চলনবিলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও সমস্যা
চাটমোহর, পাবনা থেকে ইকবাল কবীর রনজু
মানুষের জীবনযাত্রায় জল ও বায়ু এ দুটি উপাদান ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পৃথিবীর তিনভাগ জল থাকলেও সুপেয় ও ব্যবহারোপযোগি জলের অভাব বোধ করছে এক ভাগ স্থলের মানুষ। দূষণ হচ্ছে জল। বায়ু দূষণ ও ভাবিয়ে তুলছে আমাদের।
জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে এএফপিকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে নাসার গড্যার্ড ইন্সটিটিউট ফর স্পেস স্টাডিজের সাবেক প্রধান মার্কিন বিজ্ঞানী জেমস হ্যানসেন বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তন রোধে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের মাত্রা কমিয়ে আনা এবং হাজার কোটি টন কার্বনডাই অক্সাইড শোষণে বিশ^কে অবশ্যই দ্রুত উদ্যোগী হতে হবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা যেমন অপর্যাপ্ত অগ্রগতিও তেমনি ধীর। এই বাস্তবতা বিশ^জুড়ে সব সরকারই উপেক্ষা করছে। ২০১৫ সালে প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে স্বাক্ষর করা ১৯৬ দেশের প্রতিনিধি জার্মানীর বন এর জলবায়ু সম্মেলনে এ নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং করণীয় নির্ধারণ করেছেন। বায়ুমন্ডল থেকে ১০ গুনের ও বেশি হারে কার্বন নিঃসরণ করা প্রয়োজন এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি এখনো তৈরি করা সম্ভব হয়নি।”
প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি তৈরি সম্ভব না হলেও কার্বন নিঃসরণ এবং জলবায়ুর ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে যে মানুষ গভীরভাবে ভাবতে শুরু করেছে সেটিকে অবশ্যই ইতিবাচকভাবে দেখতে হবে।
অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আবদুল হামিদ রচিত চলনবিলের ইতিকথা গ্রন্থ সূত্রে জানা যায়, নাটোর জেলার সিংড়া, গুরুদাসপুর ও বড়াইগ্রাম, পাবনা জেলার চাটমোহর ও ভাঙ্গুড়া এবং সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ রায়গঞ্জ ও সলঙ্গা এ আটটি থানা এবং উল্লাপাড়া থানার দক্ষিণ পশ্চিমাংশের দশটি ইউনিয়নজুড়ে চলনবিলের অবস্থান। সমগ্র চলনবিল বিষুব রেখার ২৪ ডিগ্রী ৭ ইঞ্চি থেকে ২৪ ডিগ্রী ৩৫ ইঞ্চি উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৯ ডিগ্রী ১০ ইঞ্চি হতে ৮৯ ডিগ্রী ৩৫ ইঞ্চি পূর্ব দ্রাঘিমাংসের মধ্যে অবস্থিত। এর আয়তন ৮শ বর্গমাইল। সুলেখক প্রমথ নাথ বিশী’র মতে, “অনুমান করলে অন্যায় হবে না যে, চারশত বৎসর পূর্বে এ বিলটি রাজশাহী, পাবনা, বগুড়ার অধিকাংশ স্থান জুড়ে বিরাজ করতো। ব্রক্ষপুত্র ও পদ্মার সঙ্গম স্থলের পশ্চিমোত্তর অংশে চলনবিল বিরাজিত; অবস্থান আকৃতি প্রকৃতি দেখে চলনবিলকে উত্তর বাংলার নদ নদী-স্নায়ুজলের নাভিকেন্দ্র বললে অত্যুক্তি হবে না”। তবে বর্তমানে পাবনা নাটোর সিরাজগঞ্জ জেলার মধ্যে চলনবিলের অবস্থান।
চলনবিল এলাকার উল্লেখযোগ্য বিলগুলো হলো, বড় বিল, খলিশাগাড়ি বিল, ধলাইর বিল, ছয় আনি বিল, বাইরার বিল, সাধুগাড়ি বিল, মহিষা হালট, চাকল বিল, বৃগড়িলা বিল, কুমিরাগাড়ি, কৈগাড়ি, নিহালগাড়ি, চেচুয়া, টেংড়াগাড়ি, চাতরাবিল, খোলার বিল, কচিয়ার বিল, কাশিয়ার বিল, ধলার বিল, বালোয়া, আমদাকুড়ি, বাঙ্গাজালী, হুলহুলিয়া, কালামকুরী, রঘুকদমা, বোয়ালিয়া, হরিবিল, হরিবিল, বুড়ি বিল, রহুয়া, সোনাইডাঙ্গা, নলুয়াকান্দি, বেরল, কচিয়া, কাশিয়ার বিল, কাতলবিল, বাঘমারা বিল, বিলকুরুলিয়া, চিরল বিল, ডিকশী বিল, রুথনাডাঙ্গা, রউল, সাঁতৈল, পাতিয়া বিল, আইড়মারী, কৈখোলা, গলিয়া, চিনাডাঙ্গা, মেরীগাছা ও খলিশাডাঙ্গা। খাল গুলোর মধ্যে হক সাহেবের খাল, নবীর হাজীর জোলা, নিয়ামত খাল, সাত্তার সাহেবের খাল, কিনু সরকারের ধর, পানাউল্লাহ খাল, নিমাইচড়া- বেশানী খাল, জহির সরকারের খাল, দোবিলা খাল, কিশোর খালি খাল, বেহুলার খাড়ি, গাড়াবাড়ি- ছারুখালী খাল, জনিগাছার জোলা উল্লেখযোগ্য। নদী গুলোর মধ্যে আত্রাই, মরা আত্রা¦ই, গুড়, করতোয়া, বড়াল, তুলশী, চেঁচুয়া, ভাদাই, চিকনাই, বানগঙ্গা, গুমানী উল্লেখ যোগ্য। এসব নদী বিলের বেশ কিছু বিলুপ্তির পথে। অধিকাংশেরই পানি ধারণ ক্ষমতা কমে এসেছে।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত একটি উক্ত কর্মশালায় জানা যায়, চলনবিলে জলবায়ু পনিরবর্তনের ফলে যেসব পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয় সেগুলো হলো: তাপমাত্রার পরিবর্তন, পানির স্তর নি¤œগামী, শুষ্কতা বৃদ্ধি, নদী ধ্বংস হয়ে যাওয়া, বিল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত হওয়া, জল যোগাযোগ ব্যবস্থা বিনষ্ট হওয়া, মাটির উর্বরতা কমে যাওয়া, ফসলী জাত বিলুপ্ত হওয়া, মাছের উৎপাদন হ্রাস পাওয়া ও বিভিন্ন প্রজাতির মাছের বিলুপ্ত হওয়া, জলজ প্রাণী বিলুপ্তি অন্যতম। এছাড়াও মনুষ্য সৃষ্ট বিভিন্ন সমস্যাগুলো, যা জলবায়ু পরিবর্তনের হারকে তরান্বিত করেছে, তার মধ্যে রয়েছে অপরিকল্পিত রাস্তা ও বাঁধ নির্মাণ, শাপগাড়ি এলাকায় অবস্থিত রাবার ড্যাম নির্মাণ, অপরিকল্পিত স্লুইজগেট নির্মাণ, বিল ক্রমাগত সংকুচিত হওয়া, আবাদী জমি হ্রাস, ইটের ভাটা স্থাপন, টপসয়েল কর্তন অন্যতম।
এসকল পরিবর্তনের ফলে চলনবিল এলাকার কৃষক, সাধারণ মানুষ, গবাদি পশু, মৎস সম্পদ, জলজ উদ্ভিদ, মৎসজীবী,ব্যবসায়ী, মাঝিমাল্লা, কৃষি পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। প্রতিকূল পরিবেশের কারণে অনেক নদী মৃতপ্রায় অবস্থায় উপনীত হওয়ায় এবং অন্যান্য নদীর পানি ধারণ ক্ষমতা কমে যাওয়ায় পানির প্রবাহ বন্ধ অথবা কমে যাওয়া, পণ্য পরিবহন ব্যয় বহুল ও বাধাগ্রস্ত হওয়া, ভূগর্ভস্থ পানির উত্তোলন ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে।
চলনবিলের উপকন্ঠের চাটমোহরে বসবাসকারী ্এ্যাডঃ সাখাওয়াত হোসেন সাখো জানান, বাংলাদেশের বৃহৎ বিল চলনবিল। প্রতিনিয়ত এ বিল তার স্বকীয়তা হারাচ্ছে। হারাচ্ছে জৌলুশ। এর বিরূপ প্রভাব পরছে দেশব্যাপী। যেহেতু চলনবিলের সাথে অগণিত মানুষের ভাগ্য জড়িত তাই বৃহৎ এ বিলকে, বিলের সম্পদকে রক্ষা করতে পারলে তা মানুষের জন্য কল্যান বয়ে আনবে। এ জন্য অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ, স্লুইজ গেট নির্মাণ বন্ধ করতে হবে। নদী বিলের নাব্যতা বৃদ্ধি, সংযোগ খাল সংস্কার করা আবশ্যক হয়ে পড়েছে।
উল্লেখ্য যে, গত ১৪ ও ১৫ নভেম্বর সিরাজগঞ্জের বাগবাড়িতে অবস্থিত বেসরকারি সংস্থা এনডিপি ট্রেনিং সেন্টারে চলনবিলের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে কি কি সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে সেগুলো চিহ্নিতকরণ বিষয়ক দুই দিনব্যাপী এক কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়েছে। লোকাল এ্যালায়েন্স ফর এনজিও ডেভেলপমেন্ট (ল্যান্ড) ও খ্রিষ্টিয়ান কমিশন ফর ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ (সিসিডিবি) যৌথভাবে এ কর্মশালার আয়োজন করে।