লেঙ্গুড়া গণেশ্বরী স্বনির্ভর বাঁধ: লোকায়ত পদ্ধতিতে নদীর পানির সর্বোত্তম ব্যবহার
কলমাকান্দা, নেত্রকোণা থেকে অর্পণা ঘাগ্রা
পাহাড়ি অঞ্চলের কৃষকের কৃষিকাজ অনেকাংশে প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নির্ভরশীল। প্রকৃতি সহায় হলে কৃষক একই জমির বহুমাত্রিক ব্যবহার করতে পারেন বছরব্যাপী। আর প্রকৃতি বিরূপ হলে মাত্র একটি (আমন) ফসল চাষ করে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। আবার কোন কোন জমি সারাবছর পতিত রাখতে হয়। কারণ পাহাড়ি অঞ্চলে সেচ যন্ত্র (টিউবওয়েল বা স্যালো টিউবওয়েল) বসানো সম্ভব হয় না। তাই নদী বা ছড়ার (ঝর্ণা) পানিই সেচের একমাত্র উৎস। পাহাড়ি অঞ্চলে রয়েছে ছোট বড় অনেক ছড়া ও নদী। এসব নদী ও ছড়ার পানি গৃহস্থলী, সেচ ও অন্যান্য কাজের জন্য মানুষ সারাবছর ধরে ব্যবহার করেন। এই ছড়াই পানির চাহিদা পূরণ করার একমাত্র উপায়। কিন্তু বর্তমানে বেশির ভাগ ছোট ছোট ছড়া ও নদীগুলো ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত শুকনো থাকে। অথচ এই সময়ই বোরো ধানে সেচের উপযুক্ত সময়। সেচের উৎসগুলো যেখানে অকেজো থাকে সেখানকার কৃষিজমি পতিত থাকে। কিন্তু জমিতে ফসল ফলানোর তাগিদ কৃষকদের সংগ্রামী করে তোলে। আবিষ্কার করে স্থানীয় প্রেক্ষাপটে লোকায়ত পদ্ধতি। তেমনি একটি পদ্ধতি হচ্ছে নদীতে মৌসুমী বাঁধ দিয়ে বোরো মৌসুমে ধানের জমিতে সেচ দেওয়া।
নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা উপজেলার লেঙ্গুড়া, খারনৈ ও রংছাতি ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রাম সীমান্ত অধ্যূষিত। এসব অঞ্চলের বোরো চাষীদের সেচ সমস্যা সমাধানের অন্যতম উৎস পাহাড়ি ছড়া ও নদীর প্রাকৃতিক পানি। ভারতের মেঘালয় পাহাড়ের কয়েকটি ঝর্ণা একত্রে মিলিত হয়ে বাংলাদেশের একেকটি নদীতে মিলিত হয়ে নদীকে ¯্রােতস্বীনি করে তোলে। এমনই একটি নদী গণেশ্বরী নদী।
এই নদীর তীরে লেঙ্গুড়া ইউনিয়ন অবস্থিত। এই নদীর বাঁধের পানি বোরো চাষীদের উৎপাদন খরচ কমাতে অনেক ভূমিকা রাখে। ১৯৮২ সাল থেকে এই নদীর উপর বাঁধ দেওয়া শুরু হয়। সেই সময় কৃষি জমিগুলোতে শুধুমাত্র বাইন করে আউশ ধান চাষ করা। তাই অধিকাংশ জমি বছরের অধিকাংশ সময় পতিত থাকতো। পতিত জমিগুলো চাষের আওতায় আনার জন্য কয়েকজন স্থানীয় কৃষক (মো. শীয়ত আলী (মৃত), আ: সাত্তার মোড়ল (মৃত), বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মান্নান (মৃত), শহর উদ্দিন মোড়ল (মৃত) প্রমুখ) নদীতে বাৎসরিক ভিত্তিতে বাঁধ দিয়ে প্রাকৃতিক পানি দিয়ে চাষাবাদ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তখনকার সময় মাত্র ৩৫০০/- টাকা খরচ হতো বাঁধ দেওয়ার জন্য। সেই থেকে পর্যায়ক্রমে এখন পর্যন্ত প্রতিবছর নদীতে শীত মৌসুমের বাঁধ দেওয়া হয়।
যারা শুরু করেছিলেন তারা আজ থেকে প্রায় ৮-১২ বছর পূর্বেই মারা গেছেন। কিন্তু তাদের সন্তানেরা তাদের এই উদ্যোগকে টিকিয়ে রেখেছেন। যেহেতু স্থানীয় কৃষকদের স্থানীয় অবস্থার প্রেক্ষিতে বাঁধটি তৈরি করা হয়েছে তাই বাঁধের নাম দেওয়া হয়েছে লেঙ্গুড়া গণেশ্বরী স্বনির্ভর বাঁধ। এটিই ছিল এই অঞ্চলের প্রথম বাঁধ। পর্যায়ক্রমে বাঁেধর সংখ্যা বাড়ছে। বর্তমানে কয়েকটি নদী ও ছড়ার (কাউবাড়ী ছড়া, মঙ্গলস্বরী নদী, বাউশাম নদী, পাঁচগাও নদী, চন্দ্রডিঙ্গা ছড়া, পাতলাবন ছড়া) উপর বাঁধ দিয়ে বোরো ধান চাষ করা হচ্ছে। বাঁধ তৈরির এই পূর্ব ইতিহাসটি জানালেন মোহাম্মদ আনোয়ার পাশা, মেম্বার, ১নং লেঙ্গুড়া ইউনিয়ন পরিষদ ও বাঁধ কমিটির সেক্রেটারি। তিনি তার বাবার কাছ থেকে এই ইতিহাসটি জেনেছিলেন।
প্রতিটি বাঁধ পরিচালিত হয় একটি কমিটির মাধ্যমে। লেঙ্গুড়া গনেশ্বরী স্বনির্ভর বাঁধের বর্তমান সদস্য সংখ্যা বর্তমানে ১০০ জন কৃষক। তার মধ্যে ১১ জন সদস্যকে নিয়ে কার্যকরী কমিটি গঠিত হয়েছে। প্রতিবছর নতুন করে এই কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটি বাঁধ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকে। তবে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের কাছ থেকে বাঁধ তৈরির জন্য অনুমোদন নিতে হয়। ডিসেম্বর মাস থেকেই বাঁধ তৈরির কাজ শুরু হয় এবং বৃষ্টি শুরু হলেই অর্থাৎ মে-জুন মাসের মধ্যেই বাঁধ কেটে দেওয়া হয়- স্বাভাবিক পানি প্রবাহ অব্যাহত রাখার জন্য।
এই বাঁধটির দৈর্ঘ্য ২৩৫ফিট, প্রস্থ ৪০ ফিট, উচ্চতা ১৫ ফিট। পানি সঠিকভাবে সরবরাহ করার জন্য কৃষকদের নেতৃত্বে কয়েকটি ব্লক ভাগ করা থাকে। কার্যকরী কমিটি প্রত্যেকটি ব্লকের জন্য ২-৩ কি:মি: পর্যন্ত বড় ড্রেন তৈরি করে দেয়। তারপর কৃষদের দায়িত্বে যতদুর পানির প্রয়োজন ও পানি যাবার মত অবস্থা থাকে এবং যদি কোন কৃষক পানি নিতে ইচ্ছুক থাকে তাহলে তাদের নেতৃত্বেই ড্রেন তৈরি করে পানি নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। বাঁধ নির্মাণের জন্য বর্তমানে প্রায় ৫ লক্ষ টাকা খরচ হয়। প্রতি কৃষককে আড়া (১আড়া=১৬ কাঠা) প্রতি ৮০০-১০০০/- টাকা দিতে হয়। যাদের জমি বাঁধের কাছে তারা ৮০০/- টাকা এবং যাদের জমি বাঁধ হতে দূরে তাদেরকে ১০০০/- টাকা দিতে হয়।
এই ইউনিয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপসহকারী কৃষি অফিসার সৌহার্দ্য দারিং বলেন, “এই ইউনিয়নের প্রায় ৩২টি গ্রামের ৩৫০০ হেক্টর জমি আছে। তার মধ্যে ২৬৭৭.৫ হেক্টর কৃষি জমিতে বোরো আবাদ হয়। বাকিগুলো বনভূমি ও উচ্চভূমি। অধিকাংশ জমিই বাঁধের পানি দিয়ে চাষ হয়। এছাড়াও খারনৈ ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম ও দূর্গাপুর উপজেলার চন্ডিগড় ইউনিয়ের কয়েকটি গ্রামের কৃষকও এই বাঁেধর পানি দিয়ে সেচ দেয়।”
বাঁধের পানি দিয়ে সেচ দেওয়ার সব থেকে সুবিধা হলো একই সময়ে সব কৃষকের কৃষি জমিতে পানি অনবরত চলে যায়। যদি কারো পানির প্রয়োজন না থাকে তাহলে ড্রেনের নালাটি বন্ধ করে দিলেই হয়। লেঙ্গুড়া গ্রামের কৃষক হাসান মিয়া জানান, “বাঁধ না থাকলে আমাদের জমিগুলো পতিত পড়ে থাকতো। বোরো ধান লাগানো থেকে কাঁটার আগ পর্যন্ত কোন সময় কোন কৃষককে পানির জন্য সমস্যায় পড়তে হয় না। না চাইতেই পানি জমিতে চলে আসে।” তিনি আরো জানান, “পানির জন্য কারো কাছে যাইতে হয় না। কাউকে তাগিদ দিতে হয় না। সেচের জন্য খরচ কম হওয়ায় বোরো ধান উৎপাদনের জন্য খরচও অনেক কম। এর জন্য বোরো চাষ কইরা আমরা লাভবান হই।”
লেঙ্গুড়া ইউনিয়নের দক্ষিণ দিকের কৃষিজমি একটু উচু হওয়ায় এই দিকের কয়েকটি গ্রামের কৃষি জমিতে বাঁেধর পানি পৌঁছায় না। এই এলাকার এয়ারপুর গ্রামের কৃষাণী সঞ্জিতা বেগম এই বছর এক আড়া (১৬ কাঠা) জমিতে বোরো আবাদ করছেন স্যালোমেশিনের পানি দিয়ে। সেচের ক্ষেত্রে তার খরচ হয় মেশিন ভাড়া বাবদ ৫৪০০ টাকা এবং ডিজেল বাবদ ৫০০০ টাকা সহ মোট ১০৪০০ টাকা। তিনি বলেন, “শুধু টাকা দিলেই কিংবা ডিজেল থাকলেই পানি পাওয়া যায় না। পানির জন্য সিরিয়াল দিতে হয়। একজনের জমিতে পানি না ভরা পর্যন্ত আরেকজন কৃষককে অপেক্ষা কইরা থাকতে হয়। তিন-চারদিনও অপেক্ষা করা লাগে।” তিনি আরো বলেন, “এই কারণে ধান সময় মত লাগাইতে পারি না। ধান লাগানোর পরও সময়মত পানি না পাইয়া মাটি শক্ত হইয়া যায়। ধান গাছ হলুদ হইয়া যায়তে শুরু করে। ধান গাছে যখন ফুল আসে সেই সময় পানি না পাইলে ফলন কম হয়। গত বছরও ফলন কম পাইছি। বোরো কইরা কোন লাভ হয়না। কিন্তু জমি পতিত রাখলে জমিতে বিন্না জন্মায়, জমি নষ্ট হয়। বোরো কইরা লাভ না হইলেও জমি ভাল রাখার লাইগা ধান করি”।
বটতলা গ্রামের কৃষক তারা মিয়ার একটি স্যালো মেশিন আছে। তিনি নিজেও বোরো আবাদ করেন এবং অন্যদের জমিতেও পানি দেন। তিনি বলেন, “আমি সব সময় টেনশনে থাকি। সময়মত কোন কৃষককে পানি দিতে না পারলে অনেক কৃষক গালি দেয়। ঝগড়া করতে হয়। মানুষের সাথে সম্পর্ক খারাপ হইয়া যায়। মেশিন সব সময় ভালো থাকেনা। একটা মেশিন দিয়া ৮-৯ আড়া জমিতে পানি দেওয়া যায়। কিন্তু মেশিন একবার নষ্ট হইয়া গেলে অনেক টাকা লাগে ঠিক করতে। আবার সময়ও লাগে কয়েকদিন।” তিনি আরো বলেন, “সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয় আশ্বিন মাসে। এই সময় মাটির নিচে পানির লেয়ার পাওয়া যায়না। এখন ৭-৮ ফুট গভীর করলে পানি পাই। কিন্তু ঐ সময় প্রায় ১০ ফুট করা লাগে। তারপরও ঠিকমত পানি মিলাইতে পারিনা। এই সময় আমার দুশ্চিন্তা আরো বাইরা যায়। সবাই বাঁধের পানি পাইলে এই সমস্যা হইতো না।”
লেঙ্গুড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাঈদুর রহমান ভূইয়া বলেন, “গণেশ্বরী নদীটি আমাদের জন্য আল্লাহর আশীর্বাদ। একটি বড় সম্পদ। এই নদী যদি আমাদের পানি উপহার না দিত তাহলে সেচের জন্য কৃষককে উচ্চমূল্য খরচ করতে হতো।” বীজ, সার এর সাথে সেচের খরচ যতো বেশি হবে উৎপাদন খরচও বৃদ্ধি পাবে ততবেশি। তাছাড়া ভূগর্ভস্থ পানি খরচ করতে হচ্ছে না। তাই পরিবেশ ও প্রাকৃতিক দূর্যোগ প্রশমনেও এটি সহায়ক হচ্ছে। পরবর্তী প্রজন্মের জন্যও আর কিছু না হউক মাটির নিচের পানি রেখে যেতে পারবে।
সবেশেষে চেয়ারম্যান যেসব অঞ্চলের নদীগুলো মানুষ দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, নদীগুলো মারা যাচ্ছে সেই সব নদীগুলো সংরক্ষণের আহবান জানান। পাশাপাশি নদীর প্রাকৃতিক পানি ব্যবহার করে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ভূগর্ভস্থের পানি মজুদ রাখারও পরামর্শ প্রদান করেন।