দুর্যোগ মোকাবেলায় বৈচিত্র্যময় ফসল চাষ
সত্যরঞ্জন সাহা হরিরামপুর, মানিকগঞ্জ থেকে
কথায় আছে ভাতে মাছে বাঙালি। বাংলার কৃষক-কৃষাণীগণ খাদ্য উৎপাদন আর বৈচিত্র্যতাকে নিয়ে মাঠে চাষ করে হরেক রকমের ধান, শাকসবজি, তেল, মসলা, ডাল জাতীয় ফসল। কৃষকগণ এলাকা অনুযায়ি আউশ, আমন, বোরো মৌসুমে ধান চাষ করে রোপণ বা বপন উৎসবের মধ্য দিয়ে। তাছাড়াও মাটির ধরন অনুযায়ী প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় চাষ করে বিভিন্ন ধরনের ফসল। কৃষকগণ কৃষিবৈচিত্র্য আবাদের মধ্য দিয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় সহায়ক হয়। প্রকৃতির মাটি, আলো, বাতাস, পানির সমন্বয়ে ফসল উৎপাদন হয়। কৃষকগণ চাষাবাদের মাধ্যমে বীজ বৈচিত্র্যতা সংরক্ষণের মাধ্যমে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিতে কাজ করছেন। কৃষকদের সীমিত জমিতে নিজেদের অভিজ্ঞতা, দক্ষতা খাটিয়ে প্রয়োজন উপযোগি ফসল উৎপাদন করে আসছেন। তাঁরা একে অপরের সাথে অভিজ্ঞতা বিনিময় ও পর্যবেক্ষণ করে মাটি উপযোগী ফসল চাষবাদ করেন। এছাড়াও তাদের জ্ঞান খাটিয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্যার পানি মোকাবেলায় নিচু জমিতে দিঘা জাতের ধান চাষে সফল হন।
আবার চর এলাকায় বর্ষা মৌসুমের পানি আসার আগে কম সময়ের (১০ দিন) পরাঙ্গী আউশ ধান চাষ করে ফসল ঘরে তুলেন। মিশ্র ফসল আবাদে পোকার আক্রম কম হয় ও জমির মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পায় সাথে সাথে কৃষিবৈচিত্র্যতাও রক্ষা হয়। কৃষকগণ দুর্যোগ মোকাবেলার জন্যই ভিন্ন ধরনের ফসল আবাদ করে থাকেন। স্থায়িত্বশীল কৃষি আবাদের মধ্য দিয়েই বৈচিত্র্য রক্ষা পায় ও খাদ্যের ভিন্ন ধরনের স্বাদ, রস, গুন মান ঠিক থাকে। এই প্রসঙ্গে কৃষাণি আন্ধারমানিকের কৃষাণী আয়েশা বেগম (৫৫) বলেন, ‘আমি ভিন্নভাবে সক্ষম ব্যক্তি (শারিরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি) হলেও বাড়ির কাজসহ মাঠের সকল কাজ আমার করতে হয়। জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যমই কৃষি করি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মাথায় রেখেই জমিতে ফসল চাষ বপন বা রোপণ করে থাকি। শীত মৌসুমে কুয়াশা, রবি মৌসুমে চাষাবাদে আগাছা ও পোকার আক্রমণ, বর্ষায় পানিতে ফসল নষ্ট, শিলা বৃষ্টি ও ঝড়ে গাছ পালার ক্ষয়-ক্ষতি হয়। চাষাবাদে এতসব দুর্যোগ মাথায় রেখে রকমারি ফসল চাষাবাদ করে ফসল ঘরে তুলতে হয়। তবে গ্রামের সকল নারীই কৃষি কাজে পারদর্শী ফলে সহজে আমরা লাভবান হতে পারি।’ তিনি আরও বলেন, ‘কৃষি কাজে আনন্দ পেতে হলে নতুন কিছু উদ্ভাবন করতে হবে। আমাদের আন্ধারমানিক অগ্রগামী কৃষক সংগঠনের সদস্যদের চিন্তায় আন্ধারমানিক চকে বন্যার আগে একটি ধান জাতীয় ফসল উৎপাদনের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করি। বোরো মৌসুমে ধান কর্তনের পর ৭০ থেকে ৮০ দিনে টুরা বা দু’কাটি ধান আবাদে উদ্ভাবন করে সফলতা অর্জন করি। আবাদের মাধ্যমে কৃষি বৈচিত্র্য রক্ষা করা যায়, নিজে বাঁচা যায়, অন্যদের বাঁচতে সহযোগিতা করা যায়। রকমারি ফসল চাষাবাদে কৃষকগণ লাভবান বেশি হয়। আগামী দিনের সফল কৃষি আবাদে স্বপন দেখায়।’
বরুন্ডির কৃষক গুরুদাস সরকার (৪২) বলেন, ‘কৃষি কাজে আমরা সফল। কারণ হলো বরুন্ডিতে কৃষকগণ নিজস্ব উপায়ে এলাকা উপযোগি ধান ও মসলার জাত বাছায়ে গবেষণা কাজ করছেন। গবেষণার মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ ও নিজ উদ্যোগের মাধ্যমে চাষাবাদ করে সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করি। গবেষণার ফল হিসাবে কৃষকের নিজস্ব গবেষণার মাধ্যমে কাইশ্যাবিন্নি ধান চাষ করে, আমরা বন্যা সহনশীল কাইশ্যাবিন্নি ধান পেয়েছি। যা প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্যায় ১৬ দিন পানির নিচে থাকলেও নষ্ট হয় না; ভালো ধান হয়। আমরা মনে করি বরুন্ডিতে কৃষক নেতৃত্বে গবেষণার মাধ্যমে মানিকগঞ্জ জেলায় ধান বৈচিত্র্য ও মসলা বৈচিত্র্য বৃদ্ধি পাচ্ছে।’ বর্তমানে কৃষকগণ মাঠে চাষ করছেন বিআর-২৯, বিআর-২৮ ও দিঘা ধানের পাশাপাশি কাইশ্যাবিন্নি, মকবুল, মনিশাইল, চিনিগুড়া, আমশাইল এবং পারাংগি আউশ জাতের ধান। কৃষকগণ রবি মৌসুমে তেল, ডাল, মসলা ও শাকসবজি চাষ করে বীজ বৈচিত্র্য সংরক্ষণ করে দুর্যোগ মোকাবেলায় সহায়ক হয়।তাছাড়াও কৃষক পর্যায়ে নিরাপদ খাদ্য বিপদের বন্ধু অচাষকৃত খাদ্য সংরক্ষণে জৈব উপাযে চাষাবাদে উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
অন্যদিকে পাটগ্রামচরের কৃষাণি আজিনা বেগম (৫০) বলেন, ‘কৃষিই চরের মানুষের জীবন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। আমরা নারী-পুরুষ সকলে মিলে আবাদ বসতের কথা ভাবি। কৃষি ছাড়া অন্য কিছু ভাবতেই পারি না। আমাদের বাড়িতে যাই কিছু করি সবই কৃষিকে কেন্দ্র করে। বর্ষার পানি বা বন্যার পানি প্রতিবছরই আমাদের মাঠে বা বাড়িতে প্রবেশ করে। ফলে মাটি ও গোবর সার দিয়ে উঁচু করে লতা জাতীয় শাকসবজি চাষ করে খাদ্যে প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাই। গরু-ছাগল-হাঁস-মুরগি-কবুতর পালন করে বিষ্টা বা গোবর সংগ্রহ করি।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রতি পরিবারে ১০ থেকে ২৫ টি গরু- ছাগল ও ভেড়া পালন করায় গোবর সার দিয়ে কম খরচে জৈব উপায়ে চরের মানুষই চাষ করতে পারি। কৃষি বৈচিত্র্যতা রক্ষায় উপযোগি জায়গা হলো চর। এখানকার মাটিতে ধান, গম, পাইরা, কাউন, তিল, তিশি, ডাল, শাকসবজি, তেল জাতিয় সকল ফসল ফলে। কৃষকগণ মনে করেন সবচেয়ে কম খরচে চরের চাষাবাদের একমাত্র সহায়ক হলো বন্যার ফলে পলি মাটি ও গোবর সার। পলি মাটির ফলে আমরা খুব সহজে সার বিষ ছাড়া সকল ফসল পাই। বীজ রেখে আবাদ করতে পারি। আমি মনে করি কৃষকের কৃষি বৈচিত্র্য ও আবাদ গবেষণারই ফল। তাছাড়াও কৃষি বৈচিত্র্য কৃষকেরই সফলতার ফল।’
প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার মধ্য দিয়েই মাঠে ফসল বৈচিত্র্যে ভরপুর হয়। কৃষক-কৃষাণীদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও অভিজ্ঞতায় দুর্যোগ মোকাবেলার ফলেই শষ্যে ভরে উঠে কৃষকের ঘর, দেশ পরিপূর্ণ হয় খাদ্যশষ্যে। কৃষিতে কৃষকের দক্ষতা ও পরিবেশসম্মত চাষাবাদ বৈচিত্র্যতা সংরক্ষণে সহায়ক হয়। কৃষকগণ যুগ যুগ ধরে টিকে আছে পরিবেশসম্মত উদ্যোগ চর্চার মধ্য দিয়ে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় নিজেরা কৃষি চর্চা করে অন্যান্য কৃষকদেরকে তথ্য প্রদান করে উদ্যোগ গ্রহণে সহায়ক হয়। ফলে পরিবেশসম্মত উদ্যোগ চর্চার মাধ্যমে কৃষি জাতবৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও বিনিময়ের মাধ্যমে চাষাবাদ উদ্যোগ বৃদ্ধি পায়।