সামান্য জমিই কৃষক আবুল কালাম এর সম্বল
নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী
বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ। এদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮০% লোকের জীবন-জীবিকা কৃষির উপর নির্ভরশীল। কৃষিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে বাঙালির সভ্যতা ও সংস্কৃতি। সকালের সূর্য ওঠা থেকে শুরু করে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এদেশের গ্রামাঞ্চলের মানুষের দৈনন্দিন সময় অতিবাহিত হয় কৃষিকে কেন্দ্র করে। ক্ষেতে উৎপাদিত কৃষি ফসলের আয় দিয়েই অধিকাংশ পরিবারের সকল ধরণের ব্যয় পরিচালিত হয়। কোন ধরণের প্রাকৃতিক বিপর্যয় না ঘটলে সারাবছর ক্ষেতে বৈচিত্র্যময় শস্য ফসল চাষ করে এদেশের কৃষকদের জীবন সুখে শান্তিতে চলে যায়। এদেশে অসংখ্য কৃষক পরিবার রয়েছে যাদের একমাত্র পেশা হলো কৃষি। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হলো শুধু সে সকল কৃষকরা, যাদের চাষের তেমন কোন জমি নেই। অতি অল্প পরিমাণে জমির মালিক কৃষকরা কৃষি ফসল উৎপাদনের পাশাপাশি শ্রম বিক্রি বা অন্যের জমি বর্গা বা লিজ নিয়ে বা অন্যান্য কাজ করে পরিবারের ব্যয় চালনা করেন। আবার বেশকিছু কৃষককে দেখা যায় তাদের সামান্য জমিতে নিজ দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে বছরব্যাপী বিভিন্ন মৌসুমে বৈচিত্র্যময় ফসল ফলিয়ে ভালোভাবেই পরিবার পরিচালনা করছেন।
![](https://barciknews.com/wp-content/uploads/2022/06/IMG20220612100954_01-W600.jpg)
নেত্রকোনা সদর উপজেলার কাইলাটি ইউনিয়নের মৌজেবালি গ্রামের কৃষক আবুল কালাম মিয়া এমনই একজন কৃষক। সঠিক কর্মপরিকল্পনা ও একাগ্রতা থাকলে সামান্য জমি দিয়েও ভালোভাবে পরিবার পরিচালনা করা যায় তার প্রত্যক্ষ উদাহরণ কৃষক আবুল কালাম ওরফে কালাচাঁন মিয়া। জাতীয় কৃষি নীতিমালা অনুযায়ী যাদের মোট জমির পরিমাণ ০.৫০ একর বা ৫০ শতাংশের নিচে তারাই ভূমিহীন। সে হিসেবে কৃষক আবুল কালাম একজন ভূমিহীন। বসতবাড়িসহ তার সর্বমোট জমির পরিমাণ মাত্র ০.১০ একর বা ১০ শতাংশ। চাষাবাদের আলাদা কোন জমি নেই। বোরো ও আমন মৌসুমে অন্যের কিছু জমি বর্গা চাষ করেন। স্ত্রী এবং চার মেয়ে ও দুই ছেলেসহ কৃষক আবুল কালামের পরিবারের মোট সদস্য সংখ্যা ৮ জন। ছয় সন্তানের মধ্যে দুই ছেলেই সবার ছোট। তাই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি বলতে তিনিই। বড় মেয়ে ¯œাতকে পড়ছে, মেজো মেয়ে এইচএসসি, সেজো মেয়ে দশম শ্রেণী, চতুর্থ মেয়ে পঞ্চম শ্রেণী এবং ছেলেদের বয়স যথাক্রমে দুই বছর ও ছয় মাস।
স্থাবর সম্পত্তির হিসেবে কৃষক আবুল কালাম একজন অত্যন্ত দরিদ্র ভূমিহীন কৃষক। কিন্ত আমি তাকে দরিদ্র ও ভূমিহীনের তালিকায় ফেলতে নারাজ। কারণ দক্ষতা, মেধা, অভিজ্ঞতা ও মানসিক দিক থেকে তিনি অনেক ধনী। ১০ শতাংশ জমির মধ্যে প্রায় পাঁচ শতাংশ জমিতে স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে থাকার জন্য একটি টিনের বাড়ি, একটি গ্রামীণ বীজঘর ও একটি গোয়ালঘর এবং ছোট একটি ডোবা (১.৫ শতাংশ) রয়েছে। যেখানে তিনি পরিবারের সদস্যদের আমিষের চাহিদা পূরণের জন্য বিভিন্ন ধরণের মাছ চাষ করেন। অবশিষ্ট পাঁচ শতাংশ জমির মধ্যে দুই শতাংশ বাড়ির উঠান। তিন শতাংশ জমির উপর নির্ভর করে তিনি বারসিক’র পরামর্শে শতবাড়ি মডেলে একটি পুষ্টিবাড়ি হিসেবে নিজ বাড়িটিকে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে। বারসিক’র পরামর্শ ও সামান্য উপকরণ সহযোগিতা নিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার “প্রতিটি ইঞ্চি মাটি গরব সোনার ঘাটি” বাণীতে উদ্বুদ্ধ হয়ে জমির প্রতিটি ইঞ্চির সঠিক ব্যবহারে করে বৈচিত্র্যময় গাছের চারা উৎপাদনের জন্য মিনি নার্সারী স্থাপন, বাড়ির চারিদিকে বস্তায় ও উঠানের উপরে মাঁচায় বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ করেছেন।
![](https://barciknews.com/wp-content/uploads/2022/06/IMG20220612100705_01-W600.jpg)
কঠোর পরিশ্রমী কৃষক আবুল কালাম বসতভিটার সামান্য জমিতে বছরব্যাপী যেসব ফসল চাষ করেন তার মধ্যে- পেঁপে, পুইশাক, চিচিঙ্গা, কুমড়া, আখ, মরিচ, বেগুন, করলা, কচু, মিষ্টিকুমড়া, লাউ, লেবু, ডালিম, কাঁঠাল, বরই, আনার, কলা উল্লেখযোগ্য। তিনি তার উৎপাদিত শস্য ফসলের বীজ নিজেই তার বীজঘরে সংরক্ষণ করেন এবং গ্রামের কৃষক-কৃষাণীদের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ ও বিনিময় করেন। তিনি গ্রামের অন্যান্য কৃষক-কৃষাণীদেরকে তাদের পতিত জমির সুষ্ঠু ব্যবহার, পারিবারের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি, পরিবারের সদস্যদের দৈনন্দিন পুষ্টির চাহিদা পূরণ এবং ভালো জাতের বীজ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে বছরব্যাপী বৈচিত্র্যময় সবজি চাষের জন্য উৎসাহিত করেন। স্ত্রী ও চার মেয়ে কৃষক আবুল কালামকে এসব কাজে সহযোগিতা করে শতবাড়ি মডেলে আদর্শ পুষ্টিবাড়ি হিসেবে গড়ে তুলতে। তিনি কৃষকদেরকে বৈচিত্র্যময় শস্য ফসল চাষ, বীজ সংরক্ষণে উদ্বুদ্ধ করতে প্রতিবছর ছোট পরিসরে গ্রামীণ বীজ মেলার আয়োজন করে পরস্পরের সাথে বীজ বিনিময়ের আয়োজন করেন। তিনি কেঁচো কম্পোস্ট উৎপাদন করে বিষমুক্ত উপায়ে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করেন। তারই পরমর্শে গ্রামের প্রায় সকল কৃষকরা এখন নিজ নিজ বসতভিটায় ও পতিত জমিতে বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ করছেন। আগে যেসকল কৃষক বাজার থেকে সবজি কিনে খেতেন, তারাই এখন বাজারে সবজি বিক্রি করছেন। কৃষক আবুল কালমের নেতৃত্বে গ্রামে ২০ জন কৃষক-কৃষাণীকে নিয়ে গড়ে উঠেছে একটি কৃষক সংগঠন। বৈশ্বিক মহামারী করোনা মোকাবেলায় সংগঠনের প্রত্যেক সদস্য প্রচুর পরিমাণে বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ করে সেসব সবজির বীজ সংরক্ষণ করেছেন। নিজের প্রয়োজন মেটানোর পর উদ্বৃত্ত বীজ তারা গ্রামীণ বীজঘরে রেখেছেন । গ্রামীণ বীজঘর থেকে অন্য গ্রামের কৃষক-কৃষাণীরাও বীজ সংগ্রহ করে নিয়ে যান।
কৃষক আবুল কালামের পর্যাপ্ত জমি না থাকায় তিনি ঘর ও বারান্দার কিনারায় বস্তা পদ্ধতিতে মরিচ, বিলাতি ধনিয়া, পুঁইশাক, করলা, কুমড়া ও চিচিঙ্গা চাষ করেছেন। লতা জাতীয় সবজির চারা বস্তায় রোপণ করে ছোট উঠানের উপর উঁচু করে বাঁশ ও সূতা দিয়ে মাঁচা তৈরী করে দিয়েছেন, যাতে চলাচলে কোন সমস্যা না হয়। জমির সীমানায় বস্তায় সবজি চাষ করে বেড়া দিয়ে তার উপর সবজির লতা তুলে দিয়েছেন। ঘরের আনাচে কানাচে সামান্য জমি পতিত না রেখে তিনি তাতে পলিব্যাগে করে বৈচিত্র্যময় গাছের চারা উৎপাদন করেছেন।
মিনি নার্সারিতে তিনি নীম, কাঁঠাল, সুপারি, পেয়েরা, পেঁপে, কৃষ্ণচুড়া, বারোমাসি মরিচ ও জাম’র চারা উৎপাদন করেছেন। চলতি বৃক্ষ রোপনের মৌসুমে তিনি এসব উৎপাদিত চারা বিক্রি করা শুরু করেছেন। ইতিমধ্যে তিনি তার মিনি নার্সারিতে উৎপাদিত ৫ ধরণের ৪৭০টি চারা (কৃষ্ণচুড়া, নিম, কাঁঠাল, পেঁপে ও মরিচ চারা) চৌদ্দ হাজার দুইশত টাকায় বিক্রি করেছেন। এছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে তিনি পরিবারের দৈনন্দিন চাহিদা মেটানোর পর ছয় হাজার তিনশত টাকায় চার ধরণের উদ্বৃত্ত্ব সবজি (৫০টি কুমড়া, ৩০ কেজি ঝিঙ্গা, ৪০টি মিষ্টিকুমড়া ও ২০ কেজি করলা) বিক্রি করেছেন বলে জানান। তিনি আরও জানান, চলতি বর্ষা মৌসুমে তাকে বাজার থেকে কোন মরিচ কিনতে হয়না। উঠানের চারিদিকে বস্তায় রোপণকৃত মরিচ দিয়েই তার প্রয়োজন মিটে যায়।
![](https://barciknews.com/wp-content/uploads/2022/06/IMG20220612100657_01-W600.jpg)
নার্সারির চারা বিক্রি ও সবজি বিক্রির টাকায় কি করা হয় জানতে চাইলে কৃষক আবুল কালাম বলেন, ‘এই আয়ের টাকা দিয়ে তিনি চার মেয়েকে স্কুল ও কলেজে পড়াচ্ছেন। ভবিষ্যতের ইচ্ছার কথা জানতে চাইলে আবুল কালাম বলেন,‘ভবিষ্যতে আমি কিছু জমি দীর্ঘ মেয়াদে লিজ বা বন্ধক নিয়ে সেখানে বড় করে বৈচিত্র্যময় গাছের চারা উৎপাদন করবো। আয়ের টাকা দিয়ে ছেলে ও মেয়েদের লেখাপড়া করাবো, যতদুর তারা পড়তে চায়।”
![](https://barciknews.com/wp-content/uploads/2022/06/IMG20220612100556_01-W600.jpg)
কৃষক আবুল কালামের জমি না থাকলেও তিনি কখনো হতাশ হননি। কারণ তার মধ্যে রয়েছে দৃঢ় মনোবল, কঠোর পরিশ্রমের মানসিকতা, স্ত্রী ও মেয়েদের সহযোগিতা। তিনি নিরাশ না হয়ে সর্বদা আশায় বুক বেঁধে কাজ করেন এবং তার ফলও হাতে হাতে পান। কৃষক আবুল কালামের জমি নেই তাই সে কিছু জমির প্রত্যাশা করেন। কিন্তু গ্রাম বাংলায় অসংখ্য কৃষক ও জমির মালিক রয়েছেন যাদের অসংখ্য জমি পতিত পড়ে থাকে। তারা জমির সঠিক ব্যবহার করেন না। তাই যাদের জমি পতিত পড়ে রয়েছে তাদের উদ্দেশ্যে বলবো, জমি অনুৎপাদিত অবস্থায় পতিত ফেলে রাখবেনা না। ফসল চাষ করার সময় ও সুযোগ না থাকলে অন্তত ফল বা কাঠ জাতীয় গাছ লাগিয়ে রাখুন। এ গাছ আপনাকে যেমন পুষ্টি দেবে, তেমনি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ভূমিকা রাখবে। এ গাছই একদিন আপনার বিপদে সাহায্যকারী হিসেবে আপনার পাশে দাঁড়াবে।