‘আমি জানতাম, আমিই চ্যাম্পিয়ন হবো’

নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
নেত্রকোনা জেলার আঞ্চলিক ট্রি অলিম্পিয়াড-২০১৮ এর চ্যাম্পিয়ন অব দ্যা চ্যাম্পিয়ন এর গৌরব অর্জন করা আনিকা আক্তার পপি তার দৃঢ় কন্ঠে প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার বিষয়ে এ কথাটিই বলে। স্বরমশিয়া ইউনিয়নের আইমা গ্রামের মেয়ে আনিকা। চার ভাই বোনের মধ্যে সে দ্বিতীয়। বর্তমানে সে লক্ষ্মীগঞ্জ ইউনিয়নের বিরামপুর গ্রামের হাজী ফয়েজ উদ্দিন আকন্দ উচ্চ বিদ্যালয়ের এস.এস.সি পরীক্ষার্থী।

আনিকার বাবা ওয়ারেছ উদ্দিন ফকির একজন কৃষক। তিনি পড়ালেখা জানেন না বললেই চলে। মূলত মায়ের অনুপ্রেরণাই আনিকার এগিয়ে যাওয়া। কারণ তার মা পারুল আক্তার একজন শিক্ষিত নারী। আনিকার মা যখন নবম শ্রেণিতে পড়েন তখন তাঁর বিয়ে হয়ে যায়। তবু পড়ালেখায় তিনি থেমে থাকেননি। পরিবারের সকলের মতামতকে অগ্রাহ্য করে তিনি পড়ালেখা চালিয়ে যান। তাঁর বড় সন্তান যখন গর্ভে তখন তিনি এস.এস.সি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু এক বিষয়ে অকৃতকার্য হওয়ায় পরে তিনি আর পড়া লেখা চালিয়ে নিতে পারেননি, পরিবার থেকে কেউ মেনে নেয়নি। তাঁর জীবনের অসমাপ্ত ইচ্ছা আর অদম্য মনোবলের কারণে স্বামীর পরিবারের সকলের বিরুদ্ধে গিয়ে তিনি সন্তানদের শিক্ষিত করে তুলতে চান। আনিকার বড় ভাই কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ এর দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। সেটাও শুধুমাত্র তাঁর কারণে।

আনিকার শিক্ষা জীবন শুরু হয় তার মায়ের হাত ধরেই। মা যেহেতু পড়ালেখা জানেন তাই মায়ের কাছেই অক্ষর চেনা। ছোট বেলায় মায়ের সাথে সাথে থেকে খেলার ছলে অক্ষর, সংখ্যা, ছড়া ও বিভিন্ন উপকরণের নাম শেখা হয়ে যায় আনিকার। পরে মায়ের ইচ্ছাতেই তাকে ভর্তি করা হয় অভয়পাশাস্থ আদর্শ শিশু শিক্ষালয় নামক কিন্ডারগার্টেন স্কুলে। এই প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করার পেছনে তাঁর মায়ের যুক্তি ছিল যে এখানে পাঠ্যপুস্তকের বাইরেও অনেক বই পড়ানো হয়। যা পড়লে শিক্ষার্থীদের মেধার বিকাশ হয়।

২০১৩ সালে আনিকা উক্ত প্রতিষ্ঠান থেকে জিপিএ ৫ পেয়ে সমাপনী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। এর পর সে ভর্তি হয় হাজী ফয়েজ উদ্দিন আকন্দ উচ্চ বিদ্যালয়ে। তার গ্রামের কিছু দূরেই অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল। কিন্তু এই উচ্চ বিদ্যালয়টি তার বাড়ি থেকে অনেক দূরে। কিন্তু তবুও আনিকার মা তাকে এই প্রতিষ্ঠানে পড়াতে চেয়েছে। এর কারণ হচ্ছে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে আলাদা। এখানে পড়ালেখার পাশাপাশি নিয়ম শৃঙ্খলা আর সাংস্কৃতিক চর্চা চলে সমান তালে। বিভিন্ন অঙ্গনে এখানকার সকল শিক্ষার্থী সমান পারদর্শী। ২০১৬ সালের অষ্টম শ্রেণির পরীক্ষাতেও সে জিপিএ ৫ পেয়েছে। এবারে এস.এস.সি পরীক্ষাতেও ভালো করার আশা আছে।

আনিকা কিন্ডারগার্টেনে পড়ার সময় থেকেই সেই প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও প্রতিযোগিতায় অংশ নিতো। পড়ালেখার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক বিভিন্ন আয়োজন যেমন গান, কবিতা আবৃত্তি, অভিনয় ইত্যাদি আয়োজনেও সে অংশগ্রহণ করে বহুবার পুরষ্কৃত হয়েছে। প্রতিবছর পুরষ্কার পাওয়ার পর এই বিষয়গুলোতে তার আগ্রহ আরো বেড়ে যায়। তখন সে সাধারণ জ্ঞানের বিভিন্ন বই পড়তে শুরু করে। বর্তমানে সে যে প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত সেই প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষকের অনুপ্রেরণা আর সহযোগিতায় নিজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়াও ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলাভিত্তিক বিভিন্ন প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে।

IMG_20190127_111103
২০১৮সালে সরকারিভাবে আয়োজিত ‘বিজয়ফুল’ নামক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কবিতা আবৃত্তি আর একক অভিনয়ে অংশ নিয়ে সে ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে প্রথম স্থান অধিকার করে। কিন্তু জেলা পর্যায়ে প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হওয়ার সময় আনিকার পরীক্ষা থাকার কারণে সেখানে অংশ নিতে পারেনি। আনিকার বড় ভাইও একই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ছিল। সেও বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে বরাবরই প্রথম স্থান অর্জন করতো। তাছাড়া একক অভিনয়ে আনিকার ভাই সব সময় সেরা ছিল। ভাইয়ের অনুপ্রেরণা আর শিক্ষকদের সহযোগিতায় আনিকা সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সফলভাবে অংশগ্রহণ করতে পারছে।

২০১৮ সালে আঞ্চলিক ট্রি অলিম্পিয়াডের প্রথম পর্বে হাজী ফয়েজ উদ্দিন আকন্দ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে। সকলকে পেছনে ফেলে আনিকা প্রথম স্থান অধিকার করে। সে যখন জানতে পারে জেলা পর্যায়ে আবার প্রতিযোগিতা হবে তখন থেকেই সে সাধারণ জ্ঞানের বিভিন্ন বই পড়তে শুরু করে। বিশেষ করে গাছ সংক্রান্ত বিষয়ে সে বেশি পড়ে। এছাড়া তাদের ক্লাসে যখন বারসিক’র আয়োজনে বক্তৃতামালা হতো সেই বিষয়গুলোও সে মনে করার চেষ্টা করে। প্রথমবার পরীক্ষা হয়ে যাবার পর সে বুঝতে পেরেছিল কেমন ধরণের প্রশ্ন হতে পারে। তাই আনিকা ফাইনাল পরীক্ষার জন্য সেভাবেই প্রস্তুতি নিতে থাকে। তার প্রস্তুতিতে কোনো ত্রুটি ছিলনা বলেই নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস ছিল। এবং সে জানতো যে বিজয়ী হবেই। তাই তো গতবছর অক্টোবর মাসে নেত্রকোনায় অনুষ্ঠিত আঞ্চলিক ট্রি অলিম্পিয়াড-২০১৮ এর ফাইনাল রাউন্ডে ১৮৭ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে সে চ্যাম্পিয়ন অব দ্যা চ্যাম্পিয়ন এর স্থান অর্জন করেছে।

প্রতিবছর বিদ্যালয়ের বার্ষিক পরীক্ষাতেও আনিকা প্রথম স্থান অর্জন করে। বাড়িতে তার কোনো গৃহ শিক্ষক নেই। বিদ্যালয়ের পরের সময়টুকু সে মায়ের কাজে সাহায্য করে। আর সন্ধ্যার পর থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত পড়ে। তবে পরীক্ষার আগে একটু বেশি রাত পর্যন্ত পড়তে হয়। ক্লাসে শিক্ষকদের পড়ানো আর নিজের চর্চার কারণেই সে ভালো ফলাফল করতে পারছে। আর সর্বক্ষণ প্রেরণাদায়ী মা তো রয়েছেনই। কখন পড়বে, কিভাবে পড়বে সে বিষয়ে তার মা সারাক্ষণ পরামর্শ দিয়ে থাকেন। শুধু পড়া নয়, সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় কোন কবিতাটি আবৃত্তি করবে, কেমন ভাবে অভিনয় করবে সে বিষয়েও মা-ই তার শিক্ষক। তাছাড়া গুনগুন করে গানের সুরও তার মা-ই তুলে দেয়।

মা, বড় ভাই আর বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের অনুপ্রেরণায় আনিকা পড়ালেখার পাশাপাশি অন্যান্য প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানে দক্ষতার সাথে এগিয়ে যাচ্ছে। আনিকার মা’র বড় শখ, তার মেয়ে বড় হয়ে একদিন বিচারক হবে। তাই মায়ের শখ পূরণ করতে আনিকা ভবিষ্যতে আইন বিষয়ে পড়তে চায়। সাধারণ জ্ঞানের বিভিন্ন বই আর ইংরেজি বিষয়ের প্রতি তার আগ্রহ অধিক। তাই সুযোগ পেলে এই বিষয়ে বিভিন্ন বই সে পড়তে শুরু করে। তবে নিজের পড়া ঠিক রেখে সে।

আনিকার বাবা যেহেতু তেমন পড়া লেখা জানেন না, তাই ছেলে মেয়েদের পড়ার প্রতি তাঁর তেমন কোনো আগ্রহ নেই। আগে ছেলে মেয়েরা না পড়লেও তিনি কিছু বলতেন না। তবে এখন তাঁর চিন্তা ভাবনার পরিবর্তন এসেছে। এই পরিবর্তনের ক্ষেত্রে আনিকার মা’র ভূমিকাই বেশি। তিনি তাঁর স্বামীকে বোঝাতে পেরেছেন শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে। তাই ছেলেমেয়ের পড়ালেখা বা কোনো প্রেিযাগিতায় অংশগ্রহণে তিনি আর বাধা দেননা।

সমাজে মেয়েদেরকে এগিয়ে যেতে অনেক কষ্ট করতে হয়। আনিকার বেলায়ও এর ব্যতিক্রম ঘটেনা। তার পড়া লেখা বা প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া প্রতিবেশিরা ভালো চোখে দেখেনা। তাদের সমালোচনারও জবাব দেন আনিকার মা। নিজে অল্প শিক্ষিত হয়েও ছেলেমেদের নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেন তিনি। বিভিন্ন পেশায় ছেলেমেয়েকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান পারুল আক্তার। সন্তানদের বড় হওয়ার পথকে সুগম করতে পরিবার ও সমাজের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন প্রতিনিয়ত। তাঁর মতো মা প্রতিটি ঘরে থাকলে আমাদের দেশ একটি শিক্ষিত জাতি উপহার পাবে। শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে এগিয়ে যাবে। বন্ধ হবে সমাজের কলুষতা।

happy wheels 2

Comments