চলমান সংকটে বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকদের অভিযোজন কৌশল
বরেন্দ্র অঞ্চল থেকে শহিদুল ইসলাম
ভূমিকা
বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলটি খরাপ্রবণ বরেন্দ্র অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় এই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য আলাদা। ভূগঠনবৈচিত্র্য যেমন- উঁচু নীচু মাঠ, খাড়ি, এঁটেল মাটিসহ আবাহাওয়ার তারতম্য এই অঞ্চল আলাদা বৈশিষ্ট্য বহন করে। দীর্ঘদিন থেকে পানি সংকটাপন্ন এই এলাকাটি বর্তমানে বৈশি^ক জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবগুলো আরো বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দিনে দিনে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যাওয়াসহ তীব্র তাপদহ বেড়েই চলেছে। বর্ষাকালেও এখানে তুলনামূলক বৃষ্টিপাত কমে গেছে, বেড়েছে তাপমাত্রা। রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের তথ্যমতে, প্রতিবছর গড়ে এক ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে বরেন্দ্র অঞ্চলে। এর ফলে জনজীবন এবং প্রাণবৈচিত্র্য সংকটে পড়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে বৈশি^ক যুদ্ধ সংঘাতের প্রভাবগুলোও মারাত্মকভাবে পড়ছে দেশ থেকে কমিউনিটি পর্যায়ে । ১৯৬০ এর দশকের দিক থেকে শুরু করে কৃষি ফসলের অধিক উৎপাদনের উদ্দেশ্যে উচ্চ ফলনশীল বীজ, রাসায়নিক কীটনাশক, জলসেচ ও আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার বাড়তে থাকে। আর এসকল উপকরণ যার পুরোটাই বা বেশিরভাগ নির্ভর করতে হয়ে বিদেশ থেকে বা বাইরে থেকে। কিন্তু দিনে দিনে বৈশি^ক জলবায়ু পরিবর্তনে কারনে দেশে দেশে দুর্যোগ বেড়েছে এবং একই সাথে যুদ্ধ এবং বৈশ্বিক রাজনৈতিক কারণে যখন সংকট বেড়ে গেছে তখন বাইরে থেকে সার বীজ, কীটনাশকসহ হাইব্রিড বীজসহ কৃষির নানা উপকরণে দেখা দিয়েছে সংকট। দাম বেড়েছে প্রতিটি উপকরণের। উৎপাদন আয় ব্যয়ের সাথে তাল মেলাতে পাচ্ছেনা কৃষক। একদিকে স্থানীয় দুর্যোগের কারণে সংকট বেড়েছে অন্যদিকে যুদ্ধ ও বিশ^ রাজনীতির কারনে কৃষক তার চাহিদানুযায়ী উপকরণ সংকটে পড়ছে। আর এই নিদানকালে কৃষক তাঁর চির চেনা প্রৃকতি এবং নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও সম্পদকে অনেক বেশি কাজে লাগিয়ে সংকট উত্তোরণে ভূমিকা পালন করছেন।
খরা এবং রাসায়নিক সার সংকট মোকাবেলা করছে জৈবসার
চলমান বৈশি^ক সংকটের কারণে বিদেশনির্ভর কৃষি উপকরণের দাম বৃদ্ধি এবং সহজে তা না পাবার কারণে কৃষক তাঁর উৎপাদনে রাসায়নিক কীটনাশকের বদলে স্থানীয়ভাবে সহজপ্রাপ্য উপকরণগুলো ব্যবহার বৃদ্ধি করছে। বাড়ির উঠোনে গোবর সার জমিতে ব্যবহার করছে আগের তুলনায় বেশি। আবার অনেকে নিজেরা জৈব সার তৈরী করে ব্যবহার বাড়িয়েছেন। ভার্মী কম্পোস্ট উৎপাদনসহ স্থানীয় জৈববালাই তৈরি করেও ব্যবহার করছেন। বরেন্দ্র অঞ্চলের খরাকেও সহজে মোকাবেলা করা যায় এই জৈব সার ব্যবহার করলে। সবজি খেতে বা জমিতে জৈবসার ব্যবহার করলে রসালো থাকে। পানি কম লাগে এমনটাই বললেন বারসিক’র কমিউনিটি পর্যায়ে স্বশিক্ষিত কৃষি গবেষক রায়হান কবির রঞ্জু। তিনি বলেন, ‘বর্তমান এই সংকটকালিন সময়ে কৃষকদের মধ্যে জৈবসার ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। খরাপ্রবণ উচ্চ বরেন্দ্র অঞ্চল হিসেবে পরিচিত নাচোল উপজেলার খরিবোনা গ্রামের এক তথ্য সমীক্ষায় দেখা যায় চলতি আমন মৌসুমে স্মরণকালের ভয়াবহ খরার সাথে কৃষক রাসায়নিক সার সংকটে ভুগছে। এ চিত্র শুধু নাচোল নয়, বরেন্দ্র অঞ্চলে বিভিন্ন এলাকা পর্যবেক্ষণেও তা জানা যায়। এই সময়ে কৃষক তাঁর আশপাশের সহজ প্রাপ্য প্রাকৃতি সম্পদসহ নিজের অভিজ্ঞতাকে অনেক বেশি কাজে লাগাচ্ছে। স্থানীয়ভাবে নাচোল উপজেলার খড়িবোনা গ্রামে পর্যবেক্ষিত তথ্যানুযায়ী জানা যায় -এই খড়িবোনা গ্রামেই প্রায় এক হাজার টনের বেশি গোবর, জৈবসার, ভার্মী কম্পোস্ট সার ব্যবহার হয়েছে চলতি আমন মৌসুমে। যা আগের তুলনায় অনেক বেশি। খড়িবোনা গ্রামের কৃষক ছাইফুল ইসলাম বলেন, আমি ২ বিঘা জমিতে ৫০ কেজি ভার্মী কম্পোস্ট ব্যবহার করেছি।’ আরো ব্যবহার করবেন বলে জানান তিনি। তিনি আরো বলেন, চারিদিকে রাসায়নিক সারের দাম বেড়েছে, সার পাওয়া যায়না, তাই বিকল্প হিসেবে নিজের উৎপাদন করতে জৈবসার ব্যবহার বৃদ্ধি করেছি। ফলাফল ভালোই পাচ্ছি । বৃষ্টি কম হওয়াতেও ধানের গাছগুলো সজীব এবং ভালো আছে বলে জানান তিনি।
অন্যদিকে রাজশাহীর পবা উপজেলার তেঁতুরিয়া ডাঙ্গা গ্রামের কৃষক আফজাল(৪৫) বলেন, ‘ইউরিয়া সার দাম বেড়েছে, পটাশ তো পাওয়াই যায়না, আবার দাম বেশি। আগে আধটুকু জমিতে পাঁউশ (গোবর সার) ব্যবহার করতাম, এবার এই সমস্যায় জমিতে সবগুলো পাঁউশ ব্যবহার করেছি।’ তিনি বলেন, আমি আট বিঘা জমিতে আমন ধান লাগিয়েছি। প্রতিটি জমিতে গোবর সার দিয়েছি এবার।’ তাঁর স্ত্রী কৃষাণী আকলিমা (৩৫) বলেন, ‘আগে বাড়িতে গোবরগুলো দিয়ে নোনদা ( জ¦ালানি কাঠি) তৈরী করতাম, কিন্তু এ বছর সবগুলো গোবরের পাঁউশ তৈরী করেছি। যা সবগুলো জমিতে ব্যবহার করা হয়েছে। কৃষক আফজাল হোসেন বলেন, ‘এর ফলে দেখা যাচ্ছে আমার জমির ধান সুস্থ সবল আছে, রাসায়নিক সারের বাড়তি খরচও হয়নি। আমার কাছে লাভবান মনে হয়েছে।’ রাজশাহীর তানোর উপজেলার গোকুল-মথুরা গ্রামের কৃষক জীতেন্দ্র নাথ(৫৫) বলেন, ‘এবার আমরা অতীত অভিজ্ঞতাগুলো কাজে লাগানোর চেষ্টা করছি। ফলাফল ভালোই পাচ্ছি। জৈবসার দিলে যেমন মাটি রসালো থাকে, তেমনি এটা ব্যবহাওে ফসল উৎপাদনে খরচ কমে, পরিবশে ভালো থাকে।’
মাঠ পর্যবেক্ষণসহ কৃষকদের সাথে উঠোন বৈঠকের মাধ্যমে জানা গেছে বরেন্দ্র অঞ্চলের গ্রামগুলোতে চলমান খরা ও সংকট মোকাবেলায় কৃষকদের মধ্যে জৈবসারের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার গ্রামগুলোতে বারসিক’র সহায়তায় দীর্ঘদিন থেকে ভার্মী কম্পোস্ট তৈরীসহ স্থানীয় প্রাকৃতিকসহ সহজপ্রাপ্য উপকরণ ব্যবহারে দিকগুলো নিয়ে শিখন ও অভিজ্ঞতা বিনিময় হওয়ার ফলে গ্রামগুলোতে উৎপাদনকারিদের কাছ থেকে জৈবসসার উৎপাদন ও বিপণনও বৃদ্ধি পেয়েছে। এমন একজন পবা উপজেলার বড়গাছি ইউনিয়নে কাড়িগড় পাড়া গ্রামের বিলকিস আক্তার(৫৫) বলেন, “আমি এই আমন মৌসুমে বিগত ৪৫ দিনে প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকার ভার্মী কম্পোস্ট বিক্রি করেছি। এই সময়টাতে ভার্মী কম্পোস্ট এর চাহিদা আগের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে।
খরা মোকাবেলায় স্থানীয় লোকায়ত পদ্ধতি ও মালচিং এর ব্যবহার হচ্ছে
মাটির রস ধরে রাখতে চলতি খরায় বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষক কৃষাণীগণ তাঁদের ফল মূল গাছ, ফসল ও সবজি ক্ষেত রক্ষায় বিভিন্ন লোকায়ত পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করছে। আদিবাসী নারীগণ তাদের বাড়িতে সবজি গাছ এবং ফলমূল গাছ রক্ষা করতে দা ঝরো পদ্ধতি ব্যবহার করে। দা ঝরো হলো বোতল বা মাটির পাত্রে করে ছিদ্র করে ঝির ঝিরে করে পানি দেয়া। এর ফলে গাছের গোড়ায় ফোটায় ফোটায় পানি পড়ে, পানি কম লাগে এবং গাছের গোড়া রসালে থাকে।
আবার কৃষকগণ মাটি রসালে রাখতে মালচিং এর ব্যবহার করছেন। লতা পাতা, খড়-খুটা, কচুরি পানা দিয়ে গাছের গোড়া ঢেকে রাখছেন। এর ফলে অনেক সময় ধরে গাছের গোড়া রসালো থাকছে। অধিক খরায় এর ফলে ফসল রক্ষা হচ্ছে। পবা উপজেলার কৃষক আব্দুল জব্বার (৬০) বলেন, ‘সবজি খেতে ডালের/গাছের গোড়ায় আমরা লতাপাতা দিয়ে এমনকি কচুরি পানা দিয়ে ঢেকে দেই। এর ফলে এই খরার সময় গাছের গোড়া ভিজা থাকে। খরার সময় এটি বেশি ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
উপসংহার
নানা দুর্যোগে দুর্ভোগে মানুষ যখন সংকটে পড়ে তখন তাঁর আশ পাশের প্রকৃতি এবং সম্পদ দিয়েই রক্ষা পেয়ে থেকে। করোনা মাহামারিতে যখন চারিদিকে লকডাউন এবং কৃষি উপকরণের সংকট, কৃষক ঠিক সেই সময় তাঁর নিজস্ব বীজ এবং সার ব্যবহার করে খাদ্য উৎপাদন অব্যহত রেখেছে। আবার যখন খরা এবং অনাবৃষ্টিতে ফসল নষ্ট হচ্ছে তখন তাঁর আশপাশের সহজ প্রাপ্য উপকরণ জৈসসার, স্থানীয় উপকরণ ব্যবহার করে ফসল রক্ষা করছে। বৈশ্বিক রাজনীতি এবং যুদ্ধের কারণে যখন কৃষি উপকরণের সংকট দেখা দিয়েছে, ঠিক সেই সময়েও কৃষক তার নিজস্ব সম্পদকে কাজে লাগিয়ে দেশের খাদ্য উৎপাদনে অবদান রাখছে। তাই স্থানীয় প্রকৃতি ও নিজস্ব সম্পদ ব্যবস্থপানায় সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সহায়তা বাড়াতে হবে। একই সাথে প্রকৃতিনির্ভর পরিবেশবান্ধব উৎপাদন ব্যবস্থার দিকগুলো নিয়ে জাতীয় পরিকলপনা তৈরী করতে হবে। যেখানে স্থানীয় এবং আঞ্চলিক ভিত্তিক দিকগুলো আলাদা করে গুরুত্ব দিতে হবে।