, ‘আগে বাপ ঠাকুরদার কাছে যে রূপকথার গল্প শুনেছি। আজকে সেটা নিজের চোখে দেখতে পেলাম। আমাদের বাপ দাদারা যে কত ধরনের জিনিস ব্যবহার করতেন তা আজ জানলাম। এগুলো আমাদের এক একটা সম্পদ। আমরা গ্রামের মধ্যে একটা জাদুঘর করতে চাই। যেখানে আমরা এসকল ঐতিহ্য সংরক্ষণে রাখবো। তার জন্য সরকারী-বেসরকারী সকলের কাছে আমরা দাবি জানাই।’
প্রদর্শনী ও সংলাপে কৃষক-কৃষানী, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, যুব, সাংবাদিক, উন্নয়ন কর্মী, স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি, উপসহকারী, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিসহ ৩শতাধিক মানুষ অংশগ্রহণ করেন।