জলবায়ু নীতি থেকে কর্পোরেট দূষণকারীরা দূর হও!
আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক নীতিমালা গ্রহণের ক্ষেত্রেও জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভর বহুজাতিক বাণিজ্যের ধ্বংসাত্মক প্রভাব রয়েছে। জাতিসংঘের জলবায়ু চুক্তিও এই বলয়ে আবদ্ধ। জলবায়ু চুক্তিকে অবশ্যই জীবাশ্ম জ্বালানি বাণিজ্যের এই থেকে সরে এসে নিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করতে হবে। বেসরকারি উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক পৃথিবীর বৈচিত্র্য, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সুরক্ষা প্রশ্নে অনেকের সাথে একাত্ম হয়ে এক নিরপেক্ষ জলবায়ু নীতির সপক্ষে দাঁড়িয়েছে। জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক কাঠামোর উপর বহুজাতিক কোম্পানির প্রভাব তলিয়ে দেখতে এক বৈশ্বিক গণতদন্তের জোর দাবি জানাচ্ছে জাতিসংঘের পক্ষ রাষ্ট্রসমূহের প্রতি।
বারসিক প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশের সকল বৈচিত্র্য ও পরস্পরনির্ভরশীল সম্পর্ক এবং সংস্কৃতির প্রতি আস্থাশীল। বারসিক তার সকল কর্মসূচিতে দেশের প্রতিবেশব্যবস্থা, প্রাণসম্পদের ভিন্নতা, জনজীবনের প্রাকৃতিক পরিবেশের নির্ভরশীলতাকে গুরুত্ব দিয়ে বৈচিত্র্য এবং অধিকার সুরক্ষাকে গুরুত্ব দেয়।
‘ব্যাপক কার্বণ নিঃসরণকারী বৃহৎ কোম্পানিগুলো যারা সবচে’ বেশি দূষণ ঘটাচ্ছে তাদের প্রভাবে তৈরি হওয়া সাম্প্রতিক প্যারিস জলবায়ু চুক্তি কোনোভাবেই বাংলাদেশসহ পৃথিবীর জলবায়ু সংকট মোকাবেলা করতে পারে না। জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক জার্মানির বনে অনুষ্ঠিতব্য সম্মেলনে বৃহৎ দূষণকারীদের মাধ্যমে সৃষ্ট সংকটকে চিহ্নিত করে এক নিরপেক্ষ জলবায়ু নীতি গ্রহণের জন্য আমরা বাংলাদেশের জনগণ হিসেবে সরকারের নেতৃবৃন্দের কাছে জোর দাবি জানাই’।
অপরিকল্পিত উন্নয়ন, প্রতিবেশগত বিশৃংখলা, পরিবেশগত বিপর্যয়ের পাশাপাশি আবহাওয়াগত পরিবর্তন বাংলাদেশের ঋতুবৈচিত্র্য এবং বাস্তুসংস্থানে এক বিরূপ প্রভাব তৈরি করছে। প্রাণবৈচিত্র্য হ্রাসসহ প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর তৈরি হচ্ছে নতুন সংকট। যা ক্রমান্বয়ে গ্রামীণ বসতি থেকে নগরে মানুষসহ নানা প্রাণীর টিকে থাকার সংগ্রামকে আরো জটিল ও দুর্বিষহ করে তুলছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে লবণাক্ততা, উত্তরাঞ্চলে খরা ও পানিশূন্যতা, পূর্বাঞ্চলে অকাল বন্যা ও পাহাড়ি ঢল, মধ্যাঞ্চলে জলাবদ্ধতা ও নদীভাঙ্গন এবং দেশব্যাপী অনিয়মিত বৃষ্টিপাত ও উষ্ণতার তারতম্য ক্রমেই বেড়ে চলেছে। দেশের প্রাণ ও প্রকৃতির বৈচিত্র্য এবং এর সাথে জড়িত জনজীবনের সম্পর্ককে গুরুত্ব না দিয়ে বহুজাতিক কোম্পানিরা বাংলাদেশের জীবাশ্ম জ্বালানি দখল এবং পরিবেশ সংক্রান্ত আইন ও নীতি লংঘনের ভেতর দিয়ে তৈরি করছে এক জটিল পরিবেশ সংকট। যা বৈশ্বিক জলবায়ু বিপর্যয়কে আরো তরান্বিত করছে। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে অক্সিডেন্টাল, ইউনোকল ও শেভরণ কোম্পানির গ্যাস খনন, ফুলবাড়িতে নাইকো কোম্পানির প্রস্তাবিত উন্মুক্ত কয়লা খনি দেশের জীবন ও বৈচিত্র্যকে এক দীর্ঘ সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের ২১তম জলবায়ু সম্মেলনে গৃহীত ‘প্যারিস জলবায়ু চুক্তি’ ইতোমধ্যেই স্বাক্ষর করেছে পক্ষ রাষ্ট্রসমূহ। বৈশ্বিক জলবায়ু সন্ধিতে অনেক রাষ্ট্রের সম্মতিদান হিসেবে এটি এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের সূচনা করলেও পৃথিবীর সামগ্রিক জলবায়ু সংকট কোনোভাবেই এই চুক্তির ভেতর দিয়ে মোকাবেলা করা সম্ভব নয় বলে এই চুক্তি নানাভাবেই সমালোচিত হচ্ছে। জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সংস্থার প্রতিনিধিরা প্যারিস জলবায়ু চুক্তির প্রতি সকলের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য আগামী ১৬ মে জার্মানির বনে জলবায়ু বিষয়ক এক সভায় মিলিত হচ্ছেন।
করপোরেট একাউন্টিবিলি ইন্টারনাশনাল সংগঠনের প্যাট্টি লিনের ভাষ্য, প্যারিস জলবায়ু চুক্তির’ মাধ্যমে খুব বেশি দূর যাওয়া সম্ভব নয়। পৃথিবীকে টিকিয়ে রাখবার স্বার্থে এখনই যদি আরো জোরালো পদক্ষেপ না নেয়া হয় তবে বৈশ্বিক উষ্ণতা আরো বাড়বে এবং জলবায়ু সংকট আরো ঘনীভূত হবে। জাতীয় সরকারগুলোকে প্যারিস জলবায়ু চুক্তির চেয়েও বেশি কিছু ভাবতে হবে এবং আরো সক্রিয় ভূমিকা নিয়ে বৃহৎ তেল, গ্যাস, কয়লা কোম্পানিগুলোকে জাতীয় উন্নয়নের ধারা থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করতে হবে। এসব বহুজাতিক বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানগুলো আঞ্চলিক থেকে আন্তর্জাতিক সকল পর্যায়ের সভা এমনকি অর্থনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার ক্ষেত্রেও প্রভাবিত করে। কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর ভেতর সমন্বয় এবং খবরদারি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার নিরপেক্ষ চুক্তি গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রাথমিক বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। জাতিসংঘের সকল জলবায়ু সম্মেলনে এটি দেখা গেছে। পোল্যান্ডের ওয়ারশতে অনুষ্ঠিত ১৯তম জলবায়ু সম্মেলনে কর্পোরেট কোম্পানিরা শুধুমাত্র জলবায়ু চুক্তি গ্রহণকেই বাধাগ্রস্ত করেনি বরং তারা তাদের পছন্দমত প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ করিয়েছে। জলবায়ু আলোচনার ক্ষেত্রে বহুজাতিক এসব কোম্পানির খবরদারি এতটাই বেড়েছে যে, সর্বশেষ ২১তম প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে বহুজাতিক কোম্পানির প্রভাব ছিল এক বড় দুঃশ্চিন্তার বিষয়। জলবায়ু সম্মেলনটি মূলতঃ শেষমেষ ভয়াবহ মাত্রায় কার্বণ নিঃসরণকারী অসংখ্য বহুজাতিক কোম্পানির অর্থায়নে অনুষ্ঠিত হয়। দেখা গেছে জলবায়ু সম্মেলনের প্রায় সকল সভাতেই বহুজাতিক কোম্পানির খবরদারি ছিল।
আজ আমরা বিশ্বব্যাপী গড়ে ওঠা জনআন্দোলনের সাথে একাত্ম হয়ে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক বৈশ্বিক চুক্তি ও নীতিগ্রহণ প্রক্রিয়া থেকে সকল বহুজাতিক কোম্পানিকে সরে যাওয়ার জোর দাবি তুলছি। ২০১৫ সনের মে মাসে পৃথিবীব্যাপী প্রায় ৫,৭০,০০০ মানুষ এই ডাকে সাড়া দিয়ে জলবায়ু ন্যায্যতার দাবি তুলেছে, জলবায়ু নীতি থেকে বৃহৎ দূষণকারীদের সরে যেতে বলেছে।
এ বিষয়ে পিটিশনটি দেখুন: www.KickBigPollutersOut.org