ঘূর্ণিঝড় মিধিলি, আশরাফ, মেনকা, অল্পনা কিংবা ইলিয়াসদের ক্ষত

পাভেল পার্থ
বৃহস্পতিবার থেকে বৃষ্টি ও বাতাস শুরু হয় এবং পরেরদিন ১৭ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় মিধিলি আছড়ে পড়ে বাংলাদেশে। বলা হয়েছে, এই ঝড়ে বাংলাদেশে তেমন কোনো ক্ষয়-ক্ষতি হয়নি। প্রতিটি ঘূর্ণিঝড় নানামুখী দাগ ও আঘাত রাখে নানাজনের শরীর ও মনে। দেশের নানাপ্রান্তে নানা জীবনে তার ক্ষত ও আঁচড় ভিন্ন। একটি ঘূর্ণিঝড়ের খতিয়ান কোনোভাবেই আরেকটি ঝড়ের সাথে তুলনীয় হতে পারে না। কারণ প্রতিটি ঘূর্ণিঝড় মানুষ ব্যক্তিগত ও সামাজিক অভিজ্ঞতায় সামাল দেয়। কারো কাছে ভোলা ঘূর্ণিঝড়, কারো কাছে সিডর, কারো কাছে আইলা আবার কাছে হয়তো জাওয়াদ মর্মান্তিক স্মৃতি। কিংবা কোনো বিস্মৃতি। যার যায়, যার হারায়, সেই জানে কী তার তড়পায়। জনমভর। নিহতের পরিসংখ্যান কিংবা উপড়ানো ঘরের সারি বা তলিয়ে যাওয়া দলিলের স্তুপ দিয়ে কী কোনো দুর্যোগের ভয়াবহতা মাপা সম্ভব? ১৯৭০ সালের ভোলা ঘূর্ণিঝড় থেকে সাম্প্রতিক মিধিলি পর্যন্ত প্রায় বিশেক ঘূর্ণিঝড় আঘাত করেছে বাংলাদেশ। করোনা মহামারীর ভেতর আমফান, ইয়াস, গুলাব, জাওয়াদ ও সিত্রাং আঘাত হেনেছে। ২০২৩ সালে দেশকে সইতে হয়েছে পরপর তিনটি ঘূর্ণিঝড়। ১৪ মে আঘাত হানে মোখা, ২৫ অক্টোবর হামুন এবং সর্বশেষ ১৭ নভেম্বর মিধিলি। মোখা সন্ধ্যায় কক্সবাজারের টেকনাফ হয়েছে উপকূল অতিক্রম করে, হামুন রাতে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার উপকূলে আছড়ে পড়ে। অবশ্য হামুনের আগে তেজ নামের আরকেটি ঘূর্ণিঝড়ও তৈরি হয়েছিল। প্রতিটি ঘূর্ণিঝড়ের নাম বিভিন্ন দেশ দিয়ে থাকে। মিধিলি মালদ্বীপের দেয়া নাম, এর বাংলা মানে ফলপ্রসু। ঘূর্ণিঝড় মিধিলির ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে আমরা একেবারেই আলাপ তুলিনি। অথচ এই আপদ চলতি বছরের আঘাত হানা তৃতীয় ঘূর্ণিঝড়। দেশের বিস্তীর্ণ উপকূলে শারীরিক ও মানসিক আঘাত তৈরি করে প্রতিটি আপদ। মিধিলিও তার বাইরে নয়। আঘাতের দাগ উপকূল ছাপিয়ে দেশের সর্বত্র, এমনকি নগরেও রেখে যায়। সব দাগ সবার নজরে আসে না, সবার ক্ষরণ সবাই দেখতে পায় না। কিংবা হয়তো এড়িয়ে যায়, আড়াল করে বা দাবিয়ে রাখে। হয়তো তাই ভোলা, সিডর, আইলা কিংবা বুলবুল বা ফণী ছাড়া অন্যান্য ঘূণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে আমাদের তৎপরতাগুলো নিশ্চুপ।


মিধিলির বিকেলে শিল্পকলা একোডেমি চত্ত্বরে শুরু হয় ‘রাধারমণ লোকসংগীত উৎসব’। মঞ্চের সামনে বিশাল প্যান্ডেল বৃষ্টি আর বাতাসে ভেঙে পড়ে। মঞ্চের ওপর চেয়ার তুলে অনুষ্ঠান শুরু হয়। মিধিলি উপেক্ষা করে রাধারমণ শুনতে ভিড় বাড়তে থাকে। মিধিলির রাতে সাতক্ষীরা রওনা দেই। পদ্মাসেতু হয়ে ভোর রাতে যখন সাতক্ষীরা নামি তখন বৃষ্টি থেমে গেছে। ঠান্ডা ভেজা স্যাঁতস্যাঁতে চারধার। পলাশপোল খাল পেরিয়ে স্টেডিয়ামের মোড়ে বুট-বাদাম বিক্রি করেন আশরাফ মিয়া। পরিবার নিয়ে আতিরবাগান বস্তিতে ঝুপড়িঘরে থাকেন। স্ত্রীসহ বুট-বাদাম ঠিকঠাক করেন দুপুর পর্যন্ত। বিকাল ৩ টা থেকে ঠেলা ভ্যানে করে বিক্রি শুরু করেন। গভীর রাত পর্যন্ত বাদাম বিক্রি শেষ করেন। দৈনিক ৫০০ থেকে ৬০০ টাকার কেনাবেচা হয়। মিধিলির দিনে বাইরে বের হতে পারেননি। আয় রোজগার হয়নি। রাতে আতিরবাগান বস্তিতে যাই। আশরাফ মিয়ার স্ত্রী ভাত বসিয়েছেন মাটির চুলায়। বাটিতে গুড়ের দলা নিয়ে বসে আছে তাদের ছোট্ট মেয়ে। মিধিলির কারণে রোজগার না থাকায় গত দুইদিন মাছ বা ডিম জুটেনি পাতে। ঘরে থাকা ফাগনু পড়া গুড় দিয়ে মেয়ের কান্না থামাচ্ছেন। এ বছর পরপর ঝড়ের কারণে ৮/১০ দিন আয়-রোজগার বন্ধ ছিল। প্রায় ৫০০০ ক্ষতি। কীভাবে এই ক্ষতি পোষাবেন? আশরাফ মিয়া কোনো জবাব দেন না। তপ্ত বালুতে ফুটে ওঠা বুট আবার বালিতে হারিয়ে যায়।


আকাশে তখন কৃষ্ণ-ধূসর মেঘ। সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই। বেতনা নদীর ধারে বিনেরপোতা জেলে পাড়ার সাধন চন্দ্র রায়ের শুঁটকি মাচানে শুকনো মাছ তোলায় ব্যস্ত নারী পুরুষ। মেঘের আশংকায় দ্রুত পলিথিন বিছিয়ে ঢাকছেন শুঁটকির মাচা। মেনকা দাসী এখানে জোন খাটেন। মাছ কাটা, লবণ মাখানো, মাচাতে শুকানো, উল্টেপাল্টে দেয়া, শুঁটকি গোছানো নানারকম কাজ। ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। কাজ পেলে দিনে পান ২৫০ টাকা। তবে কেবল মাছকাটা, ধোয়া, লবন মাখানো হলে মজুরি কম হয়। মাছ শুকাতে তিনটি প্রখর রোদ লাগে। মিধিলির কারণে দুই দিন শুঁটকি শুকানোর কাজ ছিল না। একদিন কাজ বন্ধ ছিল। আরেকদিন মজুরি কম জুটে। রোদে দেয়া যায়নি বলে, মাছ সংরক্ষণে লবণও বেশি লেগেছে জানালেন মালিক।


রবিবার ভোরে সাতক্ষীরা থেকে শ্যামনগর আসি। পথে বহু আমন ধানের সোনালি কী আধপাকা জমিন ঝড়ের ধাক্কায় নেতিয়ে পড়তে দেখি। ঈশ^রীপুর ইউনিয়নের ধূমঘাট। বিশালসব কৃষিজমিন এখানে। ধূমঘাটের একজন সফল কৃষক অল্পনা রানী মিস্ত্রি। কৃষিতে অবদানের জন্য পেয়েছেন বঙ্গবন্ধু পদক। আমন মওসুমে সাড়ে চার বিঘা জমি চাষ করেছেন। মিধিলির কারণে প্রায় তিন বিঘা জমির ধান পড়ে গেছে। বিঘাতে ১৮ মণ ধান পেতেন। কিন্তু মিধিলির কারণে এ বছর কমপক্ষে ১০ মণ ধান কম পাবেন। আশংকা করছেন আরো ধান চিটা হবে। ঈশ^রীপুর নয়; বুড়িগোয়ালিনী, মুন্সীগঞ্জ, কাশীমাড়ি, আটুলিয়া ও পদ্মপুকুর ইউনিয়ন ঘুরে দেখলাম বহু মানুষের আমন ধানের ক্ষতি হয়েছে। কৃষকেরা ঝরে পড়া ধানগাছ একত্র করে আঁটি বেঁধে দাঁড় করিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। কৃষকের শ্রম ও সময়ের খরচ বেড়ে গেছে। বহু কৃষক জানালেন, ঝরানো ও ফেলানো দাউলেরা (ধান শ্রমিক) কাটতে চায় না। বহু পরিবারে দুশ্চিন্তার ছাপ। এবার ধান কাটা-মাড়াইয়ের খরচ বাড়বে। সাধারণভাবে দাউলের মজুরি ৩৫০ টাকা হলেও এরকম ক্ষতিগ্রস্ত ধান কাটার খরচ বেশি। এভাবে ধান উৎপাদনের খরচও বেশি হবে এবং উৎপাদনও কম হবে। কিন্তু ধানের বাজারমূল্য বাড়বে না। নওয়াবেকীঘাট থেকে পদ্মপুকুরের পথে, খোলপেটুয়া নদীতে নৌকায় মিধিলি নিয়ে আলাপ জুড়লাম। এক প্রবীণ নারী খনার এক বচনকে স্মরণ করিয়ে দিলেন। যদি বর্ষে আগনে, রাজা যায় মাগনে। মিধিলির কারণে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তাতে হয়তো অভাব তৈরি হবে না, রাজাকে মাগনে যেতে হবে না, কিন্তু বহু প্রান্তিক পরিবারে এসব আপদ বরাবরই দুর্যোগ পরিস্থিতিই তৈরি করছে।

পদ্মপুকুরঘাট থেকে ঝাপা, পাতাখালী, আশাশুনি, গাবুরা, কামালকাঠি কী বন্যতলা যাওয়ার জন্য বহু মোটরসাইকেল দাঁড়িয়ে থাকে। জনা পঞ্চাশেক। চালক ইলিয়াস গাজীর মোটরসাইকেলে রওনা হই কামালকাঠি। পাখিমারা গ্রামের এই চালক ঘূর্ণিঝড় আইলার পর ‘কৃষক’ পরিচয় হারিয়েছেন। ৮/১০ বছর হলো মোটরসাইকেল চালান, চিংড়িঘেরে কিছু ব্যবসাপাতিও করেন। দিনে ৫০০/৭০০ টাকা আয় হয়। মিধিলির কারণে দুই দিন কোনো রোজগার নাই। বাড়িতে ৬ জন মানুষ। একার রোজগার বন্ধ থাকলে কেবল ক্ষুধা নয়, দুশ্চিন্তাও বাড়ে টগবগ।


দেশে সাধারণত মার্চ থেকে মে এবং অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর ঘূর্ণিঝড় হয়। আশি^নে আইতানি আর কার্তিকে কাইতানি হয়। করোনা মহামারির ভেতর ২০২১ সালেও তিনটি ঘূর্ণিঝড় হয়েছে। এ বছরও তিনটি ঘূর্ণিঝড় হয়েছে এবং বাংলাদেশে আঘাত করেছে। বছরটি ইতিহাসের উষ্ণতম বছর। একইসাথে আছে এল নিনোর প্রভাব। এর ফলে পূর্ব ও মধ্য প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে সমুদ্রপৃষ্ঠ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি উষ্ণ থাকে। সাতক্ষীরা থেকে শ্যামনগর, মিধিলির নানামুখী আঘাত ও দাগ দেখা গেল। জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক বৈশি^ক মঞ্চ, ক্ষয়ক্ষতি তবহিল কিংবা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাকে এসব দাগ ও আঘাতকে গুরুত্ব দিতে হবে। সংকট মোকাবেলা ও আঘাত সামালে আশরাফ, মেনকা, অল্পনা কী ইলিয়াসদের পাশে দাঁড়াতে হবে। কামালকাঠি থেকে পদ্মপুকুরঘাটে ফেরার পথে ঝুরঝুরে হওয়া এক বাঁধ যেন মরণ-চিৎকার দিয়ে ওঠে। জানি সামনে দাঁড়িয়ে আছে শহরের এক প্রশ্নহীন কার্বন-জঞ্জাল আর করপোরেট ভোগবিলাসিতা। এই জঞ্জাল ও বিলাসিতাকে প্রশ্ন না করতে পারলে আমরা কোনোদিন প্রান্তজীবনের ক্ষয়ক্ষতি আন্দাজ করতে পারবো কী?

happy wheels 2

Comments