সাতক্ষীরায় ভাটির টানে, বাদার গানে প্রাণের উচ্ছ্বাস কর্মসূচি পালিত

সাতক্ষীরার, শ্যামনগর থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গোটা বিশ্ব আজ স্তম্ভিত। উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতির শিকার। বারবার ঘূর্ণিঝড়, বেড়িবাঁধ ভাঙন, লবণাক্ততা, জলোচ্ছ্বাসের ফলে উপকূলীয় এলাকার মানুষ সহায় সম্বল হারিয়ে অন্যত্র আশ্রয় গ্রহণ করছেন। খাদ্য সংকট, জীবিকার উৎস হ্রাস, বাস্তুভিটা বিছিন্ন, স্বাস্থ্য ঝুঁকি, অপুষ্টি, সুপেয় পানির সংকট, রোগ ব্যাধি বৃদ্ধিসহ অর্থনৈতিক সংকট উপকূলের মানুষকে গ্রাস করছে। শত প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে উপকূলীয় জনগোষ্ঠী নিজেদের জ্ঞান, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে নিজেদের পেশা ও সংস্কৃতিকে আগলে টিকে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন।


উপকূলীয় জনগোষ্ঠী নিজেদের ঐতিহ্য, পেশা, সংস্কৃতি, মুল্যবোধ, জীবন জীবিকার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে নানান সময়ে নানান মাধ্যমে তাদের সমস্যা তুলে ধরার চেষ্টা করেন এবং সমাধানে নীতি নির্ধারকদের নিকট দাবি তুলে ধরেন। তারই ধারাবাহিকতায় গত সম্প্রতি সাতক্ষীরা জেলা শিল্পকলা একাডেমী চত্ত্বরে বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্টান বারসিক’র সহায়তায় ও উপকূলীয় পেশাজীবী জনগোষ্ঠীর উদ্যোগে জলবায়ু সংকট মোকাবেলা, প্রকৃতি ও সংস্কৃতি সুরক্ষায় উপকুল জনগণের সম্মিলিত উন্নয়ন প্রয়াসে ‘ভাটির টানে, বাদার গানে’ শীর্ষক দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের মধ্যে ছিলো জলবায়ু পরিবর্তন ও সুন্দরবন সুরক্ষায় যুবদের ভূমিকা শীর্ষক বক্তৃতা প্রতিযোগিতা, উপকূলীয় অঞ্চলের বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষের টিকে থাকার গল্প, উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের সমস্যা ও সম্ভাবনার দাবিতে প্লাকার্ড প্রদর্শনী, কৃষিজমি সুরক্ষায় নাগরিক মঞ্চ, আমাদের উপকূলীয় বিভিন্ন পেশাজীবী ও স্থানীয়দের পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, দুর্যোগ সচেতনতায় যুবদের আয়োজনে পথনাটক, নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর নিজস্ব সংস্কৃতি পরিবেশনা ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠিত হয়েছে।


অনুষ্ঠানের শুরুতে উপজেলা জনসংগঠন সমন্বয কমিটির সভাপতি চ্যানেল আই কৃষিপদক প্রাপ্ত কৃষক নেতা শেখ সিরাজুল ইসলামের সভাপতিত্বে জাতীয় সংগীত পরিবেশন এবং সুন্দরবনের বাঘ বিধবা নারী সোনাভানু ও ঘূর্ণিঝড় আইলাকালীন সময়ে জন্মগ্রহণকারী শিশুকন্যা বন্যা শান্তির প্রতীক পায়রা উড়িয়ে শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করেন।
উদ্বোধনী পর্বের পরেই বারসিক কর্মকর্তা গাজী আল ইমরান ও মননজয় মন্ডলের যৌথ সঞ্চলনায় অনুষ্ঠানের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও শুভেচ্ছা বক্তব্য উপস্থাপন করেন বারসিক সহযোগী আঞ্চলিক সমন্বয়কারী রামকৃষ্ণ জোযারদার।
বক্তৃতার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে সাতক্ষীরা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ও সাতক্ষীরা সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালযয়ের শিক্ষার্থীরা। বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় শিক্ষার্থীরা জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধ ও সুন্দরবন সুরক্ষায় যুবদের ভূমিকা তুলে ধরে বলেন, ‘পৃথিবীতে তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য দায়ী মানুষ। পরিবেশ দূষণের ফলেই বৃদ্ধি পাচ্ছে তাপমাত্রা। এর ফলে জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে। এর প্রভাব পড়েছে উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর উপর। প্রাকৃতিক দুর্যোগের রক্ষা কবজ সুন্দরবনকে রক্ষা করতে হলে যুব সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। আগামী প্রজন্মকে সুস্থ সবল রাখতে হলে একটি সুন্দর পৃথিবী সবার কাম্য। তাই আগামীর বাসযোগ্য সুন্দর পৃথিবী গড়ে তোলার লক্ষ্যে যুব সমাজকে একসাথে কাজ করার আহ্বান জানান বক্তারা।


বক্তৃতা প্রতিযোগিতার পরেই উপকূলীয় অঞ্চলের বিভিন্ন পেশাজীবী জনগোষ্ঠীর মানুষেরা তাদের টিকে থাকার গল্প সুখ-দুঃখ হাসি কান্না মান-অভিমানের গল্প তুলে ধরেন। সাথে কি ধরনের প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে তারা টিকে আছেন বা কি ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করছেন তা সহভাগিতা করেন।
অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের বিভিন্ন সমস্যা ও সম্ভাবনার দাবিতে প্লাকার্ড প্রদর্শনী করেন। দাবিগুলোর মধ্যে ছিল টেকসই বেড়িবাঁধ চাই, আপনার পরিবেশ আপনার দায়িত্ব, বেঁচে থাকার অধিকার চাই, জলবায়ুর সুবিচার চাই, ত্রাণ চাইনা বাঁচতে চাই, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য পরিবেশকে হতে দিব না বিপন্ন, গাছ লাগাই ভবিষ্যৎ বাঁচাই, আমাদের সুন্দরবন আমাদের অক্সিজেন, বহুত্ববাদী সমাজ নির্মানে একতাবদ্ধ হই,সুন্দরবন ও ইপকুল সুরক্ষায় জনবান্ধব পরিকল্পনা চাই ইত্যাদি। অনুষ্ঠানটিতে শত শত শিক্ষার্থী, শিক্ষক, সাংবাদিক, সংস্কৃতি জন, বনজীবী, কৃষক-কৃষাণীসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে।

অনুষ্ঠানে শ্যামনগর উপজেলা জনসংগঠন সমন্বয় কমিটির সভাপতি, চ্যানেল আই কৃষি পদকপ্রাপ্ত শেখ সিরাজুল ইসলামের সভাপতিত্বে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ আব্দ্লু হামিদ, সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও জেলা নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আবুল কালাম আজাদ, মানবাধিকার কর্মী মাধব দত্ত, নাগরিক নেতা আলী নূর খান বাবুল, অধ্যাপক ইদ্রিস আলী, আশরাফ হোসেন, সাংবাদিক আমিনা বিলকিস ময়না, সংস্কৃতিজন হেনরী সরদার, কর্ণ বিশ্বাস, সাতক্ষীরা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক মোহাম্মদ আনিসুর রহমান, সাতক্ষীরা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক হুমায়ুন কবির, ধুলিহর-ব্রহ্মরাজপুর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক এসএম শহীদুল ইসলাম, সাংবাদিক রণজিত বর্মণ, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বারসিক-এর জেলা সমন্বকারী মাসুম বিল্লাহ, আঞ্চলিক সসমন্বয়কারী রামকৃষ্ণ জোয়ারদার, বারসিক-এর মননজয় মন্ডল, বিশ^জিৎ মন্ডল, গাজী মাহিদা মিজান প্রমুখ। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বারসিক-এর মফিজুর রহমান।
অনুষ্ঠানে পরিবেশ ও কৃষি জমি রক্ষায় কৃষি জমি রক্ষায় প্রস্তাবিত আইন ও নীতিমালা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় দেশের সকল ধরনের কৃষিজমি রক্ষা ও সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে একটি সুনির্দিষ্ট সর্বজনীন গ্রহণযোগ্য জাতীয় নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। নির্দিষ্ট শিল্পাঞ্চলের বাইরে কৃষি জমির ওপর যত্রতত্র অবকাঠামো নির্মাণ বন্ধে আইন প্রণয়ন ও তার সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। কৃষি জমিতে ইট ভাটা নির্মাণ, বেচাকেনা সম্পূণরূপে বন্ধ ঘোষণা করতে সরকারের যে কোনো উন্নয়নমূলক কাজের জন্য (রাস্তাঘাট,অবকাঠামো নির্মাণ) কৃষি জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে সঠিকভাবে যাচাই বাছাই করতে হবে। কৃষিজমির যথেচ্ছ ব্যবহার করে অপরিকল্পিত রাস্তাঘাট, দালানকোঠা, বাসভবন নির্মাণ বন্ধ করতে হবে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে (যশোর, খুলনা, সাতক্ষীরা) জলবদ্ধতা দূর করে কৃষিজমি উদ্ধার ও চাষের উপোযোগী করে গড়ে তুলতে হবে । ড্রেজিং ব্যবহারের মাধ্যমে ছোট বা বড় নদী খননের সময় যে কোনো ধরনের কৃষি জমিতে বালু ফেলা নিষিদ্ধ করাসহ ইত্যাদি দাবি উপস্থাপন করা হয়।


দিনব্যাপী এ অনুষ্ঠানকে ঘিরে সাতক্ষীরা শিল্পকলা একাডেমি চত্ত্বরে স্থানীয় উপকূলীয় মানুষের জীবন-জীবিকার সাথে মিশে থাকা নানা পণ্যের সমন্বয়ে দেওয়া হয় স্টল। স্টলে শোভা পায় মাটির তৈরি তৈজসপত্র, বাঁশ ও বেতের তৈরি গৃহস্থালির সামগ্রী, পরিবেশবান্ধব বন্ধু চুলা, সুন্দরবনের গোলফল, গোলপাতা, মধু, মোম, বাঁশি, জাল, খারাসহ নানা জিনিস। এছাড়া স্থানীয় জাতের ১৫০ প্রজাতির ধানবীজ প্রদর্শনী করেন কৃষক আব্দুল বারিক। এছাড়া তেলাকুচা, শাপলা, সজিনা, হেলেঞ্চা, মালঞ্চ, কচুফুল, ডুমুর, তিতবেগুন, ব্রাহ্মী, কলার মোচাসহ স্থানীয় কুড়িয়ে পাওয়া সবজির সমারোহ দর্শকদের মন কাড়ে এ অনুষ্ঠানে।
অনুষ্ঠানে নৃত্যের তালে, গানের সুরে ও নাটকের অভিনয়ে ফুটে ওঠে উপকূলীয় মানুষের জীবন সংগ্রামের বাস্তব প্রতিচ্ছবি। শিশু কিশোর যুব বৃদ্ধসহ সকল শ্রেণির মানুষ উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠে হৃদয়হরা এ অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠান শেষে ১৭ সদস্য বিশিষ্ট একটি উপকূল কমিটি ঘোষণা করা হয়।

happy wheels 2

Comments