কৃষাণী শারমীনের বৈচিত্র্যময় জীবনের গল্প বলি
নেত্রকোনা থেকে খাদিজা আক্তার লিটা
কৃষাণী শারমীনের বৈচিত্র্যময় জীবন চলার গল্পটি শুরু করছি একটু ভিন্ন ভাবে। অন্যান্য বছরের তুলনা বৃষ্টি পরিমাণ বেশি হওয়ায় চলতি বছর ধান চাষ করে হতাশ হয়েছেন কৃষকরা। দুইবার করে বীজতলা করেও জমিতে লাগাতে পারেননি। বারবার বীজ কেনার ফলে চলতি বছর উৎপাদন খরচ বেড়েছে। নেত্রকোনা জেলা আমতলা ইউনিয়নের অনেক গ্রামে এ বছর ধানের ফলন একেবারে কম, পতিত পরে আছে অনেক জমি। অন্যান্য বছরের তুলনায় ধানের দাম থাকলেও কৃষকরা হতাশ। এমনি আশা নিরাশায় যখন কৃষকরা দুলছে সেই সময় আমতলা ইউনিয়নের বিশ্বনাথপুর গ্রামে কৃষাণী শারমীন বেগম চলতি বছর দ্বিতীয়বারের মতো কাবুন্দুলান ধান চাষ করে ভালো ফলন পেলেন। ধান কাটার আগেই ধানের ফলন ও রং এলাকার অন্যান্য কৃষকদের নজর কাড়ে। নেত্রকোনা জেলা আমতলা ইউনিয়নের বিশ্বনাথপুর গ্রামের কৃষাণী শারমীন কাবুন্দুলান ধান চাষ সম্পর্কে বলার আগে শারমীন সম্পর্কে একটুকু বলে নিই ।
শারমীন একজন আদর্শ কৃষাণী। তিনি সারাবছর সবজি চাষ করেন তাঁর ২০ শতাংশ জমিতে। সীম, লাউ, ডাটা, বেগুন, খিরা, লালশাক,, পুঁইশাক, মরিচ, পেঁয়াজ, রসুন, ধনিয়া সব ধরনের ফসল চাষ করেন মৌসুম অনুযায়ী। সেই সাথে প্রতিটি সবজি ও মসলার বীজ সংগ্রহ করেন তিনি। প্রতিটি ফসলের বীজ তিনি সযতেœ রাখেন নিজ সন্তানের মতো। মাত্র সাত কাঠা জমির উপর তাঁর এক ছেলে এক মেয়ে এবং স্বামীকে নিয়ে চারজনের সংসার চালাতে হয়। কোন একটি ফসল মার খেলে আর্থিক সংকটে পড়তে হবে। তাই কোন অবস্থাতেই যাতে ফসল নষ্ট না হয় সেদিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। বাজারে কেনা বীজ যে কোন সময় মার খেতে পারে। অধিকাংশ প্যাকেটের বীজ ঠিক থাকে না, তাই বীজ সংগ্রহের বিষয়ে খুবই যতœশীল তিনি ।এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি বাজারের বীজের উপর ভরসা পাইনা, নিজের হাতের বীজ রাখলে মনে শক্তি থাকে, আমার বীজ আমার শক্তি।’
সবজি বীজ রাখলেও ধানের জন্য বাজারের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। কিন্তু চলতি বছর নিজের ঘরে রাখা ধানের বীজ চাষ করে ভালো ফলন পেলেন। ৪ কাঠা জমিতে কাবুন্দুলান ধান চাষ করেন নিজের ঘরে রাখা বীজ থেকে। শারমীনের এ কাবুন্দুলান ধানে বীজ সংগ্রহের পেছনের ইতিহাসটা অনেকটা এ রকম:
মগড়া নদীর পাড় ঘেঁষা গ্রাম গাছগড়িয়া ও বিশ্বনাথপুর। গ্রামের ধানিজমিগুলো সব ধান প্রায় একই ধরনের। বাজার থেকে ধান বীজ সংগ্রহ করে থাকে অধিকাংশ কৃষক। ধান বৈচিত্র্য বৃদ্ধি, বাজার নির্ভরশীলতা কমানো ও এলাকা উপযোগী ধানের জাত নির্বাচনের লক্ষ্যে ২০১৮ সালে নেত্রকোনা জেলার গাছগড়িয়া কৃষক সংগঠন বারসিক’র সহায়তায় ধান জাত গবেষণা প্লট করে ১৩টি জাত নিয়ে। নির্দিষ্ট সময় ধান কাটার সময় মাঠ দিবস করা হয়। গাছগড়িয়া গ্রামের সেই মাঠ দিবসে অংশ নিয়েছিলেন শারমীন। মাঠ দিবসে কাবুন্দুলান ধান পছন্দ করে এবং পরবর্তী সময় শারমীনসহ গ্রামের ৫ জন কৃষক নিজেদের পছন্দ মতো এক কেজি করে কাবুন্দুলান ধানের বীজ নিয়ে যায়।
ধানটি পছন্দ করে নিয়ে গেলেও পরবর্তী মৌসুমে লাগানোর পর অতি বৃষ্টিতে বিশ্বনাথপুর গ্রামের অধিকাংশ কৃষকের জালা নষ্ট হয়ে যায়। শারমীন একজন দক্ষ কৃষাণী। তিনি বর্ষা মৌসুমে জালা নষ্ট হতে পারে ভয়ে পছন্দের ধান সবটকু এক সাথে চাষ না করে কয়েক মুষ্টি রেখে দেন। সেই কয়েক মুষ্টি ধান দিয়ে যাত্রা শুরু তাঁর। জমির এক কোনায় চাষ করে ফলন দেখে বুঝতে পারেন কাবুন্দুলান একটি এলাকা উপযোগি ধান। তাই যেটুকু ধান পান সবটুকু রেখে দেন বীজ হিসেবে। চলতি মৌসুমে ৪ কাঠা জমিতে কাবুন্দুলান ধান চাষ করে গ্রামের কৃষকের নজর কাড়েন। কাঠাপ্রতি ধানে ফলন পেয়েছেন ৫ মণ। অন্যান্য ধানের তুলনায় ভালো হওয়ায় গ্রামে এখন বীজের চাহিদা অনেক। তাই এ বছর যে পরিমাণ ধান উৎপাদন করেছেন তা অর্ধেক রেখে দিয়েছেন বীজ হিসেবে। বাকি ধান সিদ্ধ দিয়ে খাওয়া শুরু করেছেন। ধানের স্বাদ সম্পর্কে শারমীনের স্বামী শামিম মিয়া বলেন, ‘ধানের ফলন যেমন ভালো খেতে সুসাদু।’
কোন ধরনের সার বিষ ব্যবহার না করে জমিতে যে পরিমাণ ফলন পেয়েছেন তা দেখে শারমীনের মতো তার কৃষক স্বামী শামীম মিয়াও খুব খুশি। ধানের ফলন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ধানের ফলন অন্যান্য ধানের তুলনায় ভালো হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, এ ধানের বীজ আমরা রাখতে পারব, ঘরে বীজ থাকলে মনে শক্তি থাকে। চিন্তা কমে যায় অনেক। বাজারের বীজ লাগালে মনে সবসময় ভয় থাকে কি জানি ভালো না মন্দ।’
বীজ সংগ্রহ করা যেমন শারমীন সচেতন সেই সাথে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনকারী হিসেবে তাঁর সুনাম রয়েছে এলাকাজুড়ে। তিনি সারাবছর সম্পূর্ণ জৈব সার ও জৈব বালাইনাশক ব্যবহার করে ফসল উৎপান করেন।একসময় মাটিতে গর্ত করে জৈব সার তৈরি করলেও বারসিক’র সহায়তায় বর্তমানে নিজ বাড়িতে ভার্মি কম্পোষ্টের হাউজ তৈরি করে সার উৎপাদন করছেন, যা দেখে এলাকার অনেক কৃষি বাড়িতে কম্পোষ্ট তৈরি হচ্ছে।
সবজি, ধান চাষ করেই থেমে থাকেননি তিনি। সারাবছর গরু, হাঁস, মুরগি পালন করেন। ৮ম শ্রেণী পাস শারমীনের স্বামীর তেমন পড়াশুনা জানেন না। শারমীন নিজের সবটুকু শিক্ষাকে কাজে লাগিয়েছেন পরিবারে একটু আয় বাড়াতে। তাঁর লক্ষ্য হচ্ছে, যে করে হোক নিজের এক ছেলে এক মেয়েকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবেন। তাই নিজের যেটুকু সম্পদ আছে সেই সাথে নিজের পরিশ্রম পুঁজি করে জীবন পরিবর্তনের লড়াই করেন যাচ্ছেন।
শারমীন একজন দক্ষ দরজি বটে। পরিশ্রমী এ নারীর আরও একটি ভিন্ন পরিচয় রয়েছে শারমীন খুব ভালো কাপড় সেলাই করেন। সারাদিন সবজি ক্ষেতে কাজ ও সংসারের কাজ করেন। তবে সুযোগ পেলেই কাপড় তৈরি করতে বসেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, বাড়িতে বসে অন্যের সমালোচনা না করে দুটু জামা সেলাই করলে যে টাকা আসবে তা দিয়ে আমার সংসারে কিছুটা হলেও আয় হবে। সবচে’ বড় কথা সেলাইয়ের কাজ শিখার পর নিজের পরিবারের কাপড় সেলানোর জন্য অন্যের উপর নির্ভর করা লাগে না।’
দিনরাত পরিশ্রমের ফলে শারমীনের সংসারে পরিবর্তন আসছে। ছেলেমেয়েদের জীবন কিছুটা নিশ্চিত হয়েছে। শারমীনের এ পরিশ্রম ও জীবন পরিবর্তন গল্পে গ্রামের অনেক নারীকে সীমিত সম্পদ কাজে লাগাতে উৎসাহ দিয়েছে, আগ্রহ বাড়ছে নিরাপদ সবজি উৎপাদনে, বীজসংগ্রহ এবং পশু পালনে। অনেক কিশোরী তাঁর কাছে সেলাই শিখে হাতের কাজে দক্ষ হয়ে উঠেছে।
কাবুন্দুলান ধানকে কেন্দ্র করে যে শারমীনের বৈচিত্র্যময় জীবনের গল্প শুরু করেছিলাম এ গল্প আমাদের দেশে অনেক পুরানো গল্প। যুগ যুগ ধরে আমাদের নারীরাই নিজের সন্তানের মতো বীজ সংগ্রহ করে রেখেছেন। নারীদের কারণে এখনো অনেক পরিবার বাজারের উপর নির্ভরশীল না হয়ে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করছেন। নারীদের কারণেই এখনো পৃথিবীতে অনেক বীজ পৃথিবীতে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। আমাদের চারপাশের এ ধরনের আগ্রহী নারীদের কাজ অনেক নারীর সীমিত সম্পদ আকড়ে ধরে জীবন চলা পথ চলতে উৎসাহ দেবে।