সামান্য সহায়তাতেই খুশিতে আত্মহারা দরিদ্র জনগোষ্ঠী

সামান্য সহায়তাতেই খুশিতে আত্মহারা দরিদ্র জনগোষ্ঠী

নেত্রকোনা থেকে শংকর ম্রং

এবারের শীত মৌসুমটি বাংলার জনসাধারণের জন্য নতুন এক অভিজ্ঞতা। প্রতিবছর ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে আমাদের দেশে শীত নামে, তবে তা সকলের জন্য সহনীয় মাত্রায়। এদেশের জনগণ শীত প্রধান দেশে শীতের প্রার্দুভাব সম্পর্কে বিভিন্ন মাধ্যমে এবং প্রবাসীদের কাছে থেকে জেনে থাকেন। শীত প্রধান দেশে তুষার ঝড় ও বরফ পড়ে সৃষ্ট শীত আমাদের দেশের সাধারণ জনগণের কাছে গল্পের মত। তুষার ঝড় ও বরফ পড়া শীত আমারা কোন দিন অনুভব করিনি।

55

এ মৌসুমের শীত মৌসুমটি ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান ও চীনসহ শীত প্রধান দেশের শীতের অনুভূতি আমাদের মধ্যে জাগিয়ে দিয়েছে। আমার জীবদ্দশায় আমি বৃহত্তর ময়মনসিংহে কখনো ১৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে শীত পড়তে দেখিনি ও শুনিনি। উত্তরাঞ্চলের রংপুর, কুড়িগ্রাম ও দিনাজপুর অঞ্চলে মাঝে মধ্যে এ পর্যায়ে শীত পড়ে। কিন্তু উত্তরাঞ্চলে চলতি মৌসুমে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত শীত পড়েছে (সূত্র: বিভিন্ন গণমাধ্যম)। প্রচন্ত শীতে এদেশের মানুষের বিশেষভাবে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর খুবই নাজেহাল অবস্থা।

প্রতিবছর শীত মৌসুমে শীত নিবারণের জন্য বিভিন্ন দানশীল ব্যক্তি, সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও জনসংগঠনের উদ্যোগে শীতবস্ত্র প্রদান করা হয়ে থাকে। কিন্তু ২০১৭ সালে সকল সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, জনসংগঠন ও দানশীল ব্যক্তিগণ রোহিঙ্গা উদ্ভাস্তুদের দিকে বেশি দৃষ্টি দেয়ায় দেশের বিভিন্ন এলাকার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অতি দরিদ্র জনগোষ্ঠীরা এবার শীত বস্ত্র থেকে বঞ্চিত। গ্রামে গ্রামে গড়ে ওঠা ছোট ছোট জনসংগঠন তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী কিছু দরিদ্র ও অসহায় প্রবীণ এবং ভিন্নভাবে সক্ষম (প্রতিবন্ধী) ব্যক্তিদের জন্য ও গৃহপালিত পশু-পাখির জন্য শীতবস্ত্র বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছে। শীতবস্ত্রের মধ্যে কম্বল, চটের বস্তা ও খড় উল্লেখযোগ্য।

দরিদ্র প্রবীণ ও ভিন্নভাবে সক্ষম জনগোষ্ঠী শীত নিবারণের জন্য জনসংগঠনসমূহ থেকে এই সামান্য শীতবস্ত্র পেয়ে আনন্দে আত্মহারা। “আমাদের খোঁজ কেউ করেনা, আমরা কাজ কর্ম করতে পারিনা বইলা শীতের কাপড় কিনবার পারিনা। শীতে খুব কষ্ট পাই, হারা রাইত ঘুমাইতে পারিনা। জনসংগঠনগুলো একটি করে কম্বল দেয়ায় শীতে কষ্ট থাইক্যা অল্প অইলেও বাঁচবার পারুম।” কথাগুলো বলছিলেন নেত্রকোনা সদর উপজেলার সুলতানগাতি গ্রামের অতি দরিদ্র প্রবীণ চাঁন বানু।

56

৭৫ বছর উর্ধ্ব অসহায় প্রবীণ নারী চাঁনবানু নিকট আত্মীয় বলতে কেউ নেই। ছিল একটি মাত্র মেয়ে, সেও মারা গেছে অনেকদিন হয়। স্বামী পরিত্যাক্তা চাঁন বানু বয়সের ভারে বাধ্য হয়ে ভিক্ষাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। বর্তমানে ভালোভাবে চলাফেরা করতে না পারায় ভিক্ষাবৃত্তিও করতে পারেনা। স্থানীয় সরকার প্রদত্ত্ব বয়স্ক ভাতা ও আত্মীয়দের দেয়া খাবার চাঁন বানুর খাদ্য যোগানের একমাত্র অবলম্বন। প্রচন্ড শীতে তার কষ্ট দেখে গ্রামের এক সদয় ব্যক্তি তাকে একটি গরম জামা দান করেছেন। একটি মাত্র গরম জামা হওয়ায় অনেকদিন যাবত সে জামাটি না ধুয়ে ব্যবহার করছে।

আমি গত জানুয়ারি‘১৮ শীতে প্রবীণ ও প্রতিবন্ধি জনগোষ্ঠী, ক্ষেতের ফসল ও গবাদি পশু-পাখির অবস্থা জানার জন্য সুলতানগাতি গ্রাম পরিদর্শনে গেলে চাঁন বানু শীতে নবুজুবু হয়ে কেঁদে কেঁদে একটি গরম কাপড়ের জন্য আকুতি জানায়। আমার কর্মরত প্রতিষ্ঠানে শীত বস্ত্র সহায়তার জন্য কোন সুযোগ না থাকায় আমি তাকে নিজ উদ্যোগে একটি কম্বল দেয়ার আশ্বাস দিই। পরবর্তীতে (২৬ জানুয়ারি) আমি দু’জন সহকর্মীর কাছ থেকে কিছু আর্থিক সহায়তা নিয়ে একটি কম্বল ও একটি সয়েটার কিনে চাঁন বানুকে দিতে যাই। তাকে ডাকতেই তিনি তার কুড়েঘর থেকে কাঁপা কাঁপা পায়ে বেরিয়ে আসে। আমি তাকে কম্বল ও সয়েটার দিতেই কেঁদে ফেলেন এবং সৃষ্টিকর্তার নিকট আমাদের জন্য দোয়া কামনা করতে থাকে।

সামান্য সহযোগিতায় কোন মানুষকে আনন্দে এত আত্মহারা হতে এর পূর্বে আমি কাউকে দেখিনি। যদিও আমাদের কাছে এই সহায়তা সামান্য কিন্তু চাঁন বানুর মতো দরিদ্র ও অসহায় প্রবীণের নিকট এটি ছিল অসাম্যন্য। চাঁন বানুকে এই সামান্য শীতবস্ত্র সহায়তা দিয়ে পেরে আমারও খুব ভালো লেগেছিল।

আমরা প্রতিদিন শখ করে, নেশা দ্রব্য গ্রহণ (পান, গুল, সিগারেট, মদ), মোবাইল ফোনে ফেইসবুকের জন্য এমবি কিনে এবং বিলাসিতা করে অনেক টাকা অপচয় করে থাকি। কিন্তু আমরা একটু মিতব্যয়ি হলে এবং আমাদের পুরনো কাপড়গুলো যত্নে সংরক্ষণ করে গ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে শীতের কাপড় দিয়ে সহযোগিতা করতে পারি। আর এটি করা গেলে নেশা জাতীয় দ্রব্য গ্রহণের ফলে স্বাস্থ্যহানী থেকে যেমন আমরা রক্ষা পাব, তেমনি মিতব্যয়ি হবার অভ্যাস আমাদের মধ্যে গড়ে উঠবে। দরিদ্র জনগোষ্ঠী রক্ষা পাবে প্রচন্ড শীত থেকে। তাই আসুন আমরা নিজ নিজ সামর্থ অনুযায়ী গ্রামের প্রতিবেশি দরিদ্রদের শীত বস্ত্র বিতরণ করি এবং আর্থ মানবতার সেবায় শরিক হই।

happy wheels 2

Comments