লোনা পানির জীবন

উপকুল থেকে মননজয় মন্ডল

বাংলাদেশের উপকূলবর্তী এলাকার জনজীবন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও দুর্যোগে যখন চরম ক্ষত-বিক্ষত তখনই লোনা পানি, সুন্দরবন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের অভিঘাতে নিরন্তর টিকে থাকার সংগ্রামে ব্যস্ত উপকূলীয় এক অদম্য নারী মঞ্জুরী রানী। সাতক্ষীরার শ্যামনগরের সুন্দরবন সংলগ্ন বড়ভেটখালী গ্রামে জন্ম নেওয়া মঞ্জুরী রানী শিশুকাল, শৈশব, কিশোর ও যৌবনকাল পার করেছেন এই উপকূলের লোনা মাটিতেই। জন্মের পর থেকে তিনি নানা ধরনের দুর্যোগ মোকাবেলা করেই এখানেই তার জীবন জীবিকা চলমান রেখেছেন। ১৭ বছর বয়সে একই গ্রামের নিমাই বিশ^াস (৫০) এর সাথে। বিয়ের পরই স্বামী স্ত্রী মিলে সুন্দরবননির্ভর সংসার পরিচালনা করেন। প্রায় ৮ বছর আগে ২ সন্তানকে নিয়ে মঞ্জুরী রানী স্বামীর ভিটা ছেড়ে পিতার আশ্রয়ে চলে আসেন। এখানেই এসে পিতার বসত ভিটায় একটি বসত ঘর বেঁধে সুন্দরবনের নদী থেকে মাছ-কাঁকড়া সংগ্রহ করে জীবন চালাতে থাকে।

২০২১ সালে অক্টোবর মাসে নেটজ পার্টনারশিপ ফর ডিভেলপমেন্ট জাস্টিস’র সহযোগিতায় বারসিক’র বাস্তবায়নে পরিবেশ প্রকল্প শুরু হলে মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের বড়ভেটখালী গ্রামে খলিশা সিএসও দলে যুক্ত হয় মুঞ্জরী রানী (৪১)। যুক্ত হওয়ার পর থেকে তিনি নিয়মিতভাবে সাপ্তাহিক দলীয় আলোচনায় সভায় অংশগ্রহণ করেন। দলে যুক্ত হওয়ার কিছুদিন পরে বারসিক পরিবেশ প্রকল্প থেকে তার পারিবারিক ও ব্যবসায়িক উন্নয়ন পরিকল্পণা গ্রহণ করা হয়। যার প্রেক্ষিতে উৎপাদনশীল সম্পদ হিসেবে মাছ-কাঁকড়া ধরার নৌকা সহযোগিতা করা হয়। পরিবেশ প্রকল্প থেকে তাকে একই সাথে একটি কদবেল ও সবেদার চারা, একটি ছাগল ও তিনটা মুরগী সহযোগিতা দেওয়া হয়। এরপর বারসিক এর নিয়মিত আলোচনা, প্রশিক্ষণ, পরামর্শ ও সহযোগিতায় সুন্দরবনের সম্পদ আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করতে থাকেন।

এ বিষয়ে মঞ্জুরী রানী বলেন, “বারসিক থেকে একটি নৌকা সহযোগিতা পেয়ে আমরা সহজেই সুন্দরবন থেকে মাছ, কাঁকড়া, মোম মধু সংগ্রহ করতে পারি। স্বামী স্ত্রী মিলে একই সাথে এই কাজটি করতে পারি। এখান থেকে যা আয় হয় তা দিয়ে আমাদের সংসারের সকল খরচ মিটিয়ে ২ ছেলের পড়ালেখার জন্য ব্যয় করি। তার বড় ছেলে নয়ন বিশ^াস (১৫) দশম ও ছোট ছেলে মনি বিশ^াস (১০) ৫ম শ্রেণীতে পড়ালেখা করে।’ তিনি বারসিক পরিবেশ প্রকল্পের মাধ্যমে নিয়মিত সঞ্চয় করেন। এছাড়াও তিনি সুন্দরবনের সম্পদ সংগ্রহের আয় থেকে ৭০০০ টাকা জমা করেন। যেটা পরবর্তীতে তিনি ছেলের মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য ফরমফিলাপ, বইপত্র ক্রয় ও লেখাপড়া জন্য ব্যয় করেন। স্বামী-স্ত্রী মিলে বসতভিটায় মৌসুমভিত্তিক লবণ সহিষ্ণু কৃষি ফসল উৎপাদন করেন। তার বাড়ীতে ৫টি মুরগি ও একটি ছাগল। সুন্দরবন ও সুন্দরবনের নদ-নদী থেকে মৌসুমভিত্তিক মাছ-কাঁকড়া, পোনা, মোম-মধু সংগ্রহ করে যে আয় করেন তা দিয়ে সুন্দরবন নির্ভর নিমাই- মঞ্জুরী দম্পতির সংসার এখন আগের চেয়ে ভালো চলছে বলেই তারা অভিমত পোষণ করেন।

সুন্দরবনের মীরগাং নদীর বাঁধের পাশে নানা দুর্যোগ ও লোনাপানির সাথে খাপ খাইয়ে জীবিকার অন্বেষন করে চলেছেন স্বামী ও স্ত্রী একসাথে। এখানে যে ফসলগুলো টিকতে পারে, যে সবজিগুলো ভালো হয় বা যে হাঁস-মুরগি, কিংবা ছাগল টিকতে পারে সেভাবেই তারা পরিকল্পনা ও উদ্যোগ গ্রহন করেন বলেই মতামত পোষন করেন মঞ্জুরী-নিমাই দম্পতি।

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা, প্রাকৃতিক দূর্যোগ থেকে রক্ষা, বৈশ্বিক উষ্ণতা কমানো সর্বোপরি প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাসহ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মঞ্জুরী রানীর মত হাজারো উপকূলীয় নারী লবণ পানি ও দুর্যোগের মধ্যে নিরব যোদ্ধা হিসেবে টিকে থাকার নিরন্তর প্রচেষ্টা আব্যহত রেখেছেন।

happy wheels 2

Comments