তাঁরাও আলোকিত হতে চান
রাজশাহী থেকে মোঃ শহিদুল ইসলাম
“ভোট আসলে আমাদের কদর বাড়ে, যারা নির্বাচন করে তারা অনেক খাতির দেখায় তখন। আমার ভাঙা এই ঝুপড়ি ঘরে স্যাঁতস্যাঁতে আর ময়লা আবর্জনায় বসতেও তখন তাঁদের কোন ঘৃণা দেখা যায় না। সুন্দর সুন্দর কথা আর নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট চায়। আমারও ভোট দেই সেই প্রতিশ্রুতির পাল্লায় পড়ে,অনেকে নির্বাচিত হন। পরে আর কোন খোঁজ খবর নেননা। কি হালে থাকি আমরা, কতো কষ্টে দিন কাটে, আর কেউ আসে না। কোন সময় হঠাৎ করে কোন বিষয়ে আসলেও তারা রাস্তা থেকেই কথা বলে চলে যান, আমার ঝুপড়ির স্যাঁত স্যাঁতে জায়গায় বসে আর প্রাণ খুলে কথা কননা, আমার দুঃখগুলোও আর শুনেন না।” কথাগুলো বলছিলেন রাজশাহীর বোয়ালিয়া থানার নামোভদ্রা পাড়াবাসি রিকসা চালক আনোয়ার হোসন (৮১)।
রাজশাহীর বোয়ালিয়া থানার অর্ন্তগত ২৬ নং ওয়ার্ডে বসবাস করেন প্রায় ২৫০টি ভূমিহীন পরিবার। প্রায় ৪০ বছর আগে থেকে এখানে রাস্তার দুই ধারে সরকারি খাস জায়গায় বসবাস শুর করেন পরিবারগুলো। প্রতিটি পরিবারের সাথে মিশে আছে দুঃখ আর দুর্যোগের নির্মম গল্প কথা। চরম দুর্যোগ আর দুঃখে ভরাক্রান্ত আবেগ নিয়ে মো. আনসার আলী (৭০) বলেন, “দেশ স্বাধীন হওয়ার তিনবছর পরেই তিস্তা নদীর ভাঙনের শিকার হয়ে সর্বস্ব হারিয়ে রংপুর থেকে কাজের আশায় বাচ্চা-কাচ্ছা নিয়ে রাজশাহীতে পাড়ি দেই। রিকসা চালিয়ে, মানুষের মুদি দোকানে কাজ করে জীবন নির্বাহ করি। অভাবে দিনে দিনে গায়ের শক্তি কমে গেছে, শরীরের শক্তি দিয়ে আর কাজ করতে পারিন না। কোনমতে দিন পার করছি।” তিনি আরো বলেন, “১৯৮০ সালের আগে থেকে আমরা এখান ভোটার এবং নাগরিক, কিন্তু আজো কোন নাগরিক সুবিধা পাইনা আমরা ”।
রাস্তার দুই ধারে বসবাসরত পরিবারগুলো ঝুপড়ির মধ্যে স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে বসবাস করে। নেই কোন বিদ্যুৎ সুবিধা, আছে সুপেয় পানির অভাব। শহরের আলোকিত আর হাজারো সুযোগ সুবিধার ভিতরে থেকেও পাড়ার এই বাসিন্দারা কোন সুযোগ সুবিধাই ভোগ করতে পারেন না। অভাবের কারণে শিশুরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে, কলকারখানায় কাজ করছে। জ্বালানির সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ায় নারী এবং শিশুদের সবসময় বিভিন্ন রোগবালাই লেগেই আছে। দারিদ্র্যতাকে বিদায় করার আশা নিয়ে ক্ষুদ্র ঋণের শরণাপন্ন হয়ে অনেকেই এই ঋণের মায়াজালে আটকে পড়েন আছেন। সপ্তাহান্তে বা মাসে ঋণের কিস্তি পরিশোধ ও কিস্তি আদায়কারীর কর্কশ স্বর বাড়ায় শারীরিক ও মানসিক জ্বালা-যন্ত্রণা!
অন্যদিকে নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে কিছু পরিবার আছে যারা ঘরকে আলাকিত করা এবং কষ্টকর জীবনে সাময়িক বিনোদনের জন্য মাসে ৬ থেকে ৭শ’ টাকা ব্যয়ে ছোট বাতি দিয়ে ঘরকে আলোকিত করেন ভাড়া করা ব্যাটারির মাধ্যমে। এই প্রসঙ্গে পাড়াটির বাসিন্দা মোছাঃ রোকসানা বেগম (৩৪) বলেন, “একটা ছোট এনার্জি বাল্ব, অনেকসময় প্রয়োজনীয় আলো দিতে পারে না, আবার ১২ ভোল্টের একটি টিভি চালানোর জন্যে একটি ব্যাটারি প্রতিদিন দিনভিত্তিক ২০ থেকে ২৫ টাকায় ভাড়ায় নিতে হয়। অনেক কষ্ট করে হলেও ছেলেদের বিনোদনের জন্যে এই ভাড়া ব্যাটারি নিয়ে এসে দুধের সাধ ঘোলে মেটানোর চেষ্টা করি।” তিনি আরও বলেন, “ আমার ঘরের উপর দিয়েই বিদ্যুতের লাইন গেছে, কিন্তু আমরা বিদ্যুৎ পাই না। আমাদের দুঃখগুলো শোনার লোক নেই এখন, যা ছিলো নির্বাচনের সময়! আমাদের সমস্যাগুলো সমাধানে এগিয়ে আসার কেউ নেয়।”
নামোভদ্রা পাড়াটিতে মোট বিধবা ৮ জন, বয়স্ক নারী পুরুষ ২৫ জন, প্রতিবন্ধী নারী পুরুষ ১২ জন, গর্ভবতী আছেন ৩ জন। এই মানুষগুলো এ পর্যন্ত কেউ কোন ধরনের ভাতা পাননি। বিধবা, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধীদের জন্য সরকার ভাতা চালু করলেও অদৃশ্য কারণে এই পাড়ার কোন বয়স্ক, বিধবা বা প্রতিবন্ধী এখনও এই ভাতার আওতায় পড়েননি! অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রান্না বান্না করার কারণে নারী ও শিশুসহ বয়স্কদের শ্বাসকষ্ট, হাঁপানিসহ চর্মরোগ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। এইসব রোগে আক্রান্ত হয়ে কম আয়ের এই মানুষগুলোকে অনেক কষ্ট করতে হয়। চিকিৎসার জন্য তাই ঋণ নেন অনেকে। এই প্রসঙ্গে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মোঃ সুলতান মিয়া বলেন, “শুনছি আমাদের পাড়ার মানুষগুলো আমাদের সমস্যা নিয়ে বিভিন্নখানে যোগাযোগের চেষ্টা করছে। এভাবে আমাদের সমস্যাগুলো যদি আমারা বিভিন্নভাবে বিভিন্ন মাধ্যমে তুলে ধরি তাহলে হয়তো সমাধানের উদ্যোগ নিতে পারে কর্তৃপক্ষ।”
নামোভদ্রার সুবিধাবঞ্চিত মানুষগুলো অবশেষে নিজের নাগরিক অধিকার আদায়ে নিজেরা এক হয়েছেন। নিজেদের জ্বালানি সুবিধাসহ বিভিন্ন নাগরিক সুবিধা আদায়ে সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের সাথে আলোচনা ও সংলাপের মাধ্যমে তাঁদের সমস্যাগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করছেন। সাংবাদিক মিডিয়া ব্যক্তিত্ব তাদের সমস্যাগুলো নিয়ে নানাভাবে সহায়তাও করছেন। তাদের এই উদ্যোগ নিশ্চয়ই আলোকিত করবে তাদের!