সুঁই সুতায় মীনা রানীর জীবন
সাতক্ষীরা শ্যামনগর থেকে মনিকা পাইক
বাংলার প্রাচীন ইতিাসের একটি অংশ হচ্ছে নকশিকাঁথা। যেখানে বাংলার গ্রামীণ ঐতিহ্য ও প্রকৃতির পটভুমি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। তবে কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে বাংলার ঐতিহ্য এই নকশীকাঁথার বুনন। কিন্তু কিছু মানুষের পরম ভালোবাসায় এখনো পাওয়া যায় নকশী কাঁথা। আর পরম ভালোবাসায় ধরে রাখা কিছু মানুষের মধ্যে একজন হচ্ছেন মীনা মন্ডল।
মীনা মন্ডল সিন্ধান্ত নেন, নকশী কাঁথা ফুটিয়ে তুলবেন সুঁই সুতো দিয়ে। প্রবল ইচ্ছাশক্তি নিয়ে তিনি এগিয়ে যেতে থাকেন স্বপ্ন পূরণের আশায়। মীনা মন্ডলের জন্ম বুড়িগোয়ালিনী ই্ঊনিয়নের মাঝের আইট গ্রামে একটি চাষি পরিবারে। বিয়ে হয় একই ইউনিয়নের আবাদচন্ডীপুর গ্রামে।
ইচ্ছে ছিল পড়াশোনা করে ভালো কিছু করার। তবে দারিদ্র্যের কষাঘাতে ধুলিসাৎ হয়ে যায় সেই স্বপ্ন। অভাব অনটনের সংসারে শেষ পর্যন্ত মাধ্যমিকের গন্ডিটা পেড়োনি হয়নি মীনার। তার ওপর আবার ১৮ বছর বয়সে তার বিয়ে হয়। পরবর্তীতে স্বামীকে বুঝিয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নেন মীনা। কিন্তু সংসার সামলে লেখাপড়াটা আর শেষ করা হয়নি। তার ওপর আবার বেকার স্বামী। মীনা নতুন করে স্বপ্ন দেখেন কিছু একটা করার। ছোটবেলায় মায়ের কাঁথা সেলাই দেখে নিজেও কিছুটা রপ্ত করেছিলেন।
মীনাা জানান, তিনি একটা প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন। এরপর সেখান থেকে কিছু টাকা ঋণ নিয়ে শুরু হয় তাঁর পথ চলা। শশুর বাড়িতে সব বাধা উপেক্ষা করেই শুরু হয় মীনার উদ্যোক্তা হওয়ার যাত্রা। প্রথমে প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন ও পরিচিত জনদের কাছ থেকে চাহিদা পেয়ে নিজ বাড়িতে প্রতিদিন নকশীকাঁথা সেলাই এ কর্মব্যস্ততা বেড়েছে মীনার। এরপর তাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
কখনো লাল কখনো সাদা কাঁথার উপর রঙিন সুতোতে ফুটিয়ে তোলেন নকশা। তিনি বলেন, ‘এসব কাঁথা আগে হাতে তৈরি করতাম। তাতে দেখা যায়, একটা কাঁথা সেলাই করতে আমার সময় লাগতো অনেক। কিন্তু সেলাই মেশিন কেনার পরে আমার এক সপ্তাহ লাগে একটা কাঁথা সেলাই করতে।’ সেলাই মেশিনটা তিনি আগে নকশীকাঁথা সেলাই করে টাকা জমিয়ে কিনেছিলেন। এখন তিনি বাড়িতে বসেই কাঁথার অর্ডার পান। কাঁথা বিক্রি করে এখন তার মাসে ৪-৫ হাজার টাকা আয় হয় ।
একদিন সমাজে মাথা নিছু করে চলতে হতো। দিন কাটতো অনাহারে। বাড়ি ঘর ছিল খুবই নাজুক। নকশীকাঁথার টাকা তাদের উন্নয়নের চাবিকাটি। কিছুটা হলেও স্বচ্ছলতা আনতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। এখন সবাই ডেকে কথা বলেন, সমাদার করেন, প্রসংশা করেন। তার কাজের অবসরে এ কাঁথা তৈরিতে গ্রামের অন্য নারীরা ধীরে ধীরে কাজ শিখতে ছুটে আসছেন।
মীনা দাবি করে বলেন, ‘আমাদের এলাকায় পরিশ্রমের তুলনায় মজুরি ও কাজের অর্ডার অনেক কম। সেই সাথে বাজারজাতকরণের কোন সুব্যবস্থা না থাকায় গ্রামের অধিকাংশ নারী এ কাজ থেকে পিছিয়ে আছেন। আমাদের এলাকায় নকশীকাঁথার প্রচলন কম থাকায় প্রচার না হওয়ায় আমার কাজের তেমন প্রসার ঘটেনি। ফলে কাজ করে যেটা পাই সেটা বেশি না।’ তিনি মনে করেন, সরকারি সহযোগিতা পেয়ে আরও বড় পরিসরে কাজ করতে পারলে নিজের কাজের পরিধি বাড়বে পাশাপাশি এলাকার আর ও অনেকেরই মেশিনে কাঁথা তৈরির মাধ্যমে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।