আমার মা, সেরা মা

রাজশাহী থেকে ফারহানা হক আখি

তখন চলছে বর্ষাকাল, দিনটি ছিল ৩ আষাঢ় (২২ শে জুন, ১৯৯৩)। ভোরবেলা থেকেই কখনো অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে, কখনো বা রৌদ্রজ্জ্বল হচ্ছে চারদিক। এর মধ্যেই একজন নারী, কন্যা-জায়া রূপে অধির আগ্রহে প্রহর গুনছে জননী হওয়ার প্রতিক্ষায়! কারণ, ডাক্তার বলেছেন এ দিনেই তার প্রথম সন্তান পৃথিবীতে আসতে চলেছে। তাই প্রসব যন্ত্রণা তার কখনো তীব্র আকার ধারণ করছে, কখনো বা শিথিল হচ্ছে। শারীরিক এ রকম অবস্থা দেখে তার মায়ের বাড়ির লোকজন তাকে স্থানীয় ‘মাতৃ মঙ্গল কেন্দ্র’ নিয়ে যান। সেখানে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে, তার স্বামী তাকে ভর্তি করেন রাজশাহী পদ্মা ক্লিনিকে তখন ঘড়ির কাটায় রাত প্রায় সাড়ে আটটা। সেই সময় ঐ ক্লিনিকে দায়িত্বরত গাইনী ডাক্তার ছিলেন ডা. মিস. সুইটি। ঘড়ির কাটা যখন ১২টা পেরিয়ে গেছে তখন তরিখটাও বদলেছে। এ সময় প্রসব যন্ত্রণা এতটাই তীব্র ছিল যে, সে নিজেই তা সহ্য করার ক্ষেত্রে ভেঙ্গে পড়ছিল।

কারণ, একে তার শারীরিক অবস্থা ভালো ছিল না, অন্যদিকে তার সন্তান স্বাভাবিকভাবে (নরমাল ডেলিভারী) হওয়ার সম্ভাবনা ছিল খুবই কম। তারপরও ডা. সুইটি সময় নিয়ে তাকে বারবার সাহস দিয়ে মনবল শক্ত করে রাখার জন্য বলে যাচ্ছিলেন। এক পর্যায়ে আকাশ সমান কষ্ট সহ্য করার পর জন্ম নেয় তার সন্তান। সন্তানের মুখ দেখেই নিজের সকল শারীরিক কষ্ট ভুলে যান মা। বাইরে ঝুম বৃষ্টি, ঘড়ির কাটা যখন রাত ১: ৩০ এর কাছে তারিখ তখন ২৩ শে জুন (৪ আষাঢ়) আমার জন্ম হওয়ার সাথে সাথে জন্ম হয়েছিল এক নারীর কন্যা-জায়ার পরে জননী রূপে, তিনিই হলেন আমার আম্মু যার নাম গুলশানারা হক রুমি (তথ্য সূত্রঃ আম্মুর ডায়েরি, ১৯৯৩)।

Akhi

আমি জন্মানোর পর আম্মু নানু বাড়ি বেশি দিন থাকতে পারেননি। কারণ, আব্বু ও বড় আব্বু এক বাড়িতে থাকাতেন। বড় আব্বুর তিন ছেলে। ঐ বাড়িতে আমি প্রথম মেয়ে সন্তান হওয়ায় সকলের আনন্দের সীমা ছিল না, আমার তিন ভাইয়ের বোনের শখও পূরণ হয়েছিল। মজার ব্যাপার হল, আমার আব্বু ও বড় আব্বু ভাইয়ে ভাইয়ে ভাইরা ভাই! সে ক্ষেত্রে আমি সবদিক থেকে দ্বিগুণ আদর পেতাম।

যৌথ পরিবারে থাকায় আম্মুকে গৃহস্থালির অনেক কাজ করতে হতো। সে সময় ইচ্ছা থাকলেও আম্মু আমার ঠিক মতো যতœ নিতে পারত না। এ সময় আমার পুরো পৃথিবীটা ছিল বড় আম্মু, যিনি আমার মায়ের বড় বোন, অর্থাৎ আমার বড় খালামনি। আমার বয়স যখন সাড়ে তিন তখন বোনের জন্ম হওয়ায় আমি আম্মুর থেকে আরো দূরে সরে যায়। সে সময় মনে হতো, আম্মু আমাকে ভালোবাসে না বলে পিচ্চি একটা মেয়েকে কিনে নিয়ে এসেছে! বড় আম্মুকে ছেড়ে গ্রামের বাড়ি থেকে বাজারের বাড়িতে আসার পর আব্বু সবচেয়ে কাছের হয়ে গেছিল। আম্মুর সাথে দূরত্বটা কেন জানি না থেকেই গেছিল। কিন্তু এখন ভাবলেই অবাক লাগে আমার জীবনের সকল ভালো কিছুর পিছনে যে মানুষটা উৎসাহ দিয়ে গেছেন তাকে আমি বুঝতে পারিনি। ছোট থেকেই নিজ হাতে গান শেখাতেন আম্মু। গ্রামে থেকে রাজশাহীর সবচেয়ে ভালো স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্তানকে পড়ানো চারটেখানি ব্যাপার না! আর এর পুরো ক্রেডিটটায় আমার মায়ের। এর জন্য তাকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জনের কাছ থেকে কথা শুনতে হয়েছে। এখন অবশ্য সকলেই তাকে বাহবা দেয়!

আম্মু আমার কতটা আপন তা আমি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি ২০১৪ সালে। রাজশাহী কলেজের বাস একসিডেন্ট হওয়ায় গুরুতর আহতদের কাতারে যখন আমি ছিলাম, আমার মা তখন পাগল প্রায়! নাওয়া-খাওয়া, সংসার ও আরো দুই বাচ্চা ফেলে রেখে দীর্ঘ এক মাস আর.এম.সি তে পড়ে ছিলেন আমাকে নিয়ে। আমাকে নিজের পায়ে দাঁড় করিয়ে স্বাভাবিক জীবনে নিয়ে আনাটা ছিল আমার মায়ের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ। দীর্ঘ কয়েক মাস অক্লান্ত পরিশ্রম করার পর আম্মু এ চ্যালেঞ্জটা জিতে যায় মানে আমি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসি।

এরপর থেকেই আমি মূলত বুঝতে পারি মা আমার কাছে সবচেয়ে আপন। আমার সবটা জুড়ে আছে আম্মু। ছোট থেকে আমি দেখতে বাপ-চাচা, দাদির মত ছিলাম। ২০১৪ সালের পর মাকে মা আর আমার মাঝে দূরত্ব বিলীন হওয়ায় আমি দেখতে আম্মুর মত হয়ে গেছি। “হঠাৎ যে দেখে সেই ই বলে আখি তুই দেখতে তোর মায়ের মত হয়ে গেছিস। তোদের দেখলে মনে হয় তোরা দুই বোন।” পৃথিবীর সকল মা সন্তানের জন্য নিঃস্বার্থ, নির্ভীক, পরম করুণাময়ী, ক্ষমাশীল, ভালোবাসার মূর্ত প্রতীক। মায়ের কোন তুলনা হয় না। সব সময়ের মত আজও বলছি, অনেক বেশি ভালোবাসি মা তোমাকে, ভুল করেও যদি ভুল করি কখনো, ক্ষমা করো আমাকে! সুস্থভাবে, সম্মানের সাথে বেঁচে থাক পৃথিবীর সকল মা। নিরন্তর ভালোবাসা প্রতিটা মায়ের জন্য।

happy wheels 2

Comments