প্রাণবৈচিত্র্য মানুষের ‘কল্যাণ’ এর ভিত্তি রচনা করে
:: সিলভানুস লামিন
ভূমিকা
পরিবেশ এবং পরিবেশ-প্রতিবেশ থেকে প্রাপ্ত সেবা (Ecosystem services) যে কোন দেশের, অঞ্চলের এবং এলাকার উন্নয়নের গতিপথ বা আকৃতি তৈরি করতে পারে। অন্যদিকে উন্নয়ন বিষয়ক সিদ্ধান্ত অনেক সময় প্রাণবৈচিত্র্য, পরিবেশ ও পরিবেশ থেকে প্রাপ্ত সেবাসমূহের অবস্থা ও পরিণতি নির্ণয় করে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সারাবিশ্বে যেভাবে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে বা হয়েছে তাতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রাণবৈচিত্র্য, পরিবেশ এবং পরিবেশ থেকে প্রাপ্ত সেবাসমূহের বিষয়টিকে বিবেচনায় আনা হয়নি। এর পরিণতি হিসেবে পৃথিবীতে আজ দ্রুত হারে প্রাণবৈচিত্র্য বিলুপ্ত হচ্ছে, পরিবেশ থেকে প্রাপ্ত সেবাসমূহও দিনে দিনে হ্রাস পেতে শুরু করেছে। প্রাণবৈচিত্র্যের জন্য সবচে’ বড় হুমকি হচ্ছে বৃহৎ বা মাঝারি আকারে আবাসভূমিকে কৃষি ভূমিতে, নগরায়ন এবং বিদেশি আগ্রাসী প্রজাতি বৃক্ষের বনায়নের ভূমিতে রূপান্তরিত করা, প্রাকৃতিক সম্পদের অতিব্যবহার এবং প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থানকে দূষণ করা। অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তন প্রাণবৈচিত্র্যের বিলুপ্তির হারকে আরও তরান্বিত করেছে। এই লেখায় প্রাণবৈচিত্র্য বলতে সমগ্র জীবিত সত্তার মধ্যকার যাবতীয় উৎসগত বৈচিত্র্যকে বুঝায়; এসব উপাদানের মধ্যে রয়েছে স্থলজ, সামুদ্রিক ও অন্যান্য জলজ পরিবেশ পদ্ধতি এবং তারা যে পরিবেশ-সংস্থানের অংশ সেটাকেও বিবেচনা করা হয়েছে। অন্যদিকে এসব প্রাণবৈচিত্র্য থেকে মানুষ যে খাদ্য, ঔষুধ, পুষ্টি, জ্বালানি, ঘরাবাড়ি তৈরির উপাদানসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় উপকরণ পায় সেগুলোই হচ্ছে পরিবেশ-প্রতিবেশ সেবাসমূহ।
মানুষের কল্যাণে প্রাণবৈচিত্র্য
মানুষের কল্যাণ বিশেষ করে দরিদ্র মানুষের দারিদ্র্য দূরীকরণের ক্ষেত্রে প্রাণবৈচিত্র্য এবং এ থেকে প্রাপ্ত সেবাসমূহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একটি হিসাবে দেখানো হয়েছে যে, বিশ্বের ২০% থেকে ৫০% ঔষুধপত্র জেনেটিক বা কৌলী সম্পদ থেকে তৈরি হয় যার বার্ষিক বাজারমূল্য আনুমানিক ৬৫০ বিলিয়ন পাউন্ড। নামিবিয়ার সংরক্ষিত অঞ্চলের শুধুমাত্র পর্যটন শিল্পই ওই দেশের মোট জিডিপির ৬%। অস্ট্রেলিয়ার অর্থনীতিতে Great Barrier Reef এর অবদান (পর্যটন, মাছ ধরা এবং অন্যান্য চিত্তবিনোদনমূলক কর্মকাণ্ডে) ওই দেশের মুদ্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার। বিগত ৫০ বছরে বিশ্বে ৬০% প্রাণবৈচিত্র্য থেকে প্রাপ্ত সেবাসমূহ বিলুপ্ত হয়েছে এবং শুধুমাত্র বিগত ১০ বছরে এই বিলুপ্তিতে যা ক্ষতি হয়েছে সেটা যদি অর্থের মানদণ্ডে পরিমাপ করা হয় তাহলে এর আর্থিক ক্ষতি ৫০০ বিলিয়ন ডলার। ৪.৪৩ গিগা টন (বিলিয়ন মেট্রিক টন) কার্বন কানাডার জাতীয় পার্কে সঞ্চিত বা জমা পড়েছে। এই কার্বনের আর্থিক মূল্য আনুমানিক ১১ থেকে বিলিয়ন থেকে ২.২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার (বাজারে কার্বনের মুল্যের ওপর নির্ভর করে)। অন্যদিকে গরিব মানুষেরা তাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রাণবৈচিত্র্য সমৃদ্ধ বনের ওপর নির্ভর করে। এক প্রতিবেদনে বলা হয় বিশ্বের প্রায় ৬০% মানুষ তাদের জীবন-জীবিকার গুরুত্বপূর্ণ উপকরণের জন্য বন ও বনজ সম্পদের ওপর নির্ভর করে। এছাড়া প্রাণবৈচিত্র্য মানুষের পুষ্টি প্রদান করে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এক বিলিয়নেরও বেশি মানুষ মৌলিক খাদ্য হিসেবে মাছের ওপর নির্ভর করে। এছাড়া কাঠ ও অ-কাঠীয় বনজ সম্পদের ওপর বিশ্বের মানুষের নির্ভরশীলতার হার কোন অংশে কম নয়।
বিশ্বের ১.৬ বিলিয়ন মানুষ কাঠ, অ-কাঠীয় বনজ সম্পদের ওপর নির্ভর করে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী আফ্রিকার ৮০% মানুষ স্বাস্থ্যসেবার মৌলিক উপকরণ হিসেবে ঐতিহ্যবাহী ঔষুধের (উদ্ভিদ ও প্রাণী) ওপর নির্ভর করে এবং বিশ্বের এক বিলিয়ন মানুষ রোগ নিরাময়ের জন্য বনের গাছগাছড়া থেকে তৈরি ওষুধসামগ্রী ব্যবহার করে। উপরোক্ত হিসাব থেকে বলা যায় মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা সৃষ্টিতে প্রাণবৈচিত্র্য এবং এ থেকে প্রাপ্ত সেবা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
আর নয় প্রাণবৈচিত্র্যের বিলুপ্তি
মানুষের কল্যাণ সাধনে প্রাণবৈচিত্র্য এবং এ থেকে প্রাপ্ত সেবাসমূহ নানাভাবে অবদান রাখলেও সবাই যেন প্রাণবৈচিত্র্য নির্মূলে প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। বিভিন্ন উন্নয়ন উদ্যোগে প্রাণবৈচিত্র্যকে কখনও বিবেচনা করা হয় না। তাই তো দেখা গেছে গত দশকে পৃথিবীতে ৩৫% ম্যানগ্রোভ বন, ৪০% বন এবং ৫০% জলাভূমি বিলুপ্ত হয়েছে। মানুষ কর্তৃক সম্পাদিত বিভিন্ন প্রাণবৈচিত্র্য বিনাশী কর্মকাণ্ডের কারণে বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতি খুব দ্রুতহারে বিলুপ্তি হচ্ছে। বিলুপ্তির এই হার প্রাকৃতিকভাবে বিলুপ্ত হওয়ার ঘটনা থেকে ১০০ গুণের চেয়েও বেশি বলে ধারণা করা হয়েছে। আইইউসিএন এর রেড লিস্ট (২০০৯) এর মতে, ৪৪,৮৩৭টি (ওই সংগঠন কর্তৃক তালিকাপ্রাপ্ত) প্রজাতির মধ্যে ৩৮% বিলুপ্তির ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে এবং এর মধ্যে ৮০৪ প্রজাতি ইতিমধ্যে বিলুপ্ত হয়েগেছে। প্রাণবৈচিত্র্য বিলুপ্তি থেকে সৃষ্ট পরিবেশ থেকে প্রাপ্ত সেবাসমূহের অপ্রতুলতার কারণে মানবসমাজ ও অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করছে; বিশেষ করে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের পরবর্তী ‘জীবন’ ও প্রজন্মের ওপর এর প্রভাব হবে ভয়াবহ। প্রাণবৈচিত্র্য বিলুপ্তির পরিণতি হিসেবে প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভরশীল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা ব্যাপকভাবে বিপন্ন হবে বা হচ্ছে। এসব গরিব মানুষেরা তাদের প্রতিদিনকার জীবনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রাণবৈচিত্র্য এবং এ থেকে প্রাপ্ত সেবার ওপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল। বিশ্বের ৭০% মানুষ গ্রামে বাস করে এবং জীবন-জীবিকার জন্য প্রাণবৈচিত্র্যের ওপর নির্ভর করে।
মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কল্যাণে পরিবেশ, প্রাণবৈচিত্র্য এবং এ থেকে প্রাপ্ত সেবাসমূহ গুরুত্ব অবদান রাখলেও বিশ্বের অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রাণবৈচিত্র্যকে কদাচিৎ অর্ন্তভূক্ত করা হয় কারণ এটি সাধারণ সম্পদ; বাজারকে এটি সরাসরি কোন সংকেত প্রেরণ করে না। অন্যদিকে অর্থনীতির মৌলিক নির্দেশক তথা কর্মসংস্থানের হার, জিডিপি ও মুল্যস্ফীতি অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে স্পষ্টভাবে বার্তা প্রেরণ করেছে এই বলে যে, বিশ্বের চলমান উন্নয়ন উদ্যোগে ‘স্থায়িত্বশীলতা’র অনুপস্থিতি রয়েছে। স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন উদ্যোগের অনুপস্থিতির কারণে সৃষ্ট আর্থিক ও অর্থনৈতিক সঙ্কটকে আরও প্রকট করে তুলেছে জলবায়ু পরিবর্তন। বলা হয়, উন্নয়ন উদ্যোগে পরিবেশের স্থায়িত্বশীল ব্যবহারের অনুপস্থিতির কারণে আজ জলবায়ু পরিবর্তন দ্রুততর হয়েছে। তবে সম্প্রতি বিভিন্ন উন্নয়ন উদ্যোগে প্রাণবৈচিত্রের বিষয়টি বিবেচনা করার প্রয়োজনীতা অনেকে অনুধাবন করেছেন। কোন উন্নয়ন উদ্যোগ কখন সফলভাবে ‘উন্নয়ন’ সাধন করতে পারে না যদি উক্ত এলাকার মানুষহ অন্যান্য বিষয়কে বিবেচনায় আনা না হয়। তাই তো উন্নয়নের সাথে প্রাণবৈচিত্র্যকে সমন্বয় করার জন্য ২০০৮ সালে জামার্নির বন শহরে (Bonn) এ অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলনে (Cop9) ইউএনডিপি এবং সিবিডি’র সচিবালয় উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় ‘প্রাণবৈচিত্র্য’র বিষয়টি গভীরভাবে বিবেচনা করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠান দু’টি পরস্পরের সাথে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বিনিময় করা বিষয়ে চুক্তি করে। এই চুক্তির উদ্দেশ্য ছিলো গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক খাতগুলো তথা, কৃষি, বনায়ন, মৎস্য চাষ এবং পর্যটন শিল্প খাতে বৃহৎ, মাঝারি ও ক্ষুদ্র সরকারি এবং বেসরকারি সংগঠন, প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পরিচালিত ও বাস্তবায়িত উন্নয়ন উদ্যোগগুলো যেন প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণের উদ্দেশ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয়। অর্থ্যাৎ এসব উন্নয়ন উদ্যোগের কারণে যাতে প্রাণবৈচিত্র্য বিলুপ্ত বা ধ্বংস না হয়; বরং এসব উন্নয়ন উদ্যোগ বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষিত হয়। তাই বিশ্বে দারিদ্র্য দূরীকরণ, মানুষের কল্যাণ সাধনে এবং সর্বোপরি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও রক্ষা করি।