নটাখোলা কৃষি প্রতিবেশ শিখন কেন্দ্র: কৃষকের উদ্যোগে স্থায়িত্বশীল কৃষির দৃষ্টান্ত
মুকতার হোসেন, বারসিক, হরিরামপুর, মানিকগঞ্জ
মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর উপজেলার লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়নের নটাখোলা গ্রামের কৃষক এরশাদ মুন্সী কৃষি ও পরিবেশগত স্থিতিশীলতার এক অনন্য উদাহরণ তৈরি করেছেন। ৬১ বছর বয়সী এই কৃষকের পরিবারে ৪ জন সদস্য রয়েছে। তার বসতভিটা ৬০ শতক এবং আবাদি জমি ৩৫০ একর। কৃষিই তার প্রধান পেশা, পাশাপাশি তিনি খেজুর গাছের রস সংগ্রহ করেন।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় কৃষকের প্রচেষ্টা
লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়ন এক দুর্যোগপ্রবণ এলাকা, যেখানে বন্যা, খরা ও নদীভাঙনের ফলে প্রতি বছর কৃষিজমি, ফসল, গাছপালা, শাকসবজি ও রাস্তা-ঘাট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় চরাঞ্চলে বৈচিত্র্যময় ফসল চাষ, স্থানীয় বীজ সংরক্ষণ, কৃষকদের সঙ্গে সংলাপ, অভিজ্ঞতা বিনিময়, ও স্থানীয় সংগঠন তৈরির মাধ্যমে টেকসই কৃষি ব্যবস্থার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
নটাখোলা কৃষি প্রতিবেশ শিখন কেন্দ্রের যাত্রা
এই প্রয়াসের অংশ হিসেবে এরশাদ মুন্সী তার বাড়িতে “নটাখোলা কৃষি প্রতিবেশ শিখন কেন্দ্র“ প্রতিষ্ঠা করেছেন। এখানে সারা বছর ধরে নিরাপদ ও জৈব উপায়ে নানা ধরনের সবজি যেমন পুঁইশাক, মুলাশাক, শিম, ধুন্দল, শশা, করল্লা, লাউ, মিষ্টি কুমড়া, বেগুন, টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি ইত্যাদি চাষ হয়। এছাড়া, তিনি জৈব বালাইনাশক (ভার্মিকম্পোস্ট, টাইকম্পোস্ট, গোবর সার, ফেরোমোন ফাঁদ, তরল সার) ব্যবহার ও উৎপাদন করেন।
এছাড়া মাঠ ফসলের মধ্যে রয়েছে আউশ ধান (পরাঙ্গি), আমন ধান (হিজল ও দিঘা)। ফলজ গাছের মধ্যে আম, কাঠাল, লিচু, পেয়ারা, নারিকেল, ড্রাগন, জামরুল, বেল, বড়ই, ডালিম, সফেদা, আতাফল, পানিফল ইত্যাদি রয়েছে। কাঠজাতীয় গাছের মধ্যে মেহগনি, আকাশি, কদম, নিম, জারুল এবং ঔষধি গাছের মধ্যে এলোভেরা, বিজজারুল, কালাকিশোরী, ইছামতি রয়েছে। এছাড়া তিনি গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি ও কবুতর পালন করেন।
কৃষকদের জন্য শিখন কেন্দ্রের ভূমিকা
নটাখোলা কৃষি প্রতিবেশ শিখন কেন্দ্র ইতিমধ্যেই স্থানীয় কৃষকদের জন্য একটি তথ্য ও সহায়তা কেন্দ্র হিসেবে কাজ করছে। এখান থেকে কৃষকেরা বীজ সংরক্ষণ ও চারা উৎপাদন কৌশল, কম খরচে ফসল উৎপাদন, জৈব কৃষি পরামর্শ ও আধুনিক কৃষি উপকরণ সংক্রান্ত তথ্য পাচ্ছেন। এছাড়া, হরিরামপুর উপজেলা কৃষি অফিসের সহযোগিতায় এখানে কৃষি প্রদর্শনী, টাইকম্পোস্ট উৎপাদন প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য কৃষি সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে।
শিখন কেন্দ্রটি ইউনিয়নের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত হওয়ায় এলাকার কৃষকেরা সহজেই এখানে এসে পরামর্শ ও সহায়তা নিতে পারেন। এছাড়া, রাস্তার পাশে অবস্থিত হওয়ায় কৃষকদের জন্য যোগাযোগ সহজতর হয়েছে এবং এটি স্থানীয়ভাবে “কৃষি বাড়ি“ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও সম্ভাবনা
এরশাদ মুন্সী তার শিখন কেন্দ্রের মাধ্যমে স্থানীয় জাতের ফসল নিয়ে কৃষকদের নেতৃত্বে প্রায়োগিক গবেষণা চালানোর পরিকল্পনা করছেন। তার লক্ষ্য হলো; চরাঞ্চলে বৈচিত্র্যময় ফসল চাষের মাধ্যমে স্থানীয় জাতের সংরক্ষণ ও বিস্তার, জৈব বালাইনাশক ব্যবহার করে কৃষি উৎপাদনের খরচ কমানো এবং নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের মাধ্যমে স্থানীয় জনগণের স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমানো।
উপসংহার
এরশাদ মুন্সীর নটাখোলা কৃষি প্রতিবেশ শিখন কেন্দ্র কৃষকদের জন্য একটি অনুকরণীয় মডেল। এটি শুধু তার নিজের পরিবারের জন্য নয়, বরং আশপাশের ইউনিয়নের কৃষকদের জন্যও একটি টেকসই কৃষি প্রশিক্ষণ ও উদ্ভাবনী কার্যক্রমের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। স্থানীয় পর্যায়ে কৃষি উন্নয়ন ও জলবায়ু সহনশীলতার এই উদ্যোগ ভবিষ্যতে আরও বিস্তৃত পরিসরে ছড়িয়ে পড়বে বলে আশা করা যায়।