স্থানীয় গলাছেলা মুরগি চাষে নাজমা বেগমের সফলতা
সাতক্ষীরার, শ্যামগর থেকে বিশ্বজি মন্ডল
এক সময উপকুলীয় এলাকায় নানান ধরনের প্রাণবৈচিত্র্য ভরা ছিলো। প্রতিটি পরিবার দেখলে বোঝা যেতো যে এটি একটি কৃষি পরিবার। আর এসব পরিবারে যেমন বিভিন্ন ধরনের শস্য ফসল চাষাবাদ হতো। তেমনি ছিলো নানান ধরনের গৃহস্থালি প্রাণী। এ প্রাণী ছিলো নানান জাতের নানান রঙের নানান শ্রেণীর। তার মধ্যে গৃহস্থালীতে ছিলো বিভিন্ন জাতের মুরগি যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো গিন্নী মুরগী, কাজলী, সোনালী, ঘুঘু, পাযরা, ঝুটিবাধা, গলাছেলা ইত্যাদি। আর এসব মুরগি ছিলো স্থানীয় ও এলাকা উপযোগী। কিন্তু কালের পরিক্রমায় সব যেন আস্তে আস্তে হারিযে যেতে বসেছে। বিশেষ করে ১৯৮০ দশকের পর থেকে যখন উপকূলীয় এলাকায় লবণ পানি উঠিয়ে মাছ চাষ করা হয়। আস্তে আস্তে কৃষি জমি কমতে থাকে তার সাথে গৃহস্থালীতে প্রাণী সম্পদ কমতে শুরু করেছে। তারপরও গ্রাম অঞ্চলে এখনো অনেক পরিবারে গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিস না পালতে পারলে তারা হাস-মুরগি কম বেশি পালন করেন। এ হাঁস-মুরগি পালনের কাজটি নারীরা বেশি করে থাকেন। কারণ তাঁরা বাড়িতে সাংসারিক অন্যান্য কাজের সাথে খুবই যত্নসহকারে এগুলো করে থাকেন এবং সংসারের আয়ের ক্ষেত্রে ভালোই ভূমিকা পালন করেন।
কিন্তু বর্তমান সমযের সবচেয়ে আলোচিত যে বিষয় তাহলো মহামারী করোনা ভাইরাস। যার জন্য গোটা বিশ্ব যেন থমকে অছে। প্রতিনিয়ত যেন বিশ্বের অবস্থা পরিবর্তন হচ্ছে। এ পরিবর্তন হচ্ছে বাঁচা মরা নিয়ে। প্রতিদিন কোন দেশে কতো জন মরছেন, কতো জন আক্রান্ত হচ্ছেন তা ভাবার বিষয়। দেশের অর্থনৈতিক চাকা যেন থেমে যাচ্ছে।প্রতিণিয়ত যে সব শ্রমজীবীরা বাইরে যেতেন তারাই এখন ঘর বন্দী জীবনযাপন করছে। আবার অনেকে সংসারের কথা মাথায় রেখে সব বাধা! সমস্ত ভয়কে তোযাক্কা না করে বাইরে বের হচ্ছেন। কারণ সারাবিশ্বে কর্মজীবী এবং দরিদ্র শ্রেণীর মানুষের সংখ্যা বেশি। যাদের একদিন কাজ না করলে চলেনা। প্রতিটি মানুষ বুঝতে পারছেন যে, যেকোন সময় সে এই করোনা রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। কিন্তু সেটাকে বড় না করে নিজের পরিবার পরিজনের কথা মাথায় রেখে এই ঝুঁকি তারা নিচ্ছেন।
এই করোনা কালে সারা বিশ্বের মতো আমাদের বাংলাদেশের সমস্ত মানুষ কিন্তু নানান ধরনের সমস্যার মধ্যে দিন পাতিত করছেন। ভয়ে ভয়ে বের হচ্ছেন ঠিকই কিন্তু সেভাবে কাজ করতে পারছেনা। বাইরে না পাচ্ছেন তা কাজ আবার পেলেও তা মন থেকে করতে পারছেনা। সব সময় যেন এক ধরনের আতঙ্ক কাজ করছে। বিশেষ করে যারা প্রতিনিয়ত সংসারের কথা মাথায় রেখে বাইরে যাচ্ছেন। কাজে করতে যেমন ভয় তার থেকে বেশি ভয় যেন বাড়িতে আসার সময়। কারণ তারা মনে করছেন সারাদিন বাইরে কাজ করে বাড়ি ফিরলে কোনভাবে কি করোনাকে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন কি না!
ঠিক তেমনি শ্যামনগর উপজেলার কাশিমাড়ি ইউনিয়নের শংকরকাটি গ্রামের কৃষাণী নাজমা বেগমের চিন্তা। তার স্বামী মেহেদী হাসান আগে একসময় প্রবাসী ছিলেন। বিদেশ থেকে ফেরার পর তিনি ছোট খাটো ব্যবসা, বাড়ির কৃষি কাজসহ বিভিন্ন সময়ে যখন যে কাজ হতো তা করতেন। কিন্তু করোনায় যে দিনের পর দিন আক্রান্ত বেশি হচ্ছে মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে তা নিয়ে তাদের দুর্চিন্তার শেষ নেই। তাই স্বামী স্ত্রী মিলে মনে ঠিক করলেন যা করবেন বাড়িতে বসে করবেন। সে অনুযায়ী তারা বাড়িতে যেমন নানান ধরনের সবজি চাষাবাদ করেন। সাথে বিভিন্ন ধরনের হাঁস মুরগিও পালন করেন। বিগত সময়ে উপকূলীয় এলাকায় স্থানীয় কৃষক-কৃষাণীর উদ্যোগে ও বারসিক’র সহায়তায় স্থানীয় গলাছেলা মুরগির জাত সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণের লক্ষ্যে প্রায়োগিক গবেষণার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। সেক্ষেত্রে কর্মএলাকার তিনটি বাড়িতে ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে দেখার জন্য এ কার্য়ক্রম শুরু হয়। সেখানে কৃষাণী নাজমা বেগমকে ১০টি গলাছেলা মুরগি সহায়তা করা হয়। নাজমা বেগম বদ্ধভাবে সেগুলো পালন করেন এবং শুধু ডিম উৎপাদন করা কাজে ব্যবহার করতেন। পরবর্তীতে করোনার কথা মাথায় রেখে ডিম বাইরে বিক্রি না করে বাচ্চা উৎপাদন করার চিন্তা করেন। এভাবে নাজমা বেগম ছোট একটি ইনকিউবেটর মেশিন সংগ্রহ করেন। সেখানে শুধু মাত্র ৫০টির বেশি ডিম দিয়ে বাচ্চা ফোটানো শুরু করেন। তা দিয়ে খুব বেশি লাভ হচ্ছিল না। পরে নিজের মুরগির ডিম সংগ্রহ করে অন্য গ্রামের একজনের বড় ইনকিউবেটর মেশিনে ৩২০ করে গলা ছেলা মুরগির ডিম ফোটাতে দেন। তা থেকে ৩০০টি বা্চ্চা উৎপাদন হয়, যা ডিমসহ খরচ পড়ে ৩২ টাকা এবং সে বাচ্চা বাড়িতে ২০-২৫ দিন রেখে ৯০ টাকা দামে বিক্রি করেন। এতে করে তার সব খরচ বাদ দিয়ে প্রায় ৬০০০-৭০০০ টাকার মতো করে লাভ থাকে।
এ বিষয়ে নাজমা বেগম বলেন, ‘আমি অন্য মুরগির চেয়ে গলাছেলা এই মুরগিগুলো বেশি চাষ করি। কারণ এ মুরগিগুলো মাংস হয় বেশি, ডিম দেয় বেশি। এছাড়াও মৃত্যুর পরিমাণও কম এবং এলাকা উপযোগী। এলাকায় এ মুরগির চাহিদাও বেশি। ডিম ও মুরগি গ্রামের মানুষ এবং পাইকারী পাটি বাড়ি থেকে নিয়ে যায়। ঘরে বসে আয় করতে পারি। তার জন্য এই উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। এ কাজে আমার পরিবারের সবাই সহায়তা করে। পরিবারের কেউ এখন আর বাইরের কাজ করেনা। বাড়িতে হাঁস-মুরগি পালন ও সবজি চাষ করে এই করোনাকালে ভালোই চলছে আমার পরিবার।’
এই করোনা মহামারীকালে যতই দিন যাচ্ছে ততই যেন আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার বেড়েই চলেছে। এতে করে মানুষের মধ্যে অাতঙ্কের মাত্রাও বাড়ছে। প্রতিদিন কাজ থেকে ফিরছে নানান ধরনের মানসিক দুশ্চিন্তা নিয়ে এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য সকলে নিজের মতো করে নানান ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করে চলেছেন। করোনাকালে স্থানীয় গলাছেলা মুরগি পালন করে নাজমা বেগম তার পরিবারের অর্থনৈতিক চাকাকে সচল রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন যা এই মহামারীকালের জন্য এক দৃষ্টান্ত হতে পারে।