একটি উৎসবের মাছের মেলা
রাজশাহীর থেকে অমৃত সরকার, অনিতা বর্মণ ও শহিদুল ইসলাম শহিদ
বিলকুমারী বিলের পার্শবর্তী কুঠিপাড়া, ধানতৈর ও গোকুল-মোথুরা জেলেপাড়া গ্রাম। বিকেল থেকেই এই গ্রামগুলোতে আত্মীয়স্বজন আসছেন। উপলক্ষ একটাই ঐতিহ্যবাহী বিলকুমারীর মাছ নিয়ে অনুষ্ঠিত “মাছ মেলা” দেখতে বা মাছমেলায় মাছ কিনতে। তাই তো দেখা গেছে, গত ১০ জানুয়ারি বিকেল থেকেই তিন গ্রামের জেলে পরিবারের পুরুষ সদস্যরা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনায় ব্যস্ত। তাদের আলাপ-আলোচনার মূল বিষয় হচ্ছে, বিলকুমারীতে মাছ সংগ্রহে কয়টি নৌকা নামবে, কোন নৌকাতে কে কে থাকবে ইত্যাদি! কারণ রাত ১২টা বাজলেই প্রতিবছরের মতো এবারো আনুষ্ঠানিকভাবে বিলকুমারী বিলে মাছ সংগ্রহ শুরু হবে যে! তাই জেলে থেকে শুরু করে গ্রামের নারী, বৃদ্ধ, কিশোর ও শিশুদের মধ্যে আনন্দ খেলা করে। ঐহিত্যবাহী মাছ মেলার উৎসবে তারা সবাই শরীক হবেন!
প্রতিবছরে বাংলা পৌষ মাসের সুবিধা মতো সময়ে মাছ মেলার দিন নির্ধারণ করেন স্বানীয় মৎস্যজীবী সংগঠন ও উপজেলা মৎস্য অধিদপ্তর। এই মাছ মেলার পর থেকেই বিল উন্মুক্ত করা হয় সকল জনগোষ্ঠীর মাছ শিকারের জন্য। বিলের পানি যখন মার্চ-এপ্রিল মাসের দিকে কমে যায় তখন আনুষ্ঠানিকভাবে বিলে মাছ শিকার বন্ধ ঘোষণা করা হয়। স্থানীয় মৎস্যজীবী সংগঠন ও উপজেলা মৎস্য অধিদপ্তর বিলের মাছ রক্ষায় বিলের মাঝে ৪টি ছোট বড় অভয়াশ্রম দ্বারা ‘মা’ মাছ রক্ষার উদ্যোগ নিয়েছেন। এই অভয়াশ্রমে সারাবছরই মাছ আহরণ করা নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আবার জুন-জুলাই মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে মাছ ছাড়ার পর বিলের নির্দিষ্ট জায়গাজুড়ে লাল নিশানা দিয়ে মাছ আহরণ নিষিদ্ধ করা হয়।
১০ জানুয়ারি, ২০১৭ রাত ১২টা থেকেই জেলেপাড়ার পুরুষ সদস্যরা নৌকা, জাল ও মাছ রাখার সরঞ্জাম নিয়ে চলে যান বিলের মাঝে। এই উৎসবে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে তারা প্রচন্ড ঠান্ডা এবং কুয়াশাকে উপেক্ষা করে মাছ শিকারে নামেন। ঠান্ডা বা কুয়াশা তাদের কোন সমস্যা হয় না! এই বিষয়ে তানোর কুঠিপাড়ার মোঃ রবিউল উসলাম (৪৫) বলেন, “আনন্দ থাকলে কোন কাজই কঠিন না, পাশাপাশি আজকে আমরা যত মাছ পাব তা আমাদের পরিবারের সকল খরচের একটি বড় ভূমিকা থাকে। তাই আমাদের ঠান্ডার ভয় থাকে না।” সারারাত মাছ সংগ্রহের পর ভোর থেকে উপজেলা ডাক-বাংলো মাঠে শুরু হয় মাছ বিক্রয়ের পালা। এভাবে চলে বিকেল ২টা থেকে ৩টা পর্যন্ত। মেলায় পওয়া যায় পাবদা, খড়ি, ফলি, চিতল, বোয়াল, চিংড়ি, মাগুর, শোল, সিং, ভেদা, আইড়, রুই, কাতলা, সিলভারসহ বিভিন্ন ছোট বড় দেশী মাছ।
তানোর উপজেলা এমনকি পাশের মোহনপুর, মাঁন্দা, রাজশাহী সদর, নাচোল, নিয়ামতপুর থেকে অনেকেই আসেন এই মেলায় মাছ কেনার জন্য। ক্রেতারা সবাই নদীর বিলের মাছের স্বাদ গ্রহণ করতে আগ্রহী বলে সেদিন মাছের দাম তুলনামূলক বেশি থাকে। মাছ কেনার জন্য সকালেই মান্দা থেকে আসা মো. ইসমাইল হোসেন (৪৮) বলেন, “আমি প্রতিবছরই এই মেলায় আসি মাছ কেনার জন্য। কারণ এই বিলের মাছের স্বাদ অনেক। তবে আস্তে আস্তে মেলায় মানুষ বেশি ও বিলে মাছ কমে যাওয়ার জন্য মাছের দাম বাড়ছে।” এই মেলাকে কেন্দ্র করে রাজশাহী, নওঁগা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট থেকে পাইকার ব্যবসায়ীরা আসেন মাছ কেনার জন্য। পাইকারী ব্যবসায়ের সাথে জড়িত নওগাঁ জেলার মো. সাহাজামাল মিয়া (৩৮) বলেন, “আমি আজ থেকে ৪ বছর ধরে এই মাছ মেলায় আসছি। বিল থেকে যে মাছগুলো পাওয়া যায় সে মাছগুলোর ক্রেতা চাহিদা বেশি। একটু কষ্ট হলেও আমাদের লাভ হয় ভালো।” গত ৬ বছর ধরে মেলায় মাছ নিয়ে অংশগ্রহণ করছেন ধানতৈর গ্রামের মো. হাসান আলী (৪২) বলেন, “আগের তুলনায় এখন দেশী মাছ বিল থেকে কম পাওয়া যাচ্ছে। কারণ কিছু অসাধু মাছ ব্যবসায়ীরা অসময়ে মাছ ধরছে। পাশাপাশি বিলে কমেছে বিভন্ন জলজ উদ্ভিদ যেমন সিংগার, লিখার, শালুক, শাপলা যেগুলোতে ‘মা’ মাছ আত্মরক্ষা করে বেঁচে থাকত।”
আস্তে আস্তে এই মাছ মেলাকে কেন্দ্র করে তানোর এলাকায় সৃষ্টি হচ্ছে একটি সার্বজনীন মাছ উৎসবে। এই মাছ মেলাকে কেন্দ্র করেই তানোর এলাকার সকলেই এক স্থানে এসে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনার কেন্দবিন্দু পরিণত হচ্ছে। তানোর এলাকার সুশীল সমাজের সদস্যসহ সকলেই একটি বিষয়ে একমত হয়েছেন, যে বিলকে কেন্দ্র করে একটি এলাকায় উৎসব হয় সে বিলকে দখল, দূষণসহ এর বৈচিত্র্য রক্ষায় সকলেই ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করা উচিত।