করোনায় করণীয়

ঢাকা থেকে সৈয়দ আলী বিশ্বাস

বিশ্বে প্রথম করোনা ভাইরাস প্রার্দুভাব দেখা দেয় চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে। ধারণা করা হচ্ছে, উহান শহরের একটি পশুপাখির বাজার থেকে কোন পশুপাখির মাধ্যমে মানুষ এই ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছে। ৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ চীনে প্রথম করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়। করোনায় পেশেন্ট জিরো ব্যক্তি (কোন রোগে আক্রান্ত প্রথম ব্যক্তিতে সে রোগের পেশেন্ট জিরো বলে) কে তা এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। বিশ্বে এ বিষয়টিকে নিয়েই চলছে নানা অলোচনা, সমালোচনা ও একে অপরকে দায়ী করার প্রচেষ্টা। কিন্তু কিভাবে এই ভাইরাসে মানুষ সংক্রমিত হলো তা আজও প্রমাণিত হয়নি। ইতোমধ্যে বিশ্বে চিহ্নিত করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৩,৫৫,৪৫৫জন যার মধ্যে মারা গেছে ২,৯৩,০৮৮ জন এবং সুস্থ হয়েছে ১৬,১০,৪২১ জন (এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত)। সাতশো কোটি মানুষের দুনিয়ায় এই সংখ্যাটি খুব বড় না হলেও করোনা ভাইরাসের কারণে পৃথিবীর সাতশো কোটি মানুষ-ই শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও অর্র্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত। তাই সারা দুনিয়ার কাছে করোনা ভাইরাস মহামারী রূপ ধারণ করে আতঙ্ক সৃষ্টি করে চলেছে। এই আতঙ্ক থেকে আমরাও মুক্ত নই। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে সনাক্ত করোনা রোগির সংখ্যা ১৭,৮২২জন (১৩ মে পর্যন্ত)। কতজন করোনা জীবানু নিয়ে আমাদের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে তা আমরা কেউ জানিনা। সরকারি হিসেব মতে এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ২৬৯ জন ও আক্রান্তদের মধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৩,৩৬১জন (১৩ মে পর্যন্ত)। দিনকে দিন বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যের সংখ্যা সেই সাথে কর্মসংস্থান ও আয়-রোজগারের চিন্তা এবং সংক্রমিত হওয়ার ভয় সব মিলিয়ে জনমনে বাড়ছে আশঙ্কা ও উদ্বিগ্নতা। এই পরিস্থিতিতে আমাদের কী করণীয় সেটিই এখন সবচেয়ে বড় জিজ্ঞাসা।

গণমাধ্যমের তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায় কাঙ্খিত মাত্রায় করোনা পরীক্ষা না হওয়ার কারণে বাংলাদেশ বর্তমানে কোন অবস্থানে রয়েছে তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা যাচ্ছে না। যদিও সরকার নানাভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে করোনা পরীক্ষার পরিধি বাড়ানোর জন্য তবুও প্রয়োজনের তুলন্য়া সে সংখ্যা এখনও নগণ্য। সরকারের সীমাবদ্ধতার কথা বিবেচনা করলেও বাস্তবতা হচ্ছে এই যে, একজন করোনা আক্রান্ত রোগি যদি সনাক্ত না হয়ে উন্মুক্তভাবে ঘুরে বেড়ায় তবে তার মাধ্যমে প্রায় ৪৩০ জনের মাঝে করোনা জীবানু ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। সরকার একদিকে সাধারণ ছুটি বাড়িয়ে মানুষকে ঘরে থাকার পরামর্শ দিচ্ছে অন্যদিকে দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে গিয়ে কিছু নিয়ম কানুন মেনে সরকারি অফিস, মার্কেট, দোকান, ব্যবসা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের করণীয় কী সে সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে দুই ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে।
এক. বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও সরকারি স্বাস্থ্য বিভাগের নির্দেশিত স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলা অর্থাৎ করোনা ভাইরাসে যেন নিজে আক্রান্ত না হই সে জন্য নিজেকে অন্যদের থেকে দূরে রাখা তথা ঘরে থাকা, নিয়মিত হাত ধোঁয়া, হাঁচি কাশির সামাজিক শিষ্টাচার মেনে চলা ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি যা আমরা সকলেই কমবেশি জানি।
দুই. করোনা মোকাবেলায় নিজেকে প্রস্তুত করা। বৈশ্বিক মহামারী পৃথিবীতে এর আগেও এসেছে, সেটা কোন না কোনভাবে মানুষই জয় করেছে। হয়তো এর পরেও আসবে মানুষ সেটাও জয় করবে। মহামারীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এ থেকে উত্তোরণের জন্য চিকিৎসা বিজ্ঞানের সহযোগিতায় ঔষধ আবিষ্কারের মাধ্যমে তা মোকাবেলা করা হয়েছে নয়তো সম্মিলিতভাবে মনে সাহস ও শক্তি অর্জন করে মন থেকে মহামারীর ভয় দূর করে তাকে মোকাবেলা করেছে।

চলমান এই মহামারী মোকবেলায় উল্লেখিত দুটি পন্থাই অবলম্বন করা যেতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে আমরা যে কেউ যে কোন সময় করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারি। কেননা জীবনের প্রয়োজনে সস্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে দীর্ঘদিন ঘরে বসে থাকা যেমন অসম্ভব তেমনি দেশের কত সংখ্যক মানুষ করোনায় আক্রান্ত তা পরীক্ষা করে নির্ণয় করাও কঠিন বিষয়। যদি দেশের সকল মানুষকে পরীক্ষার আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব হয় তার পরেও যারা আক্রান্ত ও যারা আক্রান্ত নয় তাদের আলাদা করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা বেশ জটিল। সেটি করতে হলে একটি নির্দিষ্ট সময়ে দেশের সকল অঞ্চলের মানুষকে এক সাথে পরীক্ষা করে আলাদা করতে হবে। আর তা না হলে যে ব্যক্তি আজকে করোনা নেগেটিভ হলো সে যে আগামীতে সংক্রমিত হবেনা তার কোন নিশ্চয়তা নেই। এই অবস্থায় আমার চারপাশে কোন না কোন ব্যক্তি করোনা ভাইরাস নিয়ে চলাফেরা করবে এটাই বাস্তবতা। সে ক্ষেত্রে যে কোন সময় আমাদের করোনায় আক্রান্তÍ হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এই ঝুঁকি নিয়েই আমাদেরকে জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে বের হতে হবে। তাই করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় নিজেকে প্রস্তুত করা ছাড়া আমাদের আর কোন বিকল্প নেই।

করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমরা নিজেরা কিভাবে প্রস্তুতি নিতে পারি সেই বিষয়টি নিয়েই মূলত আজকের এই আলোচনা। প্রথমেই বলে রাখা দরকার প্রস্তুতি বলতে এখানে করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় মানসিক ও শারীরিক সক্ষমতাকেই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কিভাবে আমরা আমাদের শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা বাড়াতে পারি সেই বিষয়টি নিয়ে এই আলোচনা। আলোচনায় ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ, স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীদের কিছু বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ এবং মানসিক ও শারীরিক বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত ও গবেষণার ফলাফল নির্ভর তথ্য উঠে আসবে।

বিগত প্রায় দুই মাস সাধারণ ছুটির কারণে আমাদের সকলেই টিভি ও অনলাইনে সময় দেয়ার পরিমাণ অনেক বেড়েছে। কিন্তু এই দুটি জায়গাই বর্তমানে ব্যাপকভাবে করোনাময়। টিভি খুললেই করোনা এমনকি কোন নাটক দেখলেও টিভির স্ক্রিনের নীচ দিয়ে বা ডানে বাঁয়ে বক্স করে চলছে করোনার আপডেট সম্প্রচার। একই অবস্থা অনলাইনে, সেখানেও চলছে করোনার আপডেট তথ্য বিনিময়, তক-বিতর্ক ও করোনার বিশ্লেষণ। এর ফাঁকে ফাঁকে মোবাইল ও ইন্টারনেটে চলে আসছে করোনা সংক্রান্ত নানা ধরণের তথ্য। সেই সাথে বিজ্ঞাপন হিসেবে এমবি, জিবি সংক্রান্ত ছাড় ও প্রনোদনার লোভনীয় অফার। সবকিছু মিলিয়ে দেশসহ সারা বিশ্বে মানুষের একমাত্র আলোচ্য বিষয় করোনা। করোনার মূল নির্দেশনা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাতে গিয়ে করোনা নির্ভর অনলাইনের এমবি, জিবি ব্যবসাও বেশ জমজমাট একটি জায়গা করে নিয়েছে। মহামারীর এই অবস্থায় আমাদের দৈনন্দিন জীবনাযাপনে যে পরিবর্তন এসেছে সেটিও এক ধরনের উদ্বিগ্নতার জন্ম দেয়। বিগত এক মাসে আমার পরিচিত অনেক মানুষকে রাত দুইটা, তিনটা, চারটা এমনকি সারা রাত পর্যন্ত অনলাইনে সময় ব্যয় করতে দেখেছি। এটা কোন সমস্যা নয়, কিছু মানুষ অনলাইনে তাদের কাজের কারণে সবসময় যুক্ত থাকতেই পারে কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বর্তমানে সাধারণ মানুষ যেভাবে অতিমাত্রায় অনলাইনে আসক্ত হয়ে পড়ছে তা করোনা মোকাবেলায় তাদের শারীরিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

শারীরিক সুস্থতার জন্য তিনটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। এক. শরীরিক বিকাশ ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরির জন্য নিরাপদ খাদ্য গ্রহণ। দুই. বিশ্রাম- যা প্রাকৃতিক নিয়মে শরীরের অপ্রয়োজনীয় অংশকে রিসাইক্লিং করে শরীরের ক্লান্তি দূর করে এবং শরীরকে কাজের জন্য প্রস্তুত করে। তিন. কাজ বা শারীরিক পরিশ্রম- এটি শারীরিক কর্মদক্ষতা বাড়ায়। এই তিনটি বিষয়ে কিভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করা যায় তা পর্যায়ক্রমিকভাবে আলোচনা করা হলো-

করোনা মোকাবেলায় নিরাপদ খাদ্য
একমাত্র ভিটামিন ডি ছাড়া সুষম খাদ্যের মাধ্যমে সুস্থ শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় সকল ভিটামিনই পাওয়া যায়। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে বিশেষভাবে কার্যকরি ভিটামিন-বি ভিটামিন-সি ও ভিটামিন-ডি। ভিটামিন-বি ও সি শরীরে পানির সাথে মিশে প্রয়োজনীয় অংশ রেখে অতিরিক্ত অংশ প্র¯্রাবের মাধ্যমে বের করে দেয়। তাই ভিটামিন-বি ও সি প্রতিদিনই গ্রহণ করতে হবে। সাধারণত দুগ্ধজাত খাবার, ডিম, কলিজাসহ প্রোটিনজাত খাদ্যে ভিটামিন-বি বেশি থাকে। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ও বিভিন্ন নার্ভকে সচল ও কার্যকরি রেখে দ্রুত আরোগ্য লাভে ভিটামিন-বি এর গুরুত্ব অপরিসীম। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে খাদ্য চাহিদা শুধু শর্করা দিয়ে পূরণ না করে শরীরের প্রয়োজনীয় ক্যালোরির অন্তত ৩০% নেয়া দরকার প্রোটিনজাত খাদ্য থেকে। এছাড়া অতিরিক্ত শর্করা খেলে শরীরে অপ্রয়োজনীয় মেদ জমা হয় যা থেকে বিভিন্ন ধরনের রোগবালাই সৃষ্টি হয়। অপর দিকে ভিটামিন-সি মানবদেহের জন্য অতি প্রয়োজনীয় একটি মাইক্রো নিউট্রিয়েন্ট। ভিটামিন-সি ত্বক, দাঁত, চুলকে ভালো রাখার পাশাপাশি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় ও বিভিন্ন জটিল রোগের ঝুঁকি হ্রাস করে। সাধারণত লেবু, আমলকীসহ টক জাতীয় ফল ও কাঁচা মরিচে ভিটামিন-সি থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে প্রাপ্ত বয়স্ক নারী-পুরুষের প্রতিদিন ৮০-৯০মিলিগ্রাম ভিটামিন-সি গ্রহণ করা দরকার। শারীরিক সুস্থতার জন্য ভিটামিন-ডি ও খুব গুরুত্বপূর্ণ। শুধু খাবার গ্রহণের মাধ্যমে নয় পরিপূর্ণভাবে ভিটামিন-ডি পেতে হলে আমাদের দরকার প্রকৃতির অফুরন্ত ভান্ডার সূর্যরশ্মিকে। সপ্তাহে দুই-তিনদিন সকাল ৮টা থেকে ১১টা বা বিকেল ৩টা থেকে ৫টার মধ্যে যদি কমপক্ষে আধ ঘন্টা রোদে থাকা যায় তাহলে শরীরের প্রয়োজনীয় ভিটামিন-ডি’র চাহিদা পূরণ হয়ে যায়। সূর্যের তাপে চামড়ার নীচে জমে থাকা চর্বির কোলেস্টেরল থেকে ভিটামিন-ডি শরীরে শোষণ হয় এবং এই প্রক্রিয়াটি শুরু হতে কমপক্ষে ১৫-২০মিনিট সময় লাগে। বিশেষজ্ঞদের মতে বাংলাদেশে অধিকাংশ মানুষের ভিটামিন ডি ডেফিসিয়েন্সি রয়েছে। ভিটামিন বি, সি ও ডি ছাড়াও অন্য যে খাবার উপাদানটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে তা হচ্ছে জিঙ্ক। শরীরে জিঙ্কের পরিমাণ কমলে রক্তে শ্বেতকণিকার কার্যকারিতা কমে যায়। বাদাম, শিম ও দুগ্ধজাত খাদ্যে প্রচুর পরিমানে জিঙ্ক রয়েছে। খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে যদি এসবকে বিবেচনা করা যায় তবে করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেয়া যেতে পারে।

করোনা মোকবেলায় ঘুমের গুরুত্ব
ঘুম হচ্ছে মানুষের শরীরের একটি ঘড়ি যা দিন ও রাতের পার্থক্যকে নির্ণয় করতে সাহায্য করে। ঘুম প্রাকৃতিকভাবে শরীরকে সুস্থ রাখার জন্য মস্তিষ্ককে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে থাকে। মানব দেহের বৃদ্ধি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, স্মৃতি সংরক্ষণসহ মস্তিস্কের সকল কার্যকারিতা ঠিক রাখার জন্য রাতে ঘুম অপরিহার্য। জীবন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জেগে থাকা ও ঘুমানোর জন্য শরীরকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয় এই শরীরবৃত্তীয় ঘড়ি। নিয়মিত ঘুম না হলে শরীরের সকল ধরনের কার্যকলাপে বিঘœ ঘটে। তাই সুস্থতার জন্য নিয়ম মেনে ঘুমানো খুব জরুরী। শরীরের মেটাবলিজম থেকে শুরু করে মেলানিনসহ প্রয়োজনীয় রাসায়নিক শরীরে কখন কিভাবে নি:সৃত হবে তা নির্ধারণ করে এই দেহ ঘড়ি। ঘুমের জন্য যে মেলানিন মস্তিষ্কে নি:সৃত হয় তা সূর্যের আলোয় নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। বিশেষজ্ঞদের মতে, রাত দশটার পর থেকে শরীর মস্তিষ্কে মেলানিন নি:সৃত করতে থাকে। এটি মস্তিষ্কে নি:সৃত হলে মানুষ ঘুমিয়ে পড়ে এবং প্রাকৃতিকভাবেই বিভিন্ন ধরনের টক্সিনকে শরীর থেকে বের করে দেয়। কোন কোন ক্ষেত্রে সেগুলো দিয়েই শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি তৈরি করতে রিসাইক্লিং প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই প্রক্রিয়াটি চলে রাত দুইটা পর্যন্ত। এই সময়ের মধ্যে কোন মানুষ যদি না ঘুমায় তবে শরীরে অপ্রয়োজনীয় চর্বি জমে এবং রিসাইক্লিং প্রক্রিয়া বন্ধ থাকার কারণে তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমতে থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দিনের আলো আসার সময় হলে দেহঘড়ি অপটিক নার্ভ দিয়ে এই আলোর সংকেত মস্তিষ্কে পৌঁছে দেয়। তখন মস্তিষ্ক শরীর থেকে সেরোটোনিন নামের একটি রাসায়নিক নি:সৃত করে এবং মস্তিষ্ক শরীরকে কাজের জন্য প্রস্তুত করে। এই সেরোটোনিন মানুষেন মন ও মেজাজ ফুরফুরে রাখতে সাহায্য করে। বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন গুহায় বসবাসকারী মানুষের ঘুমের কার্যকারিতা পরীক্ষা করে তা প্রমাণ করে দেখিয়েছেন। উল্লেখ্য টিভি, কম্পিউটার, ট্যাব, স্মার্টফোন থেকে বিচ্ছুরিত নীল আলো শরীরে মেলানিন নি:সরণের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্থ করে। যে মানুষ এগুলো রাতে বেশি ব্যবহার করে তাদের সহজে ঘুম আসেনা। কিন্তু প্রাকৃতিকভাবে প্রতিটি মানুষকে দেহঘড়ি একটি নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমের জন্য সংকেত দিতে থাকে। এটি সাধারণত সূর্য ডোবার দুই থেকে আড়াই ঘন্টার মধ্যে শুরু হয়। ঘুমের জন্য শরীরের এই সংকেতকে ধারাবাহিকভাবে উপেক্ষা করার কারণে রাতে ঘুম না আসা একটি বদঅভ্যাসে পরিণত হয়। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে শরীরের উপর। আমাদের সকলেরই প্রয়োজন নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নিজেদের কাজের পরিকল্পনা করা। যে কাজটি আমরা মধ্যরাত পর্যন্ত করি সেটি যদি সকালে সম্পন্ন করি তাহলে রাতে ঘুমের জন্য পর্যাপ্ত সময় থাকবে। ফলে শরীর, মন ও মস্তিষ্ক থেকে আমরা অনেক সহযোগিতা পাব। তাই বলা যায় নিয়মমত রাতে ঘুমিয়েও করোনা মোকাবেলায় আমাদের শরীরকে সুস্থ রাখার প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারি।

পরিশেষে আসা যাক কর্মদক্ষতা বাড়াতে শারীরিক পরিশ্রম নির্ভর কাজ বা ব্যায়ামের বিষয়ে। আমরা যারা শারীরিক পরিশ্রম ছাড়া অফিস নির্ভর কাজ করি বা করোনা পরিস্থিতিতে বাসায় শুয়ে বসে দিন পার করছি, তাদের স্বল্প সময়ের জন্য হলেও ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রম করা দরকার। সেটি দিনের যেকোন সময়েই হতে পারে তবে তা রাতে ঘুমানোর আগে নয়। প্রশিক্ষকদের মতে সবচেয়ে ভালো হয় সকালে ঘুম থেকে উঠে ব্যায়াম করা। কিভাবে ব্যায়াম করতে হবে তা সকলেরই মোটামুটি জানা। একদিনে খুব বেশি কঠোর ব্যায়াম না করে নিয়মমাফিক প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ে ২০-৩০মিনিট করলেই তা শরীরের জন্য যথেষ্ট।

করোনা একটি বৈশ্বিক মহামারী তাই এই মহামারী আমাদের মোকাবেলা করতেই হবে। এই পরিস্থিতিতে নিজেকে যতটা সম্ভব করোনা ভাইরাসের সংক্রমন থেকে নিরাপদ রাখার পাশাপাশি তা মোকাবেলা করার জন্য আমাদের শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা গড়ে তুলতে হবে। যে কোন দুর্যোগ বা মহামারীতে মানসিক অবস্থা ভাল না থাকার কারণে অন্যকে দায়ী করার প্রবণতা বাড়ে। সে থেকেই পরিবারে, কর্মস্থলে বা প্রতিবেশীদের সাথে যে দূরত্ব তৈরি হয় তা মানুষে-মানুষে দ্বন্দ্ব ও অবিশ্বাস তৈরিতে ভূমিকা রাখে। কিন্তু আমাদের কোনভাবেই ভুলে গেলে চলবেনা যে আমাদের নিজস্ব সমাজ, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও পারস্পারিক ভ্রাতৃত্ববোধের বিষয়টি। করোনাকালে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে অতি সন্দেহ প্রবণ হয়ে যেন সামাজিক দূরত্ব তৈরি না করি সেই বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। করোনা মহামারী আজ আছে, এক সময় চলে যাবে কিন্তু প্রত্যাশা করি আমরা সকলেই বেঁচে থাকবো। তাই আমাদের পরিবার, সমাজসহ সকলের সাথে এমন কোন আচরণ করা যাবে না যা অন্যের মনোকষ্টের কারণ হয়ে উঠতে পারে। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় করোনা মহামারী আমরা সফলভাবে মোকাবেলা করবো- এই বিশ্বাস আমাদের মধ্যে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হোক এই প্রত্যশা করি।

happy wheels 2

Comments