হারিয়ে যাচ্ছে মৃৎ শিল্পের পণ্যসামগ্রী
মানিকগঞ্জ থেকে নজরুল ইসলাম
মানিকগঞ্জ জেলার প্রধান কুটির শিল্পের মধ্যে মৃৎ শিল্প অন্যতম। এই শিল্প মানুষের রুচিবোধ, নান্দনিকতা এবং ব্যবহারিক প্রয়োজন মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। জেলার বিভিন্ন স্থানে প্রায় দেড় শতাধিক পরিবার প্রত্যক্ষভাবে এই শিল্পের সাথে জড়িত। মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার পালড়া, সানমান্দা, নবগ্রাম, শিবালয় উপজেলার মহাদেবপুর, বতুনি, হরিরামপুর উপজেলার নালী, লাউতা, ঝিটকা, গোপীনাথপুর, ঘিওর উপজেলার জাবরা, কালাচানপুর এবং সাটুরিয়া উপজেলার তিল্লি,দৌলতপুরের খলসি গ্রামে এই শিল্পিদের বসবাস ও কার্যক্রম বিদ্যমান রয়েছে। এই শিল্পগুলো পূর্ব-পুরুষদের মাধ্যমে পরিবারভিত্তিক এবং পাড়াভিত্তিক গড়ে উঠেছে। মৃৎ শিল্পের শিল্পীরা ‘পাল’ নামে সমধিক পরিচিত। পাল সম্প্রদায়েরা যেসব পণ্যসামগ্রী তৈরি করেন মাটি দিয়ে সেগুলো মধ্যে অন্যমত হলো: মাটির হাড়ি, কলসি, বাসন, সানকি, পাতিল, মুড়িভাজার রাইং, ঝাইঝড়, দইয়ের পাতিল, বাটি, গাছা, হাতনা, সরা, পিঠা তৈরির ছাচ, মাটির ব্যাংক প্রভিতি। সৌখিন সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে-পুতুল, খেলনা, ফুলদানি, ছাইদনি, কলমদানি প্রভৃতি এবং ধর্মীয় ব্যবহৃত জিনিসের মধ্যে রয়েছে দেব দেবীর মূর্তি, লক্ষ্মীর সরা, পুতুল, ধুপদানি, ইত্যিিদ।
জেলার সবচেয়ে বড় পাল পাড়া বলে পরিচিত পালড়া গ্রাম। এই গ্রামে প্রাচীনকাল থেকে পাল সম্প্রদায়েরা বসবাস করে আসছেন। সম্ভবত এজন্য এই গ্রামের নামকরণ পাল সম্প্রদায়ের নামের সাথে মিলিয়ে করা হয়েছে পালড়া। বর্তমানে এই গ্রামে ১৫টি পরিবার প্রত্যেক্ষভাবে এই কাজের সাথে যুক্ত আছেন। এই প্রসঙ্গে এই গ্রামের মৃৎ শিল্পী সুনিল পাল (৬৫) জানান, এই পেশার সাথে কত পুরুষকাল পর্যন্ত যুক্ত সেটি তাদের জানা নেই। তার মতে, হাজার হাজার বছর পূর্ব থেকেই তারা এই পেশার সাথে যুক্ত। তিনি বলেন, “আমরা আমাদের দেব দেবীর গলার মালা তৈরির মধ্যে দিয়ে এবং তাদের পূজা অর্চনার মধ্যে দিয়ে ব্যবহৃত ঘট তৈরির মাধ্যমেই মনে হয় এই শিল্পে উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে।” মৃৎ শিল্পের সাথে বাড়ির নারী পুরুষ সবাই এই কাজের সাথে যুক্ত।
তবে মাটি সহজে পাওয়া যায় না বলে বর্তমানে এই শিল্পের সাথে জড়িত মানুষের জীবন-জীবিকা বিপন্নতার দিতে ধাবিত হচ্ছে। এছাড়া বাজারে প্লাস্টিক পণ্যের প্রসার ও সহজলভ্যতার কারণে মানুষ মৃৎ শিল্পের পণ্যগুলোর প্রতি দিনকে দিন আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। ফলশ্রুতিতে অতিশ্রমের তৈরি পণ্যের বাজার না থাকায় পাল সম্প্রদায়ের জীবিকায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এছাড়া জ্বালানি সঙ্কটের কারণে এই পণ্য তৈরির কাজও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এই প্রসঙ্গে ঘিওর উপজেলার জাবরা গ্রামের গৌড় পাল (৮৮) বলেন, “এখন আগের মত মাটি সহজেই পাওয়া যায় না। টাকা হলেও মাটি পাওয়া যায় না এখন। এই শিল্পকে বাঁচানোর জন্য বড় পুঁজির দরকার।” তিনি আরও বলেন, “এই ব্যবসায় আমাদের ছেলেমেয়েরা করতে নারাজ। কারণ এ ব্যবসায় তারা কোন লাভ করতে পারেন না। ফলে ইচ্ছা থাকলেও এ পেশাকে আর টিকিয়ে রাখতে পারছি না মনে হচ্ছে।” দেবেন্দ্র পাল (৮০) বলেন, “জ্বালানির বড় অভাব। আগে খেঁজুর গাছ ছিল প্রচুর। গ্রামে খেঁজুরের ডাইগা কিনতাম। এছাড়া প্রচুর ধানের নাড়াও ছিল। কৃষকরা আমাদের বাড়িতে আসতো বিক্রি করতে। আমরা সহজে কিনতে পারতাম।” তিনি বলেন, “নাড়ায় পোড়া পণ্য অনেক ভালো ও মজবুত হয়।” তিনি জানান, এখন সরিষার ডাগা, খেসারি, মসুরি, ছোলার ডাগা আর নেই। এলাকায় ভুট্টার এবং তামাকের আবাদ বৃদ্ধি পাওয়ার থেকে ওইসব শস্যগুলোর চাষ কমে গেছে। এতে করে জ্বালানির সমস্যাও প্রকট আকার ধারণ করে।
মৃৎ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন নতুন প্রজন্মকে এ বিষয়ে আগ্রহী করে তোলার। কিন্তু এই শিল্পের পণ্যের কদর বাজারে কম থাকায় এবং অন্যান্য পেশারয় বেশি লাভজনক হওয়ায় নতুন প্রজন্মরা এই পেশায় আসতে চায় না। এই প্রসঙ্গে মহাদেবপুর গ্রামের শ্রীদাম পাল (৬০) বলেন, “এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা অন্য পেশায় যুক্ত হচ্ছে। অনেকে বিদেশে যাচ্ছে।” পালড়ার পুষ্প রাণী পাল বলেন, “ছেলেমেয়ররা এখন স্বর্ণ অলংকার পেশায় যুক্ত হচ্ছে। মৃৎ শিল্পের পেশায় খাটুনি বেশি কিন্তু লাভ কম। এছাড়া মাটির অভাবের কারণে পরিবারে কেউ আগ্রহ করে কাজ শিখতে চায় না। তাই আগামীতে কারিগড়ের অনেক সংকট দেখা দিবে।” ঘিওর উপজেলার কাউটিয়া গ্রামের কৃষক মকর আলি ঠাকুর বলেন, “আগের দিনে দেখতাম পালোরা পাইচা মাথায় করে ফেরি করে হাড়ি, পাতিল, বাসন, কোসন ইত্যাদি বিক্রি করত। বিশেষ করে বিভিন্ন শষ্যের মৌসুমে পালোরা আসত এসব বিক্রি করতে। তখন কৃষাণ-কৃষাণীর মুখে হাসি থাকত। সেদিন আর নেই।” জাবরার গৌড় পাল বলেন, “সারাজীবন কাজ করছি পরিবারের অভাব পূরণের জন্য, মানুষের চাহিদা পূরণের জন্য এবং সমাজের কল্যাণ করার জন্য। তবে পাইনি পরিবার, সামাজ-রাষ্ট্র থেকে কোন সম্মান ও স্বীকৃতি।”
উল্লেখ্য যে, এই শিল্পের প্রধান উপাদান কাদা মাটি। এগুলো তৈরিতে সাধারণত এটেল জাতীয় মাটি ব্যবহার করা হয়। যাদের আশেপাশে মাটি নেই তারা অন্য এলাকা থেকে এ মাটি ক্রয় করেন। এই পণ্য উৎপাদনের জন্য মাটি ছাড়াও অন্যান্য উপাদান তথা বালু, খড়, জ্বালানি, রঙ, চাকা প্রভৃতির প্রয়োজন হয়। এই শিল্পের বিপন্নতার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে মূর্তি তৈরির খ্যতিমান পালড়া গ্রামের বিষœ পাল বলেন, “এই শিল্প বর্তমানে আধুনিক কারখানার ধাতব ও প্লাস্টিক সামগ্রীর সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। মাটির জিনিসের পরিবর্তে মানুষ বর্তমানে এ্যলুমিনিয়ামের তৈরি তৈজসপত্র ব্যবহার করছেন। মাটির হাড়ি, পাতিল, বাসন কোসনের ব্যবহার অনেক কমে গেছে।”