গুল: ব্যয় সাশ্রয়ী পরিবেশবান্ধব জ্বালানি
::বারসিক শ্যামনগর রিসোর্স সেন্টার থেকে মননজয় মন্ডল::
গুল হল এক ধরনের জ্বালানি। গুল তৈরির প্রধান উপকরণ হলো কয়লা ও কাদামাটি। জ্বালানি হিসেবে কাঠ ব্যবহারে পর অবশিষ্ট ছাই থেকে কয়লা তৈরি করা হয়। কয়লা ভালোভাবে গুঁড়া (পরিমাণমত টুকরা একেবারে মিহি না, তেতুল বীজের মত) করতে হয়। এরপর এই কয়লার সাথে নরম মাটি (পুকুরের পচা কাদা) মিশিয়ে গোল পাকিয়ে রোদে শুকিয়ে এই গুল তৈরি করা হয়। প্রায় এক কেজি কয়লার সাথে প্রায় ২৫০ গ্রাম কাদামাটি মিশিয়ে গুল তৈরি হয়। তৈরির পর তিন/চার দিন রোদে শুকানোর পরে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে গুল তৈরির প্রচলন শুরু হয় প্রায় সত্তরের দশকে। তবে উপকূলীয় অঞ্চলে অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষ শুরু হলে এ গুল জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি হতে থাকে। বিশেষ করে আইলার পর থেকে এ অঞ্চলের গুলের ব্যবহার বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। চিংড়ি চাষের প্রসার তথা আইলা পরবর্তীতে এ এলাকায় গাছপালা কমে যায়। ফলে কাঠের অভাব দেখা দেয়। এজন্য বিকল্প জ্বালানি হিসেবে গ্রামের মানুষ গুল ব্যবহার করতে থাকে। প্রথমদিকে গ্রামের কম পরিবার এটার ব্যবহার করত কিন্তু পরবর্তীতে এটার ব্যবহার লাভজনক ও পরিবেশবান্ধব হওয়াতে অনেকে এর ব্যবহার শুরু করে।
জ্বালানি হিসেবে গুল ব্যবহারে সুবিধা অনেক। গ্রামীণ নারীরা গুলের ব্যবহারের সুবিধা সম্পর্কে জানান যে, এ জ্বালানির উৎপাদন খরচ একবারে সীমিত। যে সব পরিবার কয়লা সংগ্রহ তথা উৎপাদন করে সে সব পরিবারে গুল তৈরিতে নিজেদের সাময়িক পরিশ্রম ছাড়া অন্য কোন খরচ হয় না। গুল সম্পর্কে বিনোদিনী মুন্ডা বলেন, “গুল বানাতে কোন খরচ হয় না। কাঠ জ্বালানোর পরে সাথে সাথে তুলে পানি দিয়ে আগুন নিভিয়ে ফেললে সেটা কয়লা হয়। আর এই কয়লার সাথে পুকুরের পচা নরম মাটি/কাদা একসাথে মিশিয়ে সেটাকে গোল পাকিয়ে শুকাতে হয়। শুকিয়ে গেলে এটা রান্নার জ্বালানি উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এটার জ্বালানো শেষে অবশিষ্ট ছাই দিয়ে বাড়ির হাড়ি, কড়া ও থালা-বাসন মাজা যায়”। জ্বালানি কাঠের অভাবে গুল বেশি ব্যবহৃত হয়। এটা ব্যবহারের ফলে জ্বালানি কাঠের উপর চাপ কমছে একই সাথে অপচয় রোধ হচ্ছে। এটা ব্যবহারকারী প্রতিটি পরিবারে জ্বালানি খরচ কমে আর্থিক আয় বৃদ্ধি পায়। বায়োমাস জ্বালানির মতই গুল উপকূলীয় জনপদের গ্রামীণ পরিবারে একটি বিশেষ জ্বালানি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
গুল জ্বালানি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা ও পরিবেশ সুরক্ষায় বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছে। কেননা দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য অধিকাংশ পরিবারের গ্রামীণ নারীরা রান্নার উপকরণ হিসেবে গুল ব্যবহার করছে। গুল ব্যবহার করার ফলে গাছপালার উপর কিছুটা হলেও চাপ কমছে। গুল ব্যবহারের ফলে জ্বালানি কাঠের ব্যবহার কমে গেছে। গুল জ্বালানি ব্যবহারের ফলে হাড়ি পাতিলে কালি পড়ে না, ঘরের মধ্যে ধোয়া একবারেই সামান্য পরিমাণে হয়। এজন্য এ জ্বালানি নারী ও শিশুবান্ধব। শ্যামনগরের ময়না রাণী এই প্রসঙ্গে বলেন, “আমাদের জ্বালানি দিনের পর দিন কমে যাচ্ছে। আমাদের যেটুকু জ্বালানি আছে তার সঠিক ব্যবহার করতে হবে। আমাদের পরিবার ও পরিবেশ বাঁচবার জন্য গুল ব্যবহার বাড়াতে হবে। এটা ব্যবহারে হাড়ি পাতিলে কোন কালি পড়েনা এবং ধোঁয়া হয় না। আমি যে পরিবেশবান্ধব চুলা তৈরি করি তাতে সব রকম জ্বালানি উপকরণ বিশেষ করে গুল ব্যবহার করা যায়। এজন্য জ্বালানি সাশ্রয়ী পরিবেশবান্ধব চুলা ও গুল ব্যবহার করতে হবে।”
গুল জ্বালানি সাধারণ চুলায় ব্যবহার করা যায় না। এক্ষেত্রে পরিবেশ বান্ধবচুলাতে এ জ্বালানি বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। উপকূলীয় এলাকায় পরিবেশবান্ধব জ্বালানি সাশ্রয়ী চুলা তৈরিতে শ্যামনগরের ময়না রাণী ইতিমধ্যেই বিভাগীয় পর্যায়ে পরিবেশ পদকসহ বিভিন্ন পুরুষ্কার ও সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। এই গুল জ্বালানি ময়না রাণীর তৈরিকৃত বিশেষ চুলা উৎকৃষ্ট জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। উপকূলীয় শ্যামনগর এলাকায় অনেকেই ময়না রাণীর তৈরির বিশেষ চুলা ব্যবহার করেছেন এবং ওই চুলায় অনায়াসে তারা গুল ব্যবহার করছেন।
গ্রামীণ নারীরা লোকায়ত জ্ঞান, প্রযুক্তি ও চর্চার মাধ্যমে পারিবারিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে নিরব ভূমিকা রেখে চলেছেন। দেশের উপকূলীয় শ্যামনগর উপজেলায় নানা ধরনের লোকায়ত চর্চা লক্ষ্য করা যায়। নারীর বিভিন্ন লোকায়ত জ্ঞান ও চর্চার মধ্যে জৈব জ্বালানি গুল একটি উল্লেখ্যযোগ্য চর্চা।