সবুজ শ্যামল কৃষক সংগঠনের উদ্যোগে বীজ বিনিময় উৎসব
নেত্রকোনা থেকে শংকর ম্রং ও রুখসানা রুমী
গত ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ কেন্দুয়া উপজেলার আশুজিয়া ইউনিয়নের নগুয়া গ্রামে সবুজ-শ্যামল কৃষক সংগঠনের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হল স্থানীয় জাতের বীজ বিনিময় উৎসব। কৃষক রাখাল দেবনাথ এর সভাপতিত্বে ৪টি গ্রামের ৫০ জন কৃষক-কৃষাণীদের অংশগ্রহণে নগুয়া বীজ ঘর প্রাঙ্গনে বীজ বিনিময় উৎসবটি অনুষ্ঠিত হয়। ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের কৃষকদের স্থানীয় জাতের বিভিন্ন ফসলের বীজ উৎপাদন ও সংগ্রহ করে নিজ নিজ ঘরে এবং বীজ ঘরে বীজ সংরক্ষণে কৃষকদের উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে মানসম্মত স্থানীয় জাতের শস্য বীজের (ধান, সবজি ও অন্যান্য শস্য) সহজলভ্যতা সৃষ্টি এবং বীজের জন্য বাজার ও কোম্পানির উপর কৃষকদের নির্ভরশীলতা হ্রাস করার উদ্দেশ্যে বীজ বিনিময় উৎসবের আয়োজন করা হয়।
এছাড়াও বীজ বিনিময় উৎসবের মাধ্যমে আশুজিয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের কৃষক-কৃষাণীদের মধ্যে পারস্পারিক সর্ম্পক স্থাপন, উন্নয়ন ও আন্তঃনির্ভরশীলতা বৃদ্ধি করে বীজ বিনময় প্রথার পুনরায় চালুকরণ এবং কৃষি ক্ষেত্রে বীজের সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে সবুজ-শ্যামল কৃষক সংগঠনের উদ্যোগে এ অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে নগুয়া গ্রামের কৃষক-কৃষাণীরা ধান ও সবজিসহ স্থানীয় ৩৫টি জাতের শস্য বীজ প্রদর্শন করেন। শস্য বীজগুলোর মধ্যে ছিল-১২ জাতের ধান বীজ (তুলসীমালা, বিরই, চিনিসাইল, পিড়ার চোখ, বোরো আবজি, লোহাটাং, ব্রি-২৮, ব্রি-২৯, ব্রি-৪৯, পানি চাই, মুক্তা ও বিন্নি), ১৪ জাতের সবজি বীজ (পুইশাক, মিষ্টিকুমড়া, লাউ, চালকুমড়া, আশ্বিনা সীম, খৈলসা সীম, কাইক্কা সীম, বরবটি, ধনিয়া, মিষ্টি সজ, করলা, ধুন্দল, ঢেড়স, শসা), দুই জাতের বারোমাসি মরিচ বীজ (সাদা উব্দা মরিচ, কালো উব্দা মরিচ), বাঙ্গি, সরিষা, মাসকলাই, পাট, রক্ত চন্দন ও বদ্দিরাজ বীজ। বীজ বিনিময় উৎসবটি তিনটি পর্বে অনুষ্ঠিত হয়- আলোচনা অনুষ্ঠান, কৃষকদের সংরক্ষিত বীজের প্রদর্শনী ও বীজ বিনিময় পর্ব।
প্রথম পর্বে আলোচনা অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন সবুজ শ্যামল কৃষক সংগঠনের সদস্য কৃষক রাখাল দেবনাথ। আলোচকদের মধ্যে ছিলেন- নোয়াদিয়া ধান-শালিক-নদী হাওর সংগঠনের সভাপতি মো. বাপ্পী, আশুজিয়া কৃষক সংগঠনের সভাপতি মো. কালাম মিয়া, কৃষাণী রোকেয়া বেগম, বারসিক’র প্রতিনিধি রুখসানা রুমী ও শংকর ¤্রং। আলোচকগণ কৃষক সংগঠনের গড়ে তোলা বীজ ঘর শক্তিশালীকরণ এবং বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণের উপর গুরুত্বারোপ করে অংশগ্রহণকারী সকল কৃষকদেরকে নিজেদের উৎপাদিত ফসল থেকে বীজ সংরক্ষণ করে বীজ ঘরে আপদকালীন সময়ের জন্য এবং অন্যান্য কৃষকদের বীজের সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে সামর্থ্য অনুযায়ী বীজ জমা রাখতে ও প্রয়োজনে পুনরায় এখান থেকে বীজ সংগ্রহের আহবান জানান।
কৃষক রাখাল দেবনাথ, কৃষক কালাম মিয়া, কৃষাণী রোকেয়া বেগম, শংকর ম্রং ও রুখসানা রুমী সকল কৃষকদেরকে বীজ ঘরে বীজ লেনদেন করার আহবান জানিয়ে বলেন, এ বীজ ঘর শুধুমাত্র নগুয়া গ্রামের কৃষকদের জন্য নয়, এটি ইউনিয়নের সকল গ্রামের সকল কৃষকদের। যে কোন কৃষক এ বীজ ঘর থেকে বীজ নিতে পারবেন। তবে এক্ষেত্রে যারাই বীজ নিবেন তাদেরকে একটি শর্ত মানতে হবে। আর শর্তটি হল যিনি যে জাতের ফসলের বীজ নিবেন তিনি নিজে সেই জাতের বীজ সংরক্ষণ করবেন এবং বীজ ঘরে বীজ ফেরত দিবেন। বীজ ঘরে সকলে নিয়মিত বীজ লেনদেন করলে বীজ ঘরের স্বার্থকতা আসবে এবং বীজ বিনিময় শক্তিশালী হবে। আলোচকগণ সকলকে বিভিন্ন এলাকায় চাষকৃত উন্নত মানের স্থানীয় জাতের ফসলের বীজ দেখলে সেখান থেকে সামান্য পরিমাণে হলেও বীজ সংগ্রহ করে বীজ ঘরে জমা রাখার পরামর্শ দেন, যাতে পরবর্তী মৌসুমে একজন দক্ষ কৃষকের মাধ্যমে সংগৃহীত ফসলের বীজ উৎপাদন ও বর্ধন করে কৃষকদের জন্য সহজলভ্য করা যায়। কৃষক আল আমীন তার উৎপাদিত সবগুলো ফসলের বীজ সংরক্ষণ করে বীজ ঘরে জমা দেয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন এবং বীজ ঘর উন্নয়ন ও শক্তিশালীকরণে প্রয়োজনীয় সহযোগিতার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। আশুজিয়া কৃষক সংগঠনের সভাপতি কৃষক কালাম মিয়া ও নোয়াদিয়া গ্রামের ধান-শালিক-নদী-হাওর যুব সংগঠনের প্রতিনিধি যথাক্রমে ১০ ও ১৫টি স্থানীয় জাতের ফসলের বীজ বীজঘরে জমা দেয়ার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন।
বীজ ঘরকে কেন্দ্র করে নগুয়া সবুজ শ্যামল কৃষক সংগঠনের বীজ বিনিময় উৎসবের ফলে বীজ ঘরের গুরুত্ব সম্পর্কে এলাকার কৃষক-কৃষাণীরা বিস্তারিত জানতে পেরেছেন। কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসলের বীজ (স্থানীয় ও উফশী জাত) নিজেরা সংরক্ষণ করে বীজ ঘরে জমা দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন। বীজ বিনিময় অনুষ্ঠানের ফলে কৃষকরা নিজেদের প্রয়োজনীয় বীজ পরস্পরের সাথে এবং বীজ ঘর থেকে বিনিময়ের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। গ্রামে গ্রামে বীজ বিনিময় প্রথা পুনরায় চালু হলে কৃষি ফসলের বীজের ও কৃষি উপকরণের সমস্যা কৃষকরা নিজেরাই সমাধানে সক্ষম হবে বলে কৃষকরা মনে করেন। কৃষি বীজ ও কৃষি উপকরণে কৃষকদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে এবং কোম্পানির উপর কৃষকদের নির্ভরশীলতা হ্রাস পাবে।