অন্তহীনভাবে কাজ করে যাচ্ছেন নারীরা, স্বীকৃতি কবে?
মানিকগঞ্জ সিংগাইর থেকে রিনা আক্তার
আমাদের সমাজে নারীরা গৃহস্থালী সামগ্রিক কাজ করলেও তাদের স্বামী বা সন্তানদের কাছে যদি জানতে চাওয়া হয় তোমার মা কি করেন? তারা সকলেই উত্তর দেয় আমার স্ত্রী বা মা কিছুই করেন না। অথচ নারীরা নিজ গৃহে পুরুষের তুলনায় তিনগুণ কাজ করলেও গবেষণায় দেখা গেছে নারীরা বাড়িতে যে গৃহস্থালির কাজ করেন তার মুল্য দেশের মোট জিডিপির প্রায় ৭৭ থেকে ৮৭ ভাগ। কিন্তু তাদের এই অবদানকে যুক্ত করা হচ্ছে না দেশের জিডিপিতে। এমনই এক নারী ইজমা আক্তারের আক্ষেপের গল্প শুনবো।
সিংগাইর উপজেলার গোবিন্দল গ্রামের বাসিন্দা ইজমা আক্তার (৩৫), তার স্বামী কহিনুর মিয়া (৪০) পেশায় একজন অটোচালক। দুই মেয়ে ও এক ছেলে নিয়েই তার সংসার। ছোটবেলা থেকেই পরিবারের বোঝার পরিচয়ে বেড়ে উঠেছেন। কৈশোরকাল পেরুবার আগেই কিভাবে আপদকে দূর করা যায় সেই চিন্তায় অস্থির বাবা। মেয়ে হিসেবে সংসারে কোন মূল্য না থাকায় ১৮ বছরের আগেই বিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হয় পরিবার। শ^শুর বাড়িতে আসার পরও তেমন কোন মূল্যায়ন করা হয়নি।
তিন সন্তান আর স্বামী নিয়ে কোনরকম রাতদিন পার করছেন ইজমা আক্তারের। সকাল থেকে রাত অবধি চলে তার সংসার নামক যন্ত্রের চাকা। সকালে পরিবারের জন্য নাস্তা বানানো, সন্তানদের পড়াশুনা করানো, স্কুলের জন্য প্রস্তুত করা সবই করতে হয় তাকে। বাচ্চাদের পড়াশুনার পাশাপাশি ঘর ও সংসারের সমস্ত (রান্না করা, জ¦ালানি সংগ্রহ, প্রাণিসম্পদের দেখাশুনা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, পারিবারিক ও মাঠের কৃষি কাজ, আয়র্বনমুলক কাজ প্রভৃতি) বিষয়েই মাথা ঘামাতে হচ্ছে তাকে। এই মাথা ঘামানো কিন্তু কোন পারিবারিক সিদ্ধান্ত, পছন্দ-অপছন্দের বা স্বাধীনতার নয়, এটি কেবল পারিবারিক কাজগুলো ভালোভাবে সম্পন্ন করার সবার সিদ্ধান্ত আর পছন্দ মেনে নেয়ার। কিন্তু এতো কিছু করার পরও পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার চোখে তিনি কোন কাজই করেন না!
স্বামীর ঘরে আসার পর যখন সে পরপর ২ জন কন্যাশিশুর জন্ম দিলেন তখন তার উপর মানসিক নির্যাতনের পাশাপাশি শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়্। পরিবার ও আত্মীয়দের কাছ থেকে নানান কটু কথা শুনতে হয়। তারা বলেন, ‘পরিবারের বোঝা শুধু বাড়িয়েই চলছে কিভাবে যে কি করবে এই মেয়েদের নিয়ে’। মেয়ে জন্ম দিয়ে তিনি যেন আকাশ সমান ভুল করে ফেলেছেন বলে মনে করেন অন্যরা। তার জীবনে যেন আধার নেমে আসছে। মেয়েদের দিকে পরিবারের কারোর কোন খেয়ালই ছিল না মেয়েদের দেখাশুনার পাশাপাশি পরিবারের সব কাজ তার একাই করতে হতো। আবার পান থেকে চুন খসলেই শুনতে হতো নানান কথা। পরবর্তী সময়ে সে আবার এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেন তখন পরিবারের সবার খুশি যেন সীমাহীন। কারণ পরিবারের সম্পদ জন্ম নিয়েছে। পরিবারের সকলের ধারণা পুত্রসন্তান পরিবারকে রক্ষা করবে। বয়স্ক সময়ে বাবা-মাকে দেখবে। হায়রে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ! এতকিছুর পরও একটি কথা রয়েই যায় পরিবারে নারীর কাজের বোঝার কোন কমতি নেই। দিনকে দিন কাজের চাপ শুধু বেড়েই চলছে কিন্তু গুরুত্ব যেন সেক্ষেত্রে শুধুই কমছে।
ইজমা আক্তার তাই বলেন, ‘‘আমরা নারীরা যে কাজ করি সারাদিন রাত তা হিসেব করলে কাগজের খাতা শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু কাজের ধরন লিখা শেষ হবে না। অথচ আমাদের এ্ই কাজের কোন মূল্যই নাই। আমাদের কাজে টাকা নাই দেখে এই কাজ কারও চোখেই পড়েনা’’।
অর্থনীতিতে উন্নয়নের সবচেয়ে বড় শক্তি নারী। তাই নারীদের সকল কাজের স্বীকৃতি দিতে হবে। সাধারণত ্্একজন পুরুষ মানুষ তার কর্মক্ষেত্রে কাজ করেন আটঘণ্টা আর একজন নারী ঘরে কাজ করেন দৈনিক আঠারো ঘণ্টা। কিন্তু নারীর কাজের স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। নারীর কাজের স্বীকৃতি তার টাকার অংকে নয়; সম্মান দিয়ে দিতে হবে।