টিকে থাকার লড়াইয়ে গ্রামীণ সংস্কৃতির অবদান
নেত্রকোনা থেকে পার্বতী রানী সিংহ
মাটি পানি ও বাতাসকে পূঁজি করে আমাদের জীবন জীবিকা-আমাদের বৈচিত্র্য- আমাদের সংস্কৃতি গড়ে ওঠেছে। বহুজাতিক কোম্পানিরর প্রচারণা ও জলবায়ুর বিরুপ প্রভাব আমাদের জীবন জীবিকাকে, আমাদের বৈচিত্র্যকে, আমাদের সংস্কৃতিকে করছে বিচ্ছিন্ন। প্রকৃতিকে ভালো রাখলে আমাদের জীবন ও জীবিকা যে সুরক্ষিত রাখবে সেই ভাবনা আজ হারিয়ে যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। বেছে নিচ্ছি প্রকৃতিহীন জীবন। প্রকৃতি বিচ্ছিন্ন ভোগবিলাসী জীবন মানুষকে শুধু মানুষ থেকে মানুষকে নয় আমাদের সংস্কৃতি, বৈচিত্র্য থেকেও করছে বিচ্ছিন্ন। যা একদিকে যেমন পরিবেশের জন্যে মারত্মক বিপর্যয় ডেকে আনছে তেমনি মানুষের মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি ও মনুষত্বের অবক্ষয় ঘটাচ্ছে। টিকে থাকার লড়াইয়ে আমাদের লোকায়ত র্চচা,সংস্কৃতির অবদানকে অস্বীকার করে স্বপ্ন দেখেছে রাজত্ব করার।
নদীবিধৌত সমতল প্লাবন ভূমি আমাদের নেত্রকোনা অঞ্চল। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব, অপরিকল্পতি উন্নয়নে আজ এখানকার মানুষের জীবন ও জীবকিায় বারবার মানুষের জীবনে ডেকে আনছে চরম দারিদ্রতা, হারাচ্ছে পরিচয়, হারাচ্ছে জীবন জীবিকার ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রগুলো।
আটপাড়া উপজেলার স্বরমশিয়া ইউনিয়নের কৃষ্ণপুর গ্রামের আবুল মিয়া, স্ত্রী, এক ছেলে এক মেয়ে নিয়ে ৪ জনের সংসার তাঁর। কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। বসতবাড়ির ২ কাঠা জমি আর ৪টি গরু একমাত্র সম্বল। কৃষি কাজের পাশাপাশি ভ্যান চালিয়ে জীবন নির্বাহ করেন। আমন মৌসুমে ধান ফসলের খরচ কম বিধায় চলতি বছর আমন মৌসুমে নিজের ৫ কাঠা জমির সাথে ২৪ কাঠা জমি বন্ধকি নেন ধান চাষের জন্য। কিন্তু আশি^ন মাসের অকাল বৃষ্টিতে মাত্র ৫ কাঠা জমির ২০ মণ ধান ঘরে তুলতে পেরেছেন যেখানে পরিবারের জন্য ৬ মাসের খোরাকসহ ১০০ মণ ধান বিক্রি করতে পারতেন। বাকি ২৪ কাঠা জমির খড় গ্রামের মানুষরা গরুর খাবারের জন্য সংগ্রহ করেছেন। নিজের পরিবারের খাবারের যোগার করতে ব্যর্থ হন তিনি। তাছাড়া জমির চারা, হাল খরচ, শ্রমিক মজুরিটুকুও আজ ঋণের খাতায় যোগ হয়েছে।
তিনি বলেন, “দিনের পর দিন লস নিয়া ঋণ কইর্যা চলা কষ্ট। আমি কৃষি কাজের পাশাপাশি ভ্যান চালাই। কারণ ফসলকৃষি করে ৪ জন মানুষের খাওন জুটেনা। একটা সংসারে শুধু খাওন হইলে চলেনা, ঔষধ লাগে, পোলাপানের লেহাপড়ার খরচ লাগে।” জলবায়ুর বিরুপ প্রভাবে আজ ভিন্ন পেশা বেছে নিয়ে ভ্যান চালিয়ে ছেলে মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ, পরিবারের খাবার খরচ যোগাতে হচ্ছে। শুধুমাত্র কৃষ্ণপুর গ্রামের বাবুল মিয়া নয়; আটপাড়া উপজেলার স্বরমুশিয়া ইউনিয়নের সীতারামপুর, পুগলগাও, ছয়াশি, দূর্গাশ্রম গ্রামের বেশির ভাগ কৃষকের একই অবস্থা।
পুগল গাও গ্রামের রফিকুল ইসলাম বলেন, “আমাদের মত বেশির ভাগ গৃহস্থ্যদের একই অবস্থ। মেশিন দিয় ধান কাটায় যার কারণে গৃহস্থরা বসা। কারণ গৃহস্থরা তো অন্য কোন কাজ পারেনা। যাদের জমি কম তারা আগে ক্ষেতে টুকটাক কাজ করে সংসার চালাইত। এহন তো আর পারেনা। জমি চাষ করলেও ঘরে ধান, সবজি তুলা যায় না। গরিব আরো গরিব হইতাছে।”
দূর্গাশ্রম গ্রামের কৃষক হিরণ মিয়া বলেন, “বীজের দামসহ সবকিছুর দাম এত বাড়াইছে আমাদের আর সাহস হয় না গৃরস্থি করার। তারপরও অনেকে ২-৩ জন মিইল্যা বীজ কিনে সবজি করতাছে। গত ৪ বছরের মধ্যে গৃরস্থি (কৃষিকাজ) করইয়্যা ঋণ কইর্যা আশপাশের গ্রামের প্রায় ১০০ ঘর গ্রাম ছাইড়্যা ঢাহা, সিলেট, চিটাগাং গেছে কামের খোঁজে। অনেকে আবার ফিইর্যা আইতাছে যে কাম (কাজ) পায় সেই কাম পারেনা বইল্যা।”
বর্তমান সময়ে অর্থনৈতিক অসমতায় টিকে থাকার লড়াইয়ে খাদ্যযোদ্ধারা বারবার হেরে যাওয়ার পরও উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে নিজেদের সংস্কৃতিকে আকড়ে ধরে। আশি^নের অসময়ের বন্যার ক্ষত মুছতে চলতি বোরো মৌসুমের আবাদ খরচ কমিয়ে আনতে হাঙ্গার পদ্ধতিতে (এলাকার কৃষকদের যৌথ উদ্যোগ) জমিতে চারা রোপণ শুরু করেন। প্রতিবেশি কৃষকরা মিলে একজন অন্যজনের ক্ষেতে ধান রোপণ, বাছাই, ধানকাটার কাজে সাহায্য করেন। কাজ শেষে যে কৃষকের জমিতে কাজ করেছেন তার বাড়িতে প্রীতিভোজের আয়োজন হয়। কারন বর্তমান সময়ে কাঠা প্রতি শ্রমিক খরচ চারা রোপণে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। হাঙ্গার দেয়ার কারণে নিজেদের চাষ খরচ যেমন কমছে তেমনি পারষ্পাারিক আদান প্রদান ও সর্ম্পক উন্নয়নের একটি ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।
প্রকৃতির বৈচিত্র্যহীনতাই আমাদের বৈচিত্র্যহীনতার জন্যেই দায়ী। তাই সবার আগে বৈচিত্র্যঘেরা প্রকৃতিকে আমাদের সকলকে সম্মিলিতভাবে রক্ষা করা। প্রকৃতি যদি বৈচিত্র্যময় না হয় তবে সংস্কৃতিক, অর্থনীতিক,সামাজিক দৈন্যতা গ্রাস করবে আমাদের। এর জন্যে সকলের সম্মেলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। যে কোন দূযোর্গ মোকাবেলায় প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য, স্থানীয় মানুষের চর্চা, সংস্কৃতির অবদান যুগে যুগে স্বাক্ষ্য বহন করেছে। তারই ধারাবাহিকতায় আমাদের নেত্রকোনা অঞ্চলের গ্রামীণ সংস্কৃতির হাঙ্গার দেয়া অন্য এলাকার কৃষকদের যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলায় অনুপ্রেরণা যোগাবে।