সহিষ্ণুতা : শৈশবেই শিখতে হবে প্রাণ ও প্রকৃতি থেকে
ঢাকা থেকে বাহাউদ্দীন বাহার
বর্তমান সময় এক অস্থির সময়। কিংবা সব সময়ই চলমান সময়টা হয়তো অস্থির থাকে। আমরা হয়তো সময়ের সাথে অনেক বেশি গতিশীল হয়ে যাচ্ছি। সাথে সাথে আমাদের আবেগ-অনুভুতিগুলোও হারিয়ে যাচ্ছে-ধৈর্য্য, ভালোবাসা। হয়ে উঠছি অসহিষ্ণু। হত্যা, নির্যাতন, নৃসংসতা, আত্মহনন, ধর্ষণ আমাদের গতিশীল সমাজের এক অবিচ্ছেদ্য অনুসঙ্গ। আমরা হয়ে পড়ছি সহিংস। এই সহিংসতা শুধু মানুষে মানুষে নয়। ছড়িয়ে পড়ছে-প্রাণ এবং প্রকৃতির প্রতিও। কিংবা হয়তো প্রাণ-প্রকৃতি থেকে মানুষে। যেভাবেই ছড়িয়ে পড়–ক; সেটি ক্ষতিকর মানুষ এবং প্রাণ-প্রকৃতি উভয়ের জন্যই।
প্রশ্ন হচ্ছে আমরা কেন সহিংস হচ্ছি বা সহিংস হয়ে পড়ছি? কিংবা কিভাবে আমাদের মধ্যে এই আচরণ তৈরি হচ্ছে? মনোবিজ্ঞান কিংবা আচরণ বিজ্ঞান হয়তো এর সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারবে।
এ বিষয়ে আমার নিজের একটি ব্যাখ্যা আছে। ব্যাখ্যাটা আপনি মানতেও পারেন আবার নাও মানতে পারেন। কিন্তু ব্যাখ্যাটা আমার কাছে যৌক্তিক মনে হয়েছে।
তবে এর আগে আলোচনা করা জরুরি আমরা প্রাণ ও প্রকৃতির প্রতি কী কী ধরনের সহিংসতা করি?
খুব ছোটবেলা থেকে আমার বদঅভ্যাস হচ্ছে গাছ দেখলেই কোন কারণ ছাড়া তার পাতা ছেড়া। আর হাতে যদি লাঠি থাকে তাহলে তো কথাই নেই! লাঠি নিয়ে আমি রাস্তার পাশের ছোট-ছোট গাছগুলোকে মেরে মেরে ন্যাড়া করে ফেলতাম। কিংবা ছোট খেঁজুর বা নারকেল গাছের পাতাকে ধরে মাঝখান দিয়ে ছিড়ে ফেলতাম। আমি শৈশবে প্রায়ই লাল পিপড়া কিংবা বড় কালো পিপড়া (মাজালি) দেখলে এর মাঝখান কেটে দু’টুকরো করতাম, দেখতে চেষ্টা করতাম পিপড়াটা পিছনের অংশ দিয়ে চলতে পারছে কিনা? অথবা আমি প্রায়ই টিকটিকি’র লেজ লাঠি দিয়ে বাড়ি দিয়ে ভেঙে দিতাম। আনন্দ নিয়ে উপভোগ করতাম এবং দেখতে চাইতাম লেজটা কতক্ষণ ছটফট করে। এছাড়া লেজকাটা টিকটিকিটা কীভাবে বেঁচে থাকে তা দীর্ঘদিন পর্যবেক্ষণ করতাম। আমি বলতে গেলে প্রতিদিন শুক্রবারে দলবেঁধে গিরগিটি মেরে সওয়াব অর্জন করার চেষ্টা করতাম! ব্যাঙ ধরে ইনজেকশন দিয়ে পানি পুশ করে দেখতাম ব্যাঙটার ভেতরে কতবেশি পানি ঢুকানো যায় এবং ব্যাংকটা পানিভরা পেটে কতদিন বেঁচে থাকে তা দেখতাম।
ছোটবেলায় আমি খেলার সাথী’র সাথে তুমুল ঝগড়া করতাম! রাতের অন্ধকারে ওর লাগানো ফুল গাছগুলো কেটে ফেলে দিতাম। আমার তখনকার বিবেচনায় পাশের বাড়ির বুড়াটা (!) বেশ কৃপণ এবং একটা খাট্টাস বলে বন্ধুরা মিলে প্ল্যান করে বুড়ার গাছের নারকেল, খেঁজুর রস কিংবা মুরগি ধরে সাবাড় করতাম। যতটুকু না খাওয়া- তার চেয়ে বেশি নষ্ট করতাম।
ছোটবেলার এই ছোট-খাটো (!) ছেলোমানুষি অপরাধগুলো আমরা সবাই খুব সাধারণভাবে নিই। এই অপরাধগুলোকে অভিভাবকগণ দুষ্টমি হিসেবে বিবেচনা করে একটু বকা-ঝকা করে আমাদের ছেড়ে দিতেন। আমরাও অপরাধ করেও পাড় পেতাম। নতুন আপরাধ করার জন্য প্রস্তুতি নিতাম। আমরা ধরেই নিতাম আমরা যা করেছি সেগুলো অপরাধ নয়; দুষ্টুমি মাত্র! দুষ্টুমি করতে আমাদের ভালো লাগতো। কিন্তু, এই দুষ্টুমি বা ঘটনাগুলোই আমার মতো প্রতিটি মানুষের মনে একটি গভীর রেখাপাত তৈরি করে। যেহেতু এসব ছোটখাট (!) অপরাধকে দুষ্টুমি হিসেবে ভাবতাম তাই আমরা শিখতে থাকি ‘যে আমার চেয়ে আপাত দূর্বল; তাকে সহজেই ক্ষতি করা যায়। মেরে ফেলা যায়। কিছু না হোক বিরক্ত করা যায়।’ বিড়াল দেখলেই ফুটবলের মতো লাথি দেই, কুকুর দেখলে ঢিল ছুড়ি অকারণে- এগুলো আমরা তো নিয়মিত চর্চাই করতাম।
এভাবে আস্তে আস্তে এই সহিংসতা উদ্ভিদ এবং প্রাণী থেকে রূপান্তরিত হয় মানুষে। তাই আমরা ধরেই নিই যে, ছোট বোনটার চুল টেনে দেয়াটা অপরাধ নয় কিংবা দূর্বল বন্ধু কিংবা ছোটদেরকে শারীরিক ও মানসিক কষ্ট দেয়া কোন ব্যাপারই না! অন্যদের সাথে অকারণে মারামারি, ঝগড়া এগুলোও হয়ে ওঠে অনুসঙ্গ।
পরবর্তীতে বড় হওয়ার সাথে সাথে এই আচরণগুলো বড় হতে থাকে। বোনের উপর অত্যাচার রূপান্তুরিত হয় বউ কিংবা রাস্তায় হেটে যাওয়া মেয়েটার ক্ষেত্রে- নারী নির্যাতন বা অধুনা ‘ইভটিজিং’। ছোট-খাটো চুরি রূপান্তরিত হয় চাঁদাবাজি কিংবা ছিনতাই এ।
ছোটবেলার এই সহিংস আচরণ আস্তে আস্তে বড় আকারের রূপ নেয়। মানুষ থেকে শুরু করে প্রাণ ও প্রকৃতির দিকে এই সহিংস আচরণ বিস্তার লাভ করে। তাই তো পারিবারিক ঝগড়াকে কেন্দ্র করে বাগানের নতুন লাগানো গাছগুলোকে কেটে ফেলতে আমাদের কষ্ট হয় না, বিবেকে বাঁধে না। কোন প্রতিবেশীর পুকুরের মাছ নিমিষেই বিষ দিয়ে মেরে ফেলতে আমাদের বুকটা কাঁপে না।কিংবা রাতের অন্ধকারে কারও অপরিণত ধান বা কলার বাগান নষ্ট করতে একটু অসস্তিবোধ হয় না আমাদের। অন্যদিকে মিছিল-মিটিং কিংবা রাস্তা অবরোধ করতে হবে- গাছে কেটে খুব সহজেই করা যায়।
খুব আপাত সাধারণ এই ঘটনাগুলো আমাদের সামাজিক মানুষের জীবনে দারুণভাবে প্রভাব পড়ছে। আমরা সভ্য (!), সাংস্কৃতিক (!) মানুষরাই হয়ে পড়ছি সহিংস, হিংস্র। বাড়ি, রাস্তা, অফিস, বাজার- প্রতিনিয়ত আমরা আমাদের অজান্তেই করছি সহিংস আচরণ।
বর্তমান এই সমস্ত সামাজিক ব্যাধি কিংবা আচরণগুলো প্রতিরোধ করতে হলে আমারে শুরু করতে হবে একেবারেই শৈশব থেকেই। পাশাপাশি, মানুষসহ সকল প্রাণ ও প্রকৃতির প্রতি সহনশীল, শ্রদ্ধা এবং কৃতজ্ঞ আচরণ শেখাতে হবে নতুন প্রজন্মকে। পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণ ও অস্তিত্ব যে কষ্ট পেতে পারে এই ‘বোধ’ জাগ্রত করতে হবে সকলের মাঝে, বিশেষ করে শিশুদের মাঝে। তবেই সম্ভব সৌহার্দ্যময়, শান্তিপূর্ণ সমাজ এবং পৃথিবী গড়ে তোলা।
ছবি দু’টি ইন্টারনেট এর উন্মুক্ত উৎস থেকে সংগৃহীত