বানিয়াজুরীর ২০০ বছরের ঐতিহ্য: শিবরাত্রি মেলা

মানিকগঞ্জ থেকে সুবীর সরকার ও বাহাউদ্দীন

আজও গ্রামের মেলাগুলো মানুষের কাছে অসাম্প্রদায়িকতার সেতু বন্ধনের মতো কাজে করে। সকল শ্রেণী ও সকল পেশার মানুষ মেলাগুলোকে নিজেদের ঐতিহ্য বলে মনে করেন। তেমনি বানিয়জুরী শিবচালা মন্দিরে প্রায় ২০০ বছর আগে থেকে শ্রী শ্রী শিবরাত্রি ব্রত উপলক্ষে ২ দিনব্যাপি মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এই মেলা জমিদার খোকাবাবু ঘোষ বা মতান্তরে রবীন বাবু ঘোষ এর আমল থেকে চলে আসছে। বর্তমানে এটি জমিদারদের পুরোহিত এবং শ্রী শ্রী শিবমন্দিরের এর সেবাইত রুহিদাস চক্রবর্তী, মন্দির কমিটি এবং এলাকাবাসীর উদ্যোগে মেলাটি অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।

মেলা বলতে নারী, পুরুষ, শিশু, প্রবীনদের একটি নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট স্থানে মিলনমেলা। মেলা বলতে এলাকাবাসী ও যারা বিভিন্ন জিনিস বেচাকেনা করবে তাদের মনে একটা আনন্দের উৎস। মেলা শুরুর দুই দিন আগে থেকেই দোকানদাররা ভ্যানে ও মাথায় করে বিভিন্ন প্রকার জিনিস শিব মন্দির এর মাঠে জড়ো করতে থাকে। এই সব দোকানদারদের বলতে হয় না বা কোনভাবে প্রচার-প্রচারণা করা লাগে না। তারা সবাই জানে যে, শ্রী শ্রী শিব চর্তুদশীর পর মেলা অনুষ্ঠিত হয়। সেভাবেই তারা এসে উপস্থিত হয়।

Juri-2এই মেলার একটি বিশেষত্ব হচ্ছে এখানে টিন ও এ্যালুমিনিয়াম এর হারিকেন, বালতি, কড়াই সারার জন্য ঠাটারু এসে উপস্থিত হয়। এদের বর্তমানে খুব বেশি দেখা যায় না। শুধুমাত্র এই মেলাতে উপস্থিত হয়। পাশাপাশি অন্যান্য মেলার মতো মাটির তৈজসপত্র, মনোহরি দোকান, বাইনতি দোকান, ভাজাপোড়ার দোকান, মিষ্টির দোকান, চুড়ি-গহনার দোকান, হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য তুলসী মালাসহ অন্যান্য উপকরণ, বিভিন্ন প্রকার মসলা বিক্রির দোকান, চা-পানের দোকান, নাগরদোলা ও বায়োস্কোপসহ বিভিন্ন প্রকার খেলা অনুষ্ঠিত হয়। এবারকার মেলার একটি অন্যতম আকর্ষণ ছিল বায়োস্কোপ। বায়োস্কোপ দেখার মধ্যে দিয়ে শিশু, যুবক ও প্রবীণরা আনন্দ লাভ করে। প্রবীণদের নিকট হতে শিশু ও যুবকরা বায়োস্কোপ দেখার গল্প শুনে অতীত বিনোদন ব্যবস্থা সম্পর্কে শুনে এসেছে। এই মেলার মাধ্যমে সেই বিনোদন ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে পেরেছে। আর প্রবীণদের ভাষ্য মতে, ‘অনেক বছর পর আবার পুরানো দিনের কথা মনে পড়ে গেলো এই বায়োস্কোপ দেখে’

এই মেলাটি বানিয়াজুরী গ্রামসহ আশেপাশের আরও ৮টি গ্রামের লোকজন তাদের পছন্দনীয় জিনিস কেনাবেচার জন্য আসা-যাওয়া করে। আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীর কুমারী মেয়েরা ও নারীরা তাদের মনের বাসনা পুরণ করার জন্য ২৪ ঘন্টা উপবাস থেকে শিব পূজা- আর্চনা করেন। পূজা-আর্চনা ঢাক-ঢোল এর বাদ্য ও ঠাকুর এর মন্ত্রের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। মেয়েরা নতুন শাড়ী পড়ে পূজা করতে উপস্থিত হয়। এই শিব পূজায় প্রতিবছর ৩৫-৪৫ জন নারী ও মেয়েরা শিবকে পূজা- আর্চনা করেন। শিব মেলায় যেন নারী-পুরুষ একত্র হয়ে কোন সফল কাজ করার অঙ্গীকার করেন। তেমনি মানুষের মনে আনন্দের জোয়ার জাগে। মেলা উপলক্ষ্য প্রতিটি আত্মীয়-স্বজনদের আগমন ঘটে। সকল পরিবারের মধ্যে আনন্দের ক্ষেত্র তৈরি হয়।

Juriঅতীতের জমিদারদের এই শিব মন্দিরে এখনো শিব পূজা হচ্ছে এবং মেলাও চলছে। এই গ্রামীন বৈচিত্র্যময় সংষ্কৃতির মেলায় গ্রামের সকল ধর্ম, বর্ণ এবং পেশার সকল বয়সের লোকজন একত্র হয়। এই শিব পূজা উপলক্ষ্য শিব মেলায় নারীদের অংশগ্রহণ বেশি। এখানে নারী ও কুমারী মেয়েদের পূজা হয়। তাই এই মেলা মূলত নারী ও মেয়েকেন্দ্রিক বেশি উপস্থিত হয়। সেই সঙ্গে শিশু ও প্রবীণ ব্যক্তির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। দু’ দিনব্যাপি মেলা থেকে নারীরা তাদের প্রযোজনীয় হাড়ি-পাতিল, বিন্নি খইসহ নানা জিনিস ক্রয় করেন। প্রবীণ ব্যক্তিরা তাদের বাড়িতে ভাঙা জিনিস সারার জন্য যেমন- হারিকেন, কড়াই, বালতি নিয়ে ঠাটারুদের নিকট উপস্থিত হন। অন্যদিকে শিশুরা নাগরদোলায় ওঠা নিয়ে ব্যস্ত ও বায়েস্কোপ দেখা নিয়ে মেলা উপভোগ করে।। মেলার মধ্যে দিয়ে গ্রামীণ বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির জাগরণ ঘটে। মানুষে মানুষে মিলনের বার্তা বহন করে। খুশির জোয়ার জাগে। ধর্ম-বর্ন, নারী-পুরুষ, শিশু-প্রবীণ একত্র হওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হয়। ধনী-গরিব একই স্থানে আগমন ঘটে। মেলায় দোকানদার ও ক্রেতার সাথে সুসম্পর্ক সৃষ্টি ঘটে। মেলায় নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট স্থানে বিভিন্ন প্রকার জিনিসের বৈচিত্র্য ও সৌন্দর্যের বিকাশ ঘটে। মেলা প্রকৃতির সৌন্দর্যগুলো গ্রামীণ সংস্কৃতিতে প্রস্ফুটিত হয়।

 

happy wheels 2