আন্তর্জাতিক নারী দিবসে জেন্ডার সমতার লক্ষ্যে নারী নির্যাতন বন্ধের প্রত্যয় উচ্চারিত হোক

কাজী সুফিয়া আখ্তার
আজ ৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস। জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত সকল রাষ্ট্রে এবং সমাজতান্ত্রিক সকল রাষ্ট্রে দিবসটি উদ্যাপিত হবে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্যে দিয়ে, সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন স্তরে, ভিন্ন ভিন্ন সমস্যা সমাধানের লক্ষ্য সামনে রেখে। বাংলাদেশেও দিনটি পালিত হয় বিপুল উদ্দীপনার মধ্যে দিয়ে কোনো না কোনো সমস্যা জনসম্মুখে তুলে ধরা এবং সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে পদক্ষেদ গ্রহণের তাগিদে। বাংলাদেশের সংগ্রামী নারীদের কাছে এটি শুধুমাত্র ফুলেল শুভেচ্ছা জানানোর একটি দিন নয়।


জাতিসংঘ এ-বছর এই দিনটির প্রতিপাদ্য বা থিম নির্ধারণ করেছে Gender equality today for a sustainable tomorrowঅত্যন্ত সময়োপযোগী, যুক্তিসঙ্গত ও যথার্থ হয়েছে এই নির্ধারিত প্রতিপাদ্য। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এই প্রতিপাদ্যের বাংলা করেছেÑ‘টেঁকসই আগামীর জন্য জেন্ডার সমতাই আজ অগ্রগণ্য।’ অত্যন্ত সুন্দর ছন্দময় অনুবাদ।


বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নারী সংগঠন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ এ-বছর আন্তর্জাতিক নারী দিবসে তাদের প্রতিপাদ্য বা শ্লোগান ঠিক করেছেÑ ‘অভিন্ন পারিবারিক আইন চালু কর/নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ কর।’ সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি তাদের শ্লোগান নির্ধারণ করেছেÑ ‘নারীর প্রতি বৈষম্য ও সহিংসতা বন্ধ কর / সম্পদ-সম্পত্তিতে সমান অধিকার ও অংশীদারিত্ব নিশ্চিত কর।’


অন্যতম আর একটি বড় সক্রিয় নারী সংগঠন ‘নারীপক্ষ’ আন্তর্জাতিক নারী দিবস ইতিমধ্যে ৫মার্চ ২০২২ তারিখে অত্যন্ত সুন্দরভাবে র‌্যালি, লাঠি খেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উদ্যাপন করেছে। সময়োপযোগী বক্তব্য ও শ্লোগান জনসম্মুখে তুলে ধরেছে। নির্ধারিত শ্লোগান হলো: ‘পৃথিবী আমারে চায়/ জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় আমরা।’ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে ভয়াবহ সংকট সৃষ্টি হবে, তাতে নারী ও শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের খেসারত বাংলাদেশের মানুষেরা ভৌগলিক কারণে প্রতিবছর দিচ্ছে। সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে গৃহীত উদ্যোগ, পরিকল্পনা প্রণয়ন ও প্রকল্প বাস্তবায়নে অধিক সংখ্যক নারীকে সংযুক্ত করে এই সংকট মোকাবিলার কাজ এখনই শুরু করা দরকার। প্রাচীনকাল থেকেই নারী মানসিকভাবে পরিবেশ রক্ষক।
প্রতিটি শ্লোগানই অত্যন্ত সুচিন্তিত, সুস্থ সমাজ নির্মাণের জন্য, গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয়, বাস্তবমূখী। সমাজে বিরাজমান নারী-পুরুষের বৈষম্য হ্রসের জন্য তো বটেই, সভ্য সমাজ নির্মাণ ও মানবিক পরিবার ও রাষ্ট্র গঠনের পূর্বশর্ত জেন্ডার সমতা। সকল ক্ষেত্রে নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজন জেন্ডার সমতাপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই কারণে বিগত কয়েক দশক ধরেই বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতা বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। শিক্ষা, স্বা¯হ্য, খাদ্য ও পুষ্টি, কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য, অসমতা দূরীকরণে, নিরাপদ চলাফেরায়, সরকারি-বেসরকারি উন্নয়ন পরিকল্পনায় বিষয়টি যুক্ত করা হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সুফলও পাওয়া যাচ্ছে।


বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। বাংলাদেশ আজ নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উপনীত হয়েছে। দারিদ্র্যের হার হ্রাস পেয়ে ২০.৫% শতাংশে দাঁড়িয়েছে। গড় আয়ু বেড়েছে মানুষের। বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু ৭৪.৫ বছর। সাফল্য দেখিয়েছে, বিশেষ করে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট সংকট মোকাবিলায়। বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯ মোকাবেলায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার পারদর্শিতা পরিচয় দিয়েছে ও সক্ষমতার সুনাম অর্জন করেছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রীদের সংখ্যা বৃদ্ধি হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে মেয়ে শিশুর হার ৫১% শতাংশ।


রাষ্ট্র পরিচালনায়, জাতীয় সংসদে সাধারণ আসন ও সংরক্ষিত আসনে, স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন পদে এবং রাজনৈতিক দলে নারীদের সক্রিয় ও কার্যকর অংশগ্রহণ বেড়েছে। এককথায় বাংলাদেশের বহুমূখী অগ্রগতির ক্ষেত্রে নারীর পদচারণার ক্ষেত্র বিস্তৃত হয়েছে। দেরিতে হলেও সরকারি- বেসরকারি পর্যায়ে তার ভূমিকা ও অবদান স্বীকৃত হচ্ছে বিধায় সর্বত্র আজ নারীর পদচারণা দৃশ্যমান হয়ে ওঠেছে। নারীর বহুমূখী ক্ষমতায়ণের চিত্র স্পষ্ট হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে তৈরি পোশাকশিল্পের ক্ষেত্রটিতে কর্মরত ৮০% নারী শ্রমিকের অবদানে উজ্জ্বল। মোদ্দা কথা, নারী ও পুরুষের শ্রমে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু নারী শ্রমের স্বীকৃতি ও মূল্যায়ন সমাজে পরিলক্ষিত হচ্ছে না। যদি হতো, তা হলে প্রতিদিন রাস্তাঘাটে, ঘরে-বাইরে, ট্্েরনে, বাসে, লঞ্চে, বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে এতো ধর্ষণের ঘটনা, নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটতো না। এইসব ঘটনার সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে বিচারহীনতা ও বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা যেমন দায়ী, তেমন দায়ী নারীর প্রতি অধঃস্তন দৃষ্টিভঙ্গি। নারীকে মানুষ হিসেবে মর্যাদা ও সম্মান না প্রদানের সংস্কৃতি।


প্রশ্ন হলোÑ‘জেন্ডার সমতা’ কেন এতো গুরুত্বপূর্ণ? এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আমরা অনেক উন্নয়নের পরও একটি বৈষম্যময় সমাজে বাস করি। এখানে সিমন দ্য বেভোয়ার এর একটি মূল্যবান এবং এখনো প্রযোজ্য উক্তি উদ্ধৃতি করছি। তিনি বলেছেন, ‘কেউ নারী হয়ে জন্মায় না, বরং ক্রমশ নারী হয়ে ওঠে।’ সামাজিকভাবে মেয়ে শিশু এবং ছেলে শিশুর বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে শৈশব থেকেই পরিবার, সমাজ কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করে। বহু শতাব্দী প্রাচীন এই বিধিনিষেধের বেড়াজালে আটকে পড়ে নারী এবং পুরুষের খাদ্য, শিক্ষা, কাজ, চলাফেরা, কথাবার্তা, বিনোদনের ভিন্নতা নারী এবং পুরুষের মাধ্যে বিভাজন ও অসমতা তৈরি করেছে শতাব্দীর পর শতাব্দীজুড়ে। সামাজিকভাবে রচিত বিভাজনের এই রাজনীতি মানুষ হয়ে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে পরিবারে, সমাজে ও রাষ্ট্্ের নারীকে অধস্তন দৃষ্টিতে দেখার দুষ্টিভঙ্গি, মনোভাব ও শিক্ষা, খাদ্য, পুষ্টি, চিকিৎসা প্রাপ্তি, কর্মসংস্থান সর্বক্ষেত্রে অসমতা জন্ম দিয়েছে। সামাজিকভাবে সৃষ্ট নারী-পুরুষের এই ভূমিকা ও আচরণই জেন্ডার ধারণা। এই বৈষম্যমূলক ধারণা লালনপালন করে পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন কর্মসূচি, গণমাধ্যম, আইন ও বিচারব্যবস্থাসহ প্রচলিত নানা বিধিমালা।


জেন্ডার সমতা হলো নারী এবং পুরুষকে সমভাবে দেখার একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি। যাতে কেউ কোনো ক্ষেত্রে পিছিয়ে না থাকে। অসম্মানিত না হয়। কিন্তু আমরা বাস্তবজীবনে কী দেখছি? জেন্ডার ধারণার উপর ভিত্তি করে যে জেন্ডার শ্রম বিভাজন, তার ফলে নারীর পুনঃউৎপাদনমূলক কাজকে মুখ্য ধরা হয়। অথচ ঘরের কাজ, সন্তান ধারণ ও পালন,পরিবারের লোকজনের সেবা-শুশ্রুষা করার এই সামাজিক ও পারিবারিক দায়িত্ব তাকে কর্মক্ষেত্রে ও সামাজিক ভূমিকা পালনে পিছিয়ে রাখে। এতে করে বিভিন্ন গবেষণায় যে তথ্য উঠে এসেছে, তা হলো,পুরুষের কাজের ৯৮ শতাংশ যখন জিডিপিতে যোগ হচ্ছে; তখন নারীর কাজের মাত্র ৪৭ শতাংশ জিডিপিতে যোগ হচ্ছে। ঘরের কাজ যোগ করা হলে জিডিপিতে শতাংশ আরও বেশি হতো, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। উৎপাদনমূলক ও সামাজিক ভূমিকা পালনে নারীকে নিরুৎসাহিত করা, সুযোগ না দেয়ার ফলে সমাজে, সংসারে ও রাষ্ট্রে সমান অংশগ্রহণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সম্মান ও মর্যাদা লাভের ক্ষেত্রে, অধিকার প্রতিষ্ঠায় সমাজে নানা জটিলতা সৃষ্টি হয়। শুধু তা-ই নয়,উন্নয়নে নারী সক্রিয় চিরকাল। অথচ উন্নয়নে অংশীদার নারীর অংশীদারিত্ব এখনো স্বীকৃত নয়।
বর্তমানে একটি দেশে মানব উন্নয়ন পরিমাপে জেন্ডার প্রেক্ষিত বিশ্লেষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি সামগ্রিক উন্নয়ন ও অগ্রগতি পরিমাপের অপরিহার্য মানদন্ড। একটি দেশে নারী নির্যাতন ধারাবাহিকভাবে ঘটবে, আর দেশটির গড়পরতা মাথাপিছু আয় বাড়লে, তাকে সভ্য ও উন্নত দেশ বলা যাবে না। বলা সমীচীনও নয়। কারণ নারী মানুষ এবং দেশের নাগরিক। নারী নির্যাতন বন্ধ না হলে ‘উন্নয়ন’ প্রশ্নের সম্মুখীন হয়।


বাংলাদেশে নারী নির্যাতন, নারী পাচার, ধর্ষণ ও বাল্য বিবাহ বন্ধে পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। কিন্তু এই ক্ষেত্রে নারীর অবস্থা ভালো নয়, প্রতিদিনের পত্রিকা সেই সাক্ষ্য দেয়। কোভিড-১৯ এই অবস্থা আরও শোচনীয় করে দিয়েছে। সাধারণ মানুষের কর্মহীনতা তাদের দারিদ্র্য আরও বৃদ্ধি করেছে। নারী নির্যাতন, বাল্য বিবাহ বেড়ে গেছে। ঘরে-বাইরে নারীর নিরাপত্তাহীনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কি ঘরে, কি বাইরে, নারীর অবস্থা ও অবস্থান আরও শোচনীয়। উন্নয়ন যা ঘটেছে তা ধরে রাখতে হলে সমাজে, পরিবারে, রাষ্ট্রে বিদ্যমান বৈষম্য কমিয়ে সর্বক্ষেত্রে নারী-পুরুষের অংশগ্রহণ, সম্মান ও মর্যাদা, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। কাজেই সর্বক্ষেত্রে আজ উন্নয়নের পাশাপাশি নারী-পুরুষের সমঅংশগ্রহণ, সুযোগ ও অধিকার প্রতিষ্ঠা কল্পে আরো গুরুত্ব ও মনোযোগ দিতে হবে দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকারি, বেসরকারি সংগঠন/প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র ,সমাজ ও পরিবারকে। নইলে এই উন্নয়ন টেকসই হবে না।


আন্তর্জাতিক নারী দিবসের সকল শ্লোগান সারাবছর ধরে সুপরিকল্পিতভাবে কার্যকর হোক। তবে সবার আগে, নারী নির্যাতন বন্ধের শপথ নেয়া হোক, দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করা হোক দেশ ও জাতির স্বার্থে; সামগ্রিক উন্নয়নের লক্ষ্যে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছা খুব জরুরি। আন্তর্জাতিক নারী দিবস সফল হোক।
কাজী সুফিয়া আখ্তার ঃ লেখক, গবেষক ও নারী অধিকার আন্দোলন কর্মী

happy wheels 2

Comments