সাম্প্রতিক পোস্ট

জ্বালানি সাশ্রয়ী চুলার উদ্ভাবন জ্বালানি সংকট মোকাবেলার অন্যতম হাতিয়ার

মানিকগঞ্জ থেকে নজরুল ইসলাম:
যখন মানুষকে দুনিয়াব্যাপী জ্বালানি সংকট ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবেলা করতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত এবং নতুন নতুন গবেষণার মাধ্যমে বিকল্প জ্বালানির সন্ধান বের করা হচ্ছে। ঠিক তখনই বা তার অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশের গ্রাম পর্যায়ে নিজেদের মত করে জ্বালানি সাশ্রয়ী চুলা ব্যবহার করছে প্রান্তিক পর্যায়ের নারীরা।
উল্লেখ্য বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণার এক গবেষণায় দেখা গেছে, সনাতনী চুলা ব্যবহারের মাধ্যমে জ্বালানি পুড়িয়ে যে তাপশক্তি পাওয়া যায় তার শতকরা মাত্র ৫ হতে ১৫ ভাগ কাজে লাগানো সম্ভব হয়। বাকি ৮০-৮৫ ভাগ তাপশক্তি অপচয় হয়। এছাড়া চুলা থেকে সৃষ্ট বিষাক্ত গ্যাস, কার্বনমনোঅক্সাইড, ভাসমান অদহনকৃত কণা এবং ধোঁয়া ইত্যাদি ব্যবহারকারির পক্ষে অনেক ক্ষতিকর। পরিবেশ দূষণের জন্য এসব ভাসমান ধোঁয়া অনেকাংশই দায়ী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন (২০০৯) অনুযায়ী, গৃহস্থিত তরল জ্বালানি হতে সৃষ্ট ধোঁয়ার ফলে বিশ্বজুড়ে দূর্বল শ্বাস-প্রশ্বাস জনিত সংক্রমনে প্রায় ২১%, দীর্ঘস্থায়ী ফুসফুসজনিত রোগে৩৫% এবং ফুসফুসের ক্যন্সারের ফলে ৩% মানুষ মৃত্যুবরণ করে। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের একটি অন্যতম উপায় জ্বালানি সাশ্রয়ী এবং পরিবেশ বান্ধব চুলা ব্যবহার করা।

DSC03239

বারসিক মানিকগঞ্জ রিসোর্স সেন্টার এর অনুসন্ধানে দেখা যায়, জেলার ঘিওর উপজেলার বাইলজুরি, সাইলকাই, বিরসিংজুরি, উভাজানি, বহুজা, ভুবনেশ্বর ও সদর উপজেলার আউটপাড়া, বিপ্র-বেতিলা, বেতিলার চরে জ্বালানি সাশ্রয়ী চুলার ব্যবহার লক্ষণীয়। মানিকগঞ্জ জেলার ঘিওর উপজেলার পয়লা ইউনিয়নের সাইলকাই গ্রামের গৃহিনী ঝরনা আক্তার (৪৭) তেমনি একটি জ¦ালানি সাশ্রয়ী চুলা তৈরি এবং ব্যবহার করছেন। ঝরনা আক্তারের খুব অল্প বয়সেই বিয়ে হয়। যৌথ পরিবারে বেড়ে উঠা ঝরনা আক্তারকে প্রতিদিন রান্নার কাজে অনেক সময় দিতে হয়। বাড়িতে ছোট কৃষি খামার আছে, বসত বাড়ীতে সবজি বাগান আছে। পারিবারিক কাজের ফাকে তিনি বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সভা ও কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেন। ঝরনা আক্তার বলেন, “২০১২ সালে গ্রামীণ শক্তি নামে একটি এনজিও উন্নত চুলার প্রশিক্ষণ করায় এবং স্বল্প মূল্যে চুলা বিতরণ করে। আমি সেই চুলা নিয়ে রান্না করি এবং কিছু সমস্যা খুঁজে পাই। মোটাদাগে সেটি হলো সিমের্ন্টে তৈরী। এই চুলা গ্রাম পর্যায়ের বড় বড় রান্না এবং কাঠের চুলা দিয়ে সবাই রান্না করতে পারবে না। নিয়ম না জানলে ধুমোট হবে, বিরক্তি আসবে। তাই না বুঝে অনেকেই এই চুলা ভেঙ্গে ফেলেছে। তখন আমি নতুন করে মাটি দিয়ে একটু ভিন্ন কায়দায় কয়েক বার চেষ্টা করার পর একটি নতুন চুলা তৈরি করি।” তিনি আরো বলেন, “এখন যে চুলায় আমি রান্না করি সেটি ধোঁয়া কম লাগে। ঢাকনা হাত দিয়ে ধরলে হাতে ঠোসা পড়ার ভয় নেই। অর্থাৎ পাতিলের চারপাশে আগুন কম লাগায় মাড় গালতেও দুর্ঘটনা ঘটবে না। কম সময়েই রান্না শেষ করা যায়। যে কোন ধরনের খড়ি বা লাকড়ি দিয়ে এই চুলায় রান্না করা যায়। জ্বালাানি পুড়ে শেষ হলে ছাই চুলার নিচে জমা হয়। ১৫ দিন পর পর ছাই পরিস্কার করি। এতে রান্না ঘরে ধোঁয়া ও কালি কম হয় এবং পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখতে সাহায্য করে।”

DSC03256
ঝরনা আক্তারের সাথে কথা বলে আরো জানা যায় যে, কম রান্নায় চিমনি ছাড়াও এই চুলায় রান্না করা যায়। কিন্তু বেশী রান্নায় বিশেষ করে ধান সিদ্ধ করলে চুলার সাথে চিমনি যুক্ত করলে ধোঁয়া সহজেই বাইরে চলে যায় এবং রান্না ঘর গরম হবে না। তিনি বলেন, “আমি কয়েক বছর যাবত এই চুলা ব্যবহার করছি এতে আমার শরীর স্বাস্থ্য ভাল আছে। রান্না করলে কাপড় ময়লা কম হয়, কম সময়ে রান্না হয় বিধায় আমি অন্য ক্ষেত্রে সময় দিতে পারি। সংসার আগের চেয়ে অনেক উন্নতি আছে। পারিবারিকভাবেও আমি ভাল আছি।
ঝরনা আক্তারের দেখাদেখিতে পাড়ার অনেকেই এই চুলা ব্যবহার করছে। বারসিক একটি চুলা মেলার আয়োজন করে। মেলার মাধ্যমে গ্রামের সকলেই ঝরনা আক্তারের এই জ¦ালানি সাশ্রয়ী চুলা সম্পর্কে জেনে যায়। সাইলকাই গ্রামের এখন ৩২ টি পরিবারে এই চুলা ব্যবহার করছে। এই রকশখ ছোট ছোট উদ্ভাবনী আমাদের বায়ুমন্ডলের কার্বনডাইঅক্সাইডের পরিমাণ হ্রাস করতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি কম কার্বন ও কম ধোঁয়ামুক্ত এই চুলা গ্রীণ হাউজের প্রভাব কমিয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সাহায্য করবে।

happy wheels 2

Comments