অচাষকৃত উদ্ভিদের গুরুত্ব
সাতক্ষীরা থেকে মননজয় মন্ডল
যুগে যুগে নারীরা প্রাকৃতিক সম্পদ সংগ্রহ ও সংরক্ষণের মাধ্যমে টিকিয়ে রেখেছেন প্রাণবৈচিত্র্য ও খাদ্য ভান্ডার। সেই সাথে সমৃদ্ধ করেছেন জ্ঞানভান্ডার। দিনে দিনে সে জ্ঞান ছড়িয়েছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। প্রকৃতির সাথে নারীর রয়েছে অবিচ্ছেদ্য এক সম্পর্ক। শুধুমাত্র খাদ্য চাহিদা পূরণে নয় রোগ নিরাময়েও নারীরা প্রকৃতি থেকে উপাদান সংগ্রহ করে থাকেন। নারীর অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধিতেও রয়েছে প্রকৃতির অবদান। প্রকৃতির গাছ-গাছড়া, লতা, গুল্ম সংগ্রহ করে পারিবারিক খাদ্য চাহিদা পূরণে নারীর ভূমিকা অধিক। এ সব প্রয়োজনের তাগিদে প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেওয়া এ উদ্ভিদ লতা-গুল্মকে কেউ কেউ নিজ উদ্যোগে স্বযত্নে সংরক্ষণ করছেন।
জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সচেতনতার অভাবসহ নানা কারণে এ উদ্ভিদগুলো প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া এখন এর ব্যবহার আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে। বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এ গাছগুলোর গুনাগুণ ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জানে না। পারিবারিক চর্চা ও নতুনদের ধারণা দিতে এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন স্থানীয় জনগোষ্ঠী। বসতবাড়ির পতিত জায়গায় এ সকল কুড়িয়ে পাওয়া লাগিয়ে রাখা খুব সহজ ব্যাপার। কেননা একবার লাগালেই আর খুব বেশি পরিশ্রম করা লাগে না। কোন প্রকার সার বিষ দেওয়া লাগে না। সংসারের অন্য কোন কাজের ক্ষতি হয় না। অবসরের ফাঁকে ফাঁকে এসকল উদ্ভিদ সংরক্ষণে দায়িত্ব পালন করা যায়।
প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেওয়া কিছু উদ্ভিদের ব্যবহার, গুনাগুণ ও সংরক্ষণের লক্ষ্যে শ্যামনগরের বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন ও স্থানীয় জনগোষ্ঠী আলোচনা, অভিজ্ঞতা বিনিময়, পাড়া মেলা ও রান্না প্রতিযোগিতাসহ বিভিন্ন উন্নয়ন উদ্যোগ বাস্তবায়ন করেন। সচেতন ও আগ্রহী হয়ে ওঠেন অনেকেই। বাড়তে থাকে ব্যবহার ও সংরক্ষণ উদ্যোগ। শ্যামনগর উপজেলার ইশ্বরীপুর ইউনিয়নের ধুমঘাট গ্রামের কৃষাণী অল্পনা রাণী, কনিকা রাণী, নাজমা বেগম, হায়বাতপুরের ফরিদা পারভীনসহ অনেকেই ক্ষেতের পাশে জন্মে থাকা অন্যান্য অচাষকৃত উদ্ভিদগুলোকেও উপড়ে না ফেলে সযতেœ রেখে দিয়ে একই সাথে প্রয়োজনীয় অচাষকৃত উদ্ভিদের জাত প্লট আকারে সংরক্ষণ করে রেখেছেন। যা কিনা নিজ পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে প্রতিবেশীদেরও খাদ্য চাহিদা পূরণে সহযোগিতা করছে। প্রকৃতির এসকল উদ্ভিদবৈচিত্র্য কোনটাই আগাছা নয়; হয় সেটা খাদ্য না হয় ঔষধি। প্রতিটা উদ্ভিদের সাথে প্রতিটা প্রাণের রয়েছে এক অবিচ্ছেদ্য আন্তঃনির্ভরশীলতার সম্পর্ক।
প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যেতে বসা উপকূলীয় শ্যামনগর এলাকায় এসকল উদ্ভিদবৈচিত্র্য এর মধ্যে ভেষজ ঔষধি হিসেবে মনিরাজ, নীল অপরাজিতা, স্বেত অপরাজিতা, সজিনা, হাড়ভাঙা, কালনিষিদ্ধে, কালকেউটেলাল কেউটেরাধা, কানন তুলসী, কৃষ্ণ তুলসী, বৃন্দাবন তুলসী, রাম তুলসী, ভুঁই কুমড়া, শুকতারা, সূচমুখীসাদা, স্বেত লজ্জাবতী, লাল লজ্জাবতী, বাকসা, আমাদা, রক্তকমল, মানকচু, কাল কচু, কাল ধুতরা, কাল নিষিন্ধে, তিথ বেগুন, পাথরকুচি, নিলার্জি, পেয়াজফুল, নিমুখো, শীষ আকন্দ, হাতিশূড়, দূর্বা, মোরগফুল, শিউলী ফুল, নাগিনীপদ্ম, বাউল জেলী, গুড় কামিনী, ঘৃত কুমারী, হেন্না, মেহেদী, তুলো টেপারি, ফুলো টেপারি এবং গাঁদা। অন্যদিকে কুড়িয়ে পাওয়া খাদ্য হিসেবে ব্রাহ্মী শাক, তেলাকচু, ঘুমশাক, কলমীশাক, গাদামনি শাক, হেলাঞ্চ, মাটিফোড়া শাক, খুদকুড়ি, কলমী, হাতিশূর, সেঞ্চি শাক, ঘোড়া সেঞ্চি, গিমে শাক, বেতোশাক, তাল মাখনা, হিম শাক, কাটানটি, বউনুটে, ঘেটকুল, পিপুরিয়াম, বনমুলো, গলগুটে শাক প্রভৃতি সংরক্ষণ ও ব্যবহার করেন।
অচাষকৃত উদ্ভিদবৈচিত্র্য সংরক্ষণ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক প্রাপ্ত কৃষাণী ফরিদা পারভীন ও অল্পনা রানী বলেন, “প্রকৃতি থেকে এসকল গাছ গুলো বিভিন্ন কারণে হারিয়ে যাচ্ছে। গাছগুলো সংরক্ষণ করতে এবং এর ব্যবহার বাড়াতে আমরা ক্ষেতের পাশে এগুলো লাগিয়ে রেখেছি। তাছাড়া আমাদের থেকে আমাদের ছেলে-মেয়েরাও জানতে ও শিখতে পারবে। আমাদের একাজ দেখে গ্রামের অন্য নারীরা উৎসাহিত হয়ে নিজেরা নিজ বাড়িতে সংরক্ষণ রাখার চেষ্টা করছে।”
ভিন্ন ভিন্ন কৃষি প্রতিবেশ ও জীবন-জীবিকার বৈচিত্র্যে ভরপুর বাংলাদেশের কৃষি ভূগোল এবং ষড় ঋতুর বৈচিত্র্য দিনে দিনে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে স্থানীয় কৃষি প্রাণবৈচিত্র্য। শত পরিবর্তন ও প্রতিকূলতার মাঝে এখনও দেশের অঞ্চল ভিন্নতায় গ্রামীণ জনগণই প্রতিনিয়ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে টিকিয়ে রেখেছে প্রাণবৈচিত্র্য ও জীবন। তাদের এ উদ্যোগ, চর্চা ও জ্ঞানের স্বীকৃতি গ্রামীণ খাদ্য অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। স্থানীয় উদ্যোগে কুড়িয়ে পাওয়া এসকল উদ্ভিদবৈচিত্র্য সংরক্ষণ সমৃদ্ধ করছে প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা পাচ্ছে সবুজ পরিবেশ।