ফসলের হাসপাতালে কৃষকই ডাক্তার
নেত্রকোনা থেকে মো. সুয়েল রানা
আমরা জানি যে, জলবাযু পরির্বতন একটি প্রাকৃতিক ঘটনা। কিন্তু মানুষের কর্মকান্ডে ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলছে এর উপর। ফলে উষ্ণতা বাড়ছে আর এই উষ্ণতা বদল করছে আমাদের দেশের আবহাওয়ার ধরণ। হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের ষড়ঋতুর বৈচিত্র্য। জলবাযুর পরির্বতনের ফলে সবচেয়ে বেশি বিরুপ প্রভাব পড়ছে আমাদের কৃষির উপর। বন্যার, আকষ্মিক বন্যা, জলাবদ্ধতা, খরা, শৈতপ্রবাহ ফসলের রোগ বেড়ে যাওয়া, পোকার আক্রমণ ও সংখ্যা বেড়ে যাওয়া, নিয়মিত বৃষ্টিপাত না হওয়া নানান জলবায়ুজনিত দুর্যোগে কৃষি আজ প্রায় বিধ্বস্ত।
জলবাযুর এই বিরূপ প্রভাব কৃষির উপরনির্ভরশীল কৃষককে বির্পযস্ত করছে দিনকে দিন। টিকে থাকার লড়াইয়ে তাঁরা পুরনো অভিজ্ঞতার সাথে নতুন নতুন কৌশল রপ্ত করতে শুরু করেন তারা। নেত্রকোনা জেলার আটপাড়া উপজেলার স্বরমুশিয়া ইউনিয়নের বাঘরা হাওর কৃষক সংগঠনের সদস্যরা জলবায়ুজনিত এই দুর্যোগ মোকাবিলায় নানান কৌশল রপ্ত করেছেন। এই প্রসঙ্গে কৃষক মো: সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘ফসল আমার জীবন ও জীবিকার একমাত্র অবলম্বন। সেই ফসলের চিকিৎসা প্রয়োজন। প্রয়োজন ফসলের চিকিৎসার জন্য জায়গা তৈরি করার।”
এই সমস্যা দূর করার জন্য বাঘরা কৃষক সংগঠনের সদস্যরা ২০০৮ থেকে বীজের সমস্যা সমাধানের জন্য কৃষক নেতৃত্বে ধানের জাত গবেষণা করে বীজের সমস্যার সমাধান করতে পেরেছেন। আগে যেখানে ৪/৫ জাতের ধান চাষ করা হতো বর্তমানে সেখানে ৩৭ জাতের ধানের চাষ হয়। পানি সমস্যা সমাধানের জন্য একক ফসল ধানের পরিবর্তে বর্তমানে নানা জাতের সবজি, মসল্লা, ডাল জাতীয় ফসল ও গম চাষ করছেন। পোকা আক্রমণের সমস্যা সমাধান করার জন্য নেত্রকোনা জেলার আটপাড়া উপজেলার স্বরমুশিয়া ইউয়িনের বাঘরা হাওর কৃষক সংগঠন উদ্যোগে ফসলের হাসপাতাল গড়ে তোলা হয়।
ফসলের হাসপাতালে প্রতিমাসেই একটি সভা করা হয়। সভায় সকলেই বিভিন্ন রোগাক্রান্ত ফসলের গাছ নিয়ে আসেন। সেখানে অভিজ্ঞ কৃষকরা নির্ণয় করেন রোগ ও রোগের কারণ। এভাবে আলোচনায় বেরিয়ে আসে এসব সমস্যা সমাধানের পথও। হাসপাতালে আছে বিভিন্ন উপকারী ও অপকারী পোকার ফটো, রোগের লক্ষণ, সমাধানের উপায়। উপস্থিত সকল কৃষককে শিখিয়ে দেওয়া হয় কিভাবে তারা পোকা চিনবেন, দূর করবেন এবং চিকিৎসা করবেন। এই ফসল হাসপাতালে উপস্থিত থাকেন জৈবকৃষি চর্চাকারী কৃষকও। তাঁরা প্রচার করেন জৈবকৃষি বার্তা। এভাবে কৃষি সমস্যা সমাধানের জন্য কৃষকরা নতুন অভিজ্ঞতা, নতুন তথ্য সম্পর্কে জানতে পারেন।
কৃষক তাদের লোকায়ত জ্ঞানের মাধ্যমে এলাকার কৃষকের শস্য ফসলের চিকিৎসা করে থাকেন। কৃষকের এই হাসপাতালের কার্যক্রম পরিদর্শন করে কেন্দুয়া নগুয়া গ্রামের কৃষক আবুল কামাল। তার গ্রামে গড়ে তোলেন একটি ফসলের হাসপাতাল যেখানে আশুজিয়া ইউনিয়নের কৃষকেরা তাদের গ্রামের শস্য-ফসলের রোগাবালাই হলে এই হাসপাতালে নিয়ে আসেন। কৃষক তার লোকজ্ঞানের মাধ্যমে ফসলের চিকিৎসা করেন।
অন্যদিকে জৈবকৃষির চর্চার পরামর্শ প্রদান করা হয়ে থাকে এই হাসপাতাল থেকে। ফলে গ্রামে গ্রামে বিষের ব্যবহার কমে আসছে। কৃষকেরা গ্রামে তৈরি করছেন ভার্মি কম্পোস্ট, জৈব সার। গ্রামকে গড়ে তুলেছেন নিম গ্রাম হিসেবে। পাখি রক্ষার জন্য গ্রামের গাছে গাছে বেঁধে দিয়েছেন কসলী। এছাড়া কৃষকেরা গ্রামে গড়ে তুলেছেন স্থানীয় জাতের শস্য-ফসলের বীজঘর। যে বীজঘর থেকে কৃষকেরা বীজ বিনিময় করে থাকেন বিনামুল্যে।
এদিকে কৃষক সংগঠনের এই উদ্যোগকে সহায়তায় এগিয়ে আসে উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপÍর। প্রতিমাসে উপসহকারী কৃষিকর্মর্কতার সাথে কৃষকদের বৈঠক হয়, যা এখন আর একটি গ্রামে সীমাবদ্ধ নেই। ৪টি গ্রামের কৃষক আসেন প্রতিমাসে আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য। তাছাড়া এলাকার সম্পদ ব্যাক্তিদের নিয়ে জৈব বালাইনাশক তৈরি ও ব্যবহার শেখানো হয় এখানে। কখনও কখনও উপকারী অপকারী পোকা পরিচিতি, কখনো জৈব সার প্রস্তুতকরণ ও ব্যবহার নিয়েও প্রশিক্ষণ হয়। এলাকার ৫ জন সম্পদব্যক্তি নিয়মিতভাবে কৃষকদের সহায়তা করেন। বর্তমানে ৩৫ জন কৃষক গর্ত কম্পোষ্ট করেন এবং একজন ভার্মি কম্পোস্ট করে ব্যবহার করছেন জমিতে।
কৃষকদের এই উদ্যোগকে এগিয়ে নিয়ে যেতে উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও স্থানীয় সরকার কৃষকদেরকে ধান ভাঙ্গানোর মেশিন, সবজি-ধান, পাট, সরিষা বীজ এবং সেচের জন্য পাইপ,ড্রাম দিয়ে সহায়তা করেছে। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ প্রান্তিক কৃষকদের বীজ, ভাতা কার্ড দিয়ে সহায়তা করেছেন। হাসপাতালকে কেন্দ্র করে ১০০ জন প্রানিÍক কৃষক বিভিন্ন সেবার সাথে যুক্ত হতে পেরেছেন।