প্রতিবন্ধকতাকে পিছনে ফেলে কৃষক দম্পতির সফলতা
শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে বিশ^জিৎ মন্ডল
প্রতিটা মানুষের সফলতার পিছনে কারো না কারোর অবদান থাকে। কেউ একা একা তার উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে পারেন না। তার জন্য দরকার কারোর সহায়তা, নিজের আগ্রহ, উদ্যোগ, আত্মবিশ^াস, স্বপ্ন ও সঠিক পরিকল্পনা। এগুলো যদি থাকে এবং ভাগ্য ভালো থাকে তাহলে খুব সহজেও সঠিক গন্তেব্য পৌঁছানো যায়। এরকমই একটি সফল দম্পতি হলো সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার কাশিমাড়ি ইউনিয়নের কাঠালবাড়িয়া গ্রামে গৌরপদ মন্ডল ও উষা রানী মন্ডল। তারা দু’জন সকল প্রতিবন্ধকতাকে পিছনে ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছেন। আর এ এগিয়ে যাওয়া ও সফলতা তাদের একদিনে আসেনি। তার জন্য প্রতি পদে পদে তাদের বিভিন্ন ধরনের বাধা ও প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করতে হয়েছে।
এ দম্পতির জমি জমা বলতে ৩৫ শতক জমি। যার মধ্যে ২৫ শতক ভিটাবাড়ি ও ১০ শতক বিলেন জমি। সাথে আরো ৩ বিঘা বর্গা করা ও ৩ বিঘা বন্ধকী জমি রয়েছে। বর্গা ও বন্ধকী নেওয়া জমি এবং নিজের ১০ শতক জায়গায় প্রতিবছর আমন মৌসুমের ধান চাষ করেন এবং ২৫ শতক ভিঠার ১৭ শতক এর মতো জায়গায় সারাবছর ব্যাপক হারে সবজি ফসল উৎপাদন করেন। এ সবজি চাষের জন্য তারা তাদের বসতভিটা ৩টি ভাগে ভাগ করে বিভিন্ন ধরনের ফসল চাষাবাদ অব্যাহত রেখেছেন। ভিটায় সবজি চাষাবাদ এবং ধানের জমিতে ধান চাষ করে ২ মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন। ছেলেটাকে লেখাপড়া শিখাচ্ছেন। এখন ভিটায় সারাবছর কোনা না কোন সবজি থাকে। গ্রামের একজন সফল কৃষক-কৃষাণী হিসাবে তারা পরিচিত লাভ করেছেন। গ্রামে গেলে কারো কাছে যদি বলা হয় কে ভালো সবজি ফসল চাষ করেন তাহলে সবাই তাদের নামই বলেন। প্রতি মৌসুমে শুধু সবজি চাষ করে সংসারের খরচ ও প্রয়োজন মিটিয়ে প্রায় ২০ হাজার টাকার মতো আয় করেন।
সবজি চাষ ছাড়াও তাদের বাড়িতে গরু আছে ৫টি, ছাগল আছে ১৫টি, মুরগি আছে ২৫টি, পাতি হাঁস ১০টি, রাজ হাঁস ৫টি, মেরী হাঁস ৭টি। বাড়িতে পুকুর আছে। সে পুকুরেও নানান ধরনের মাছ আছে। সব কিছু মিলিয়ে তারা এখন একটি সুখী এবং সুস্থ পরিবার।
![](https://barciknews.com/wp-content/uploads/2020/10/pic-3-1.jpg)
কৃষক দম্পতির কাছে তাদের এগিয়ে যাওযার কথা তাদের সফলতার কথা জানতে চাইলে তারা একে এক তাদের সেই পুরাতন দিনে, তাদের দুঃখ কষ্ট এবং সেখান থেকে কিভাবে বেরিয়ে এসেছেন সেসব কাহিনী বর্ণনা করেন। কৃষক গৌর চন্দ্র মন্ডল বলেন, ‘আমার বয়স যখন ৬ মাস তখন আমার মা মারা যায়। এর কিছুদিন পর আমার বাবাও মারা যায়। আমরা তিন ভাই ছিলাম। আমি সবার ছোট ছিলাম। ভাইয়েরা সেভাবে দেখবে না বলে ঠাকুমা আমাকে মামার বাড়ি মামীর কাছে রেখে দেন। সেখান থেকে মামী আমাকে বড় করেন। তারা আমাকে খুব বেশি লেখাপড়া শিখাতে পারিনি। বয়স যখন ১০-১২ বছর তখন মামার বাড়িতে বিভিন্ন কাজে সহায়তা করতাম সাথে অন্যের বাড়িতে যোনের কাজও করতাম। এর কয়েকবছর পর বাড়ি আসি। বাপের ভিটায় ভাইদের সংসারে। ভাইয়েরা তখন সবাই বিয়ে করেছেন তাদের দু-তিনজন করে ছেলে মেয়ে হয়েছে। আমি তখন একা বাড়ির কাজ যেমন করতাম তেমনি বাইরে নানান ধরনরে যোন মজুরি দিতাম। আর সে সব যোনের টাকা ভাইদের হাতে তুলে দিতাম। শুধু দুবেলা দু মুঠো খাবার জন্য অনেক পরিশ্রম করতে হতো।’
তিনি আরো বলেন, ভাইদের সংসারে থাকলে তারা আমাকে বিয়ের কথা বলেন এবং পাশ^বর্তী গ্রামে বিয়ে দিয়ে দেন। বিয়ের কয়েকদিন যেতে না যেতে ভাইয়েরা আলাদা করে দেন। সবকিছু মেনে নিয়ে আলাদা হই। আর মনে করি এখান থেকে হয়তোবা আমি ভালো কিছু করতে পারবো। সেখান থেকে স্বামী স্ত্রী দুজন মিলে নানাভাবে পরিকল্পনা করতে থাকি। কিভাবে ২০ হাজার টাকা পরিশোধ করবো আর সংসার চালাবো। দুজনের মনের বল ছিলো। যে খুব তাড়াতাড়ি আমরা ঋণের টাকা পরিশোধ করবো। পাশাপাশি ভালো কিছু করতে পারবো। এরপর থেকে আমাদের এক অন্য জীবন শুরুর হয়। বাড়ির কোন স্থান ফেলিয়ে রাখবো না।’
![](https://barciknews.com/wp-content/uploads/2020/10/pic-2-2-1.jpg)
গৌর চন্দ্র মন্ডল বলেন, ‘সব জায়গায ঘরের আনাচে কানাচে, খাল পাড়ে, পুকুর পাড়ে, বাড়ির ভিটায় নানান ধরনের সবজি চাষাবাদ করি। বাড়িতে বিভিন্ন ধরনের গবাদী পশু পালন করি। সাথে অন্যের ধানের জমি, সবজি করার ভিটা হারি (লিজ) নিই। সেসব জায়গায় বিভিন্ন মৌসুমে সবজি চাষাবাদ করি। বাড়ির দিকটা বেশি দেখেন আমার স্ত্রী কৃষাণী উষা রানী। আর আমি বাড়ির কাজের ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন জায়গায় যোন মজুরি দিই। এভাবে বছর দুয়েক যেতে না যেতে যেমন ভাইদের ঋণের টাকা পরিশোধ করি। নিজেরা ৫ কাঠা ভিটা ও ৬ কাঠা ধানের জমি ক্রয় করি। সেখান থেকে আমাদের আর পিছনের দিকে ফিরে তাকাতে হয়নি। সাংসারিক জীবন চলাকালে নানান ধরনের সমস্যা সমানে এসেছে তা আমরা একসাথে মোকাবেলা করতে পেরেছি। দুই মেয়ে ও ছেলেকে মানুষ করেছি। মেয়ে দু’টির বিয়ে দেওয়া। সব মিলিয়ে আমরা এখন ভালো আছি।’
কৃষক দম্পতি আরো জানান, এখন কিন্তু তাদের বাড়িতে বিভিন্ন ধরনের সরকারি-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা আসেন। তাদের এ সবজি চাষের সফলতা দেখে কিছু প্রতিষ্ঠান সহায়তা করেছে। সে অনুযায়ী বারসিক’র শত বাড়ির তৈরির জন্য তাদের বাড়িটি নির্বাচন করেছে। তারা বিভিন্ন ধরনের উপকরণ ও যোগাযোগ সহায়তা চলমান রেখেছে।
সঠিক পরিকল্পনা, মনোবল, আগ্রহ উদ্দীপনা থাকলে সব ধরনরে বাধা অতিক্রম করে সফলতার দ্বারে পৌছানো যায়। সাথে পাশে যদি সাহস ও শক্তি সঞ্চারিত করার মতো কেউ থাকে তাহলে কোন বাধায় আর বাধা থাকে না। সব রকমের প্রতিবন্ধকতাতে পিছনে ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।